ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক আক্রমণ সম্প্রসারণের তীব্র বিরোধিতা করেছেন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার নেতারা। ইসরাইল যদি গাজায় তাদের আক্রমণ বন্ধ না করে ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করে তাহলে ‘কঠিন পদক্ষেপ’ নেয়ারও হুমকি দিয়েছে পাশ্চাত্যের এ তিন দেশ।

সোমবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, তারা অধিকৃত পশ্চিমতীরে বসতি সম্প্রসারণেরও বিরোধিতা করেন। বিশ্বের মনোযোগ গাজার দিকে থাকায় অধিকৃত পশ্চিমতীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বেড়েই চলেছে। সেখানে ইসরাইলি অভিযানে প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

গত ২ মার্চ থেকে ত্রাণ অবরোধের মধ্যে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার গাজায় বোমাবর্ষণ তীব্র করার মধ্যেই নেদারল্যান্ডস ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) ইসরাইলের সাথে একটি বাণিজ্য চুক্তি পর্যালোচনা করার আহ্বান জানায়। এর কয়েক সপ্তাহ পরই এ বিবৃতি দেয়া হলো।

নেতানিয়াহুর সরকার ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় আক্রমণ শুরু করলে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করে। ইসরাইলের অব্যাহত আক্রমণে এ পর্যন্ত ৫৩ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং গাজার অধিকাংশ অঞ্চলই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু মঙ্গলবার ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কালাস বলেছেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু তাদের বর্তমান কার্যক্রম আত্মরক্ষার সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিতে পারে। ইসরাইলের সর্বশেষ গাজা আক্রমণ কি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে?

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা কী বলেছে?

তিন দেশের নেতা ইসরাইলের গাজা আক্রমণের সমালোচনা করেছেন, একইসাথে ফিলিস্তিনিদের ‘মানবিক দুর্ভোগ’কে অসহনীয় বলে বর্ণনা করেছেন।

তারা আরো বলেছেন, ‘যদি ইসরাইল তাদের নতুন সামরিক অভিযান বন্ধ না করে এবং মানবিক সাহায্যের ওপর তাদের বিধিনিষেধ না তুলে নেয়, তবে আমরা এর প্রতিক্রিয়ায় আরো কঠোর পদক্ষেপ নেব।’

এ তিন পশ্চিমা নেতা বলেছেন, তারা ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করলেও, ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তার বলেন, ‘নেতানিয়াহুর সরকার এ গুরুতর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকব না।’

গাজা যুদ্ধের কারণে মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটি পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সমর্থনকারী বসতি স্থাপনকারী ও সংগঠনগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, ‘ইসরাইলের গাজা যুদ্ধ ও অবৈধ বসতিগুলোর প্রতি সরকারের সমর্থন ইসরাইল সরকারের সাথে আমাদের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’

তীব্র আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে সোমবার ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ গাজায় নয়টি ত্রাণের ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। ইসরাইল সেখানে খাদ্য বা ওষুধ কিছুই ঢুকতে দিচ্ছে না এবং অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে জাতিসঙ্ঘের ত্রাণপ্রধান টম ফ্লেচার সামান্য কয়েকটি ত্রাণের ট্রাক ঢুকতে দেয়াকে ‘সমুদ্রের তুলনায় একটি ফোঁটা’ বলে অভিহিত করেছেন।

আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়ার পর মঙ্গলবার জাতিসঙ্ঘের মানবিক অফিসের মুখপাত্র জেন্স লায়ার্কে বলেছেন, ইসরাইল আরো প্রায় ১০০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমোদন দিয়েছে।

অধিকৃত পশ্চিমতীর নিয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার নেতারা বলেছেন, তারা ইসরাইলি বসতি সম্প্রসারণের সব প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছেন। কারণ, এ রকম চেষ্টা ‘অবৈধ ও একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনা এবং ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের উভয়ের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন করে’।

তারা বলেন, ‘আমরা আরো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করব না। তার মধ্যে নিষেধাজ্ঞাও থাকতে পারে।’

ফিলিস্তিনি পলিসি নেটওয়ার্ক আল-শাবাকার সহপরিচালক ইয়ারা হাওয়ারি বলেছেন, গাজায় যে গণহত্যা হয়েছে বা হচ্ছে, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্স এর দায় এড়াতে পারে না। সেটাকে আড়াল করতেই এখন এমন একটি বিবৃতি দিয়েছে তারা। তারা বিবৃতিটির দিকে ইঙ্গিত করে বলতে পারবে আমরা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি।’

তিনি বলেন, কেউই ইসরাইলের কাছে তাদের অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করেনি।

হাওয়ারি বিশেষভাবে যুক্তরাজ্যের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এতে তারা বিশেষভাবে জড়িত। গত ১৯ মাসে যুক্তরাজ্য থেকে ইসরাইলে কত অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে তার প্রতিবেদন প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে।’

পশ্চিমা দেশগুলো আর কী বলেছে?

সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিয়া মালমার স্টেনারগার্ড মঙ্গলবার বলেছেন, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে তার দেশ ইসরাইলি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার জন্য চাপ দেবে।

এদিকে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বারো বলেছেন, ইসরাইলের ‘অন্ধ সহিংসতা’ ও মানবিক সহায়তার অবরোধ শেষ হওয়া উচিত।

সোমবার ২৪টি দেশ, যাদের বেশিভাগই ইউরোপের, একটি যৌথ বিবৃতি জারি করে বলেছে, গাজায় বাধাহীন ত্রাণ কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়া উচিত। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্যসহ দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।

ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক ক্যালাস ইইউ-ইসরাইল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তির পর্যালোচনার নির্দেশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি দুই অঞ্চলের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি।

ক্যালাস আল জাজিরাকে বলেন, নেদারল্যান্ডস এ মাসের শুরুতে অ্যাসোসিয়েশন চুক্তির পর্যালোচনা চেয়েছিল, বিশেষ করে ধারা ২, যেখানে বলা হয়েছে, উভয়পক্ষকে মানবাধিকারকে সম্মান করতে হবে।

এ পদক্ষেপকে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পর্তুগাল ও সুইডেনসহ অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র সমর্থন করেছে।

এর পরের পদক্ষেপ কী হবে?

কিংস কলেজ লন্ডনের স্কুল অফ সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র লেকচারার আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার হুমকি অন্যান্য পশ্চিমা সরকারগুলোর জন্য অনুকরণীয় নজির স্থাপন করেছে।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, ‘যদিও এটি ইসরাইলের আচরণের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে না, এটি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনার সীমানা প্রসারিত করবে এবং অন্যান্য সরকারের ক্ষেত্রে ইসরাইলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়া সহজ করে তুলবে।’

তিনি বলেন, ‘তবে ইসরাইলের আচরণে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র। তবুও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরাইলকে ঘিরে যে ঐকমত্য এতদিন ছিল, তা এখন স্পষ্টত ভেঙে পড়ছে এবং এর ফলে ইসরাইল ক্রমশ একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।’

যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত হুসাম জোমলট আল জাজিরাকে বলেন, প্রথম যে কাজটি এই তিন দেশ করতে পারে তা হলো, ইসরাইলের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য কিছু অস্ত্র রফতানি স্থগিত করার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এটি যথেষ্ট নয়। এটি পূর্ণাঙ্গ এবং আরো ব্যাপক হতে হবে।’

জোমলট আরো বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রাষ্ট্রগুলোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আমাদের প্রচেষ্টাকে তাদের অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করতে হবে।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews