পেশাদারিত্বের আবর্তে মুক্ত গণমাধ্যমের আকাঙ্ক্ষা

গণমাধ্যম

‘মু ক্ত সাংবাদিকতা’ নিয়ে সাংবাদিকতার বৃহত্তর পরিমণ্ডলে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে সাম্প্রতিক দশকে। প্রতিবছর ৩ মে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ ঘিরে এ আলোচনা আবর্তিত হয় নতুন বিষয়বৈচিত্র্যে। তবে আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে অনুচ্চারিত কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করাও প্রয়োজন, তা না হলে প্রকৃত সংকট দূর করতে ব্যর্থ হবো আমরা। 

বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে মুদ্রিত সংবাদপত্রের আধিপত্যের মাঝেই ইলেকট্রনিক মিডিয়া জায়গা করে নিয়েছে। আবার এই বিকাশমান ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পরিপূর্ণতা আসার পূর্বেই এসে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া। এবং সেই সোশ্যাল মিডিয়াও ক্ষণে ক্ষণে তার চরিত্র বদলাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল মিডিয়া এখন নিউজের প্রধান সোর্স হয়ে উঠছে। এর আধিপত্য এই দুই ধাঁচের সাংবাদিকতাকেই ফেলছে চ্যালেঞ্জের মুখে। এই বাস্তবতায় কার কী স্বাধীনতা আছে– সেই প্রশ্নই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। 

যে দেশে যে পলিসি, সেই অনুযায়ী সেখানকার সাংবাদিকতা পরিচালিত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, মুক্তমতের সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ হলেও পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিচারিতা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে কতখানি আগ্রাসী, তা নিয়ে সামান্যই আলোচনা হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি গাজা উপত্যকা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবরে সেই বৈপরীত্য। সেখানে একে বর্ণনা করা হচ্ছে ‘গাজা ওয়ার’ বা ‘গাজা যুদ্ধ’ নামে। প্রকৃত সত্যটি কী? গাজায় ‘ওয়ার’ কোথায়? সেখানে একতরফাভাবে ফিলিস্তিনবাসীদের নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে বর্বরভাবে। যাদের শক্তি ও অর্থ আছে, তারা যুদ্ধবাজ ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে সমস্ত বড় দেশ। হাতেগোনা কিছু দেশ ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ালেও খোদ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের ভূমিকাই সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো পশ্চিমা প্রভাবে তাদের সংবাদের পরিভাষাই পরিবর্তন করে ফেলছে। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে দেখব, এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে নানা শোরগোল হচ্ছে। বাস্তবতা যদি দেখি তবে কোথায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা? কোথায় সম্পাদক আর কোথায় সাংবাদিকের স্বাধীনতা? মুক্ত সাংবাদিকতা বলে আসলে কী বোঝায়? নির্মোহ সত্য হচ্ছে, আমাদের তথাকথিত অনেক সাংবাদিক নেতা ও স্তাবক সাংবাদিকরা এই মুক্ত সাংবাদিকতার পথকে রুদ্ধ করে ফেলেছেন। এখানে এত বেশি গ্রুপিং দেখা যাবে যে– বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে, এই কি তবে সাংবাদিকতা পেশার মান! 

একসময় আমরা সংঘবদ্ধভাবে আমাদের অধিকারের প্রশ্নে ও সকল সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে পথে নামতাম। এখন কি সংঘবদ্ধভাবে নামার মতো অবস্থা আছে? দ্বিধাবিভক্তি আর ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের প্রবণতা এতটাই প্রকট যে, সাংবাদিকদের অনেককেই দেখি যারা এখন রীতিমতো রাজনৈতিক ক্যাডার বনে গেছেন! উদ্বেগের বিষয়, শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই এই ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাহলে কী করে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা হবে? 

সাংবাদিক হিসেবে আমাদের যে কর্তব্য, সেই কাজটাই করা উচিত সর্বাগ্রে। তা না করে আমরা কী করছি? রাজনৈতিক ক্যাডারের মতো কাজ করছি। দেখা যাচ্ছে, কেউ গুরুতর আওয়ামী লীগবিরোধী; তারা তাদের দৃষ্টিতে সরকারের ভালো কাজ দেখছে না। অন্যদিকে, আরেক দল গুরুতর বিএনপিবিরোধী; তাদের চোখে বিএনপির সবই খারাপ। এই যদি সাংবাদিকতার চালচিত্র হয়, তবে সেখানে সাংবাদিকতাকে পদদলিত করার সুযোগ তো আমরাই করে দিচ্ছি।  

আমাদের নৈতিক অঙ্গীকার বলে আর কি-ইবা অবশিষ্ট থাকছে? বস্তুতপক্ষে সাংবাদিকতায় সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে হবে– এটাই শিখে এসেছি আমরা। যাদের সম্পাদক হিসেবে পেয়েছিলাম সেই সময়ে তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা আমাদের পেশাগত নৈতিকতা মেনে চলায় উৎসাহিত করত। পাকিস্তানের অধীনতা থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটা চিন্তা-চেতনা তাদের মধ্যে ছিল। তখনকার সম্পাদকগণের কথা ও কাজের মধ্যে তার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে উঠত। এখন তো সেই রকম কিছু নেই। 

স্বাধীন দেশে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করব– এটাই হওয়া উচিত। বহুলাংশেই সেটা দেখতে পাচ্ছি না এখন। একটি বড় বিষয় হচ্ছে, সংবাদপত্রে সেই নিরেট সত্য উচ্চারণের জায়গাটা নেই। এখানে ‘করপোরেট কালচার’ বা ‘করপোরেট স্বার্থ’ এখন সংবাদপত্র বা সাংবাদিকতাকে গিলে খাচ্ছে বললেও ভুল হবে না। মুক্ত সাংবাদিকতা বা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদেরও একসময় যথেষ্ট দায় ছিল। সমকালীন রাজনীতিকদের মাঝে সেই প্রবণতার ছিটেফোঁটাও নেই– এ এক রকম ধ্রুব সত্য। 

গাছের গোড়ায় পচন ধরলে যেমন ওপরে পচন ধরে, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও এটি আজ প্রযোজ্য। সে কারণে মুক্ত সাংবাদিকতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব করতে সর্বাগ্রে আমাদের নিজেদের শুদ্ধ করা জরুরি। সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা উন্নত করতে না পারলে মুক্ত বা স্বাধীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার আকাঙ্ক্ষা অধরাই থেকে যাবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহ কিংবা সমাজ ও রাজনীতির দায়বদ্ধতার চেয়েও এটি জরুরি।

আলমগীর হোসেন: সম্পাদক, সমকাল



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews