কালাকানুন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ বাতিল করে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ’ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সাইবার নিরাপত্তা আইনে থাকা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপরাধে দণ্ডের যে বিধান ছিল তা নতুন অধ্যাদেশে স্থান পায়নি।
এ অধ্যাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে কোনো নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ বা অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধনকে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে আগের আইনের মতই পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রাখা হয়েছে অধ্যাদেশে।
‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’ রহিত করে বুধবার এই অধ্যাদেশ জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত করার কারণ হিসেবে এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, “সাইবার নিরাপত্তা আইন- ২০২৩ এ নাগরিক সুরক্ষা সংক্রান্ত বিধান অপ্রতুল থাকার কারণে এটি অপপ্রয়োগ ও নিপীড়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।”
সেই সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারকেও খর্ব করে বলে আইন রহিতের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাইবার নিরাপত্তা আইনে পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা (৪২ নম্বর ধারা) বাতিলের দাবি উঠেছিল। নতুন অধ্যাদেশের ৩৫ এর (ঘ) ধারায় পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
ওই ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এই অধ্যাদেশের অধীনে অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে পুলিশ।
অধ্যাদেশের সংজ্ঞায় ২ এর (ল) ধারায় নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে ‘সাইবার সুরক্ষা’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কোনো পোর্টাল বা নেটওয়ার্কে ব্যক্তির পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এজেন্ট বা টুলের অ্যাকসেসকেও সাইবার সুরক্ষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
অধ্যাদেশের ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা সফটওয়্যার ডেভেলপার বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল্স ব্যবহারকারী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বে-আইনি প্রবেশ করলে বা বে-আইনি প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিসাধন করলে ওই ব্যক্তির বা ডেভেলপারের বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুলস্ ব্যবহারকারীর কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অনলাইন জুয়ার বিষয়ে অধ্যাদেশের ২০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার পোর্টাল বা অ্যাপস বা ডিভাইস তৈরি করেন বা পরিচালনা করেন বা জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করেন বা খেলায় সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করেন বা উৎসাহ প্রদানের জন্য বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচার বা বিজ্ঞাপিত করেন, সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির কর্মকাণ্ড অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
৯টি ধারায় আগের দণ্ডও বাতিল
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারাটি পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। ২১ ধারায় বলা ছিল, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন তাহলে সেটি একটি অপরাধ। এই অপরাধের জন্য অনধিক পাঁচ বছরের সাজা এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান ছিল।
২১ ধারা ছাড়াও নতুন অধ্যাদেশ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪ ধারা।
এর মধ্যে ২৪ ধারায় ছিল পরিচয় প্রতারণা বা ছদ্মবেশ ধারণের দণ্ড; ২৫ ধারায় ছিল আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ- প্রকাশ ইত্যাদির দণ্ড; ২৬ ধারায় ছিল অনুমতি ব্যতীত পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার ইত্যাদির দণ্ড; ২৭ ধারায় ছিল সাইবার সন্ত্রাসী কার্য সংঘটনের অপরাধ ও দণ্ড।
২৮ ধারায় ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এইরুপ কোনো তথ্য প্রকাশ- সম্প্রচার ইত্যাদির দণ্ড; ২৯ ধারায় ছিল মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার ইত্যাদির দণ্ড; ৩১ ধারায় ছিল আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড এবং ৩৪ ধারায় ছিল মিথ্যা মামলা, অভিযোগ দায়ের ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্য।
নতুন অধ্যাদেশের ৫০ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১ ও ৩৪ ধারায় বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলা বা কার্যক্রম বাতিল হবে এবং এগুলোর ক্ষেত্রে আর কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। এসব ধারায় আদালত বা ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে যে দণ্ড ও জরিমানা করেছে; সেগুলোও বাতিল হবে।