অনেক দিবস পালনের ভিড়ে আরেকটি দিন দুর্যোগ প্রশমন দিবস। ১৯৮৯ সাল থেকে অক্টোবরের দ্বিতীয় বুধবার এই দিন উদ্যাপন (?) শুরু হয়। পরে ঠিক হয়, প্রতিবছর অক্টোবরের ১৩ তারিখের দিনটাকেই দুর্যোগ কমানোর জন্য একটা বিশেষ দিন হিসেবে সারা দুনিয়ায় পালিত হবে। দুর্যোগ কমানো না বলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কথা বলাই হবে যুক্তির কথা। একেক বছর একেকটা থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে কথা বলা হয় দিনটিতে। দিবসটি গত হলো গতকাল শুক্রবার।
গত বছরের আলোচ্য বিষয় ছিল ‘লিভ টু টেল’। এর বাংলা কী হবে? জানান দেওয়ার জন্য বাঁচুন? নাকি আপনার কথা বলার জন্য বাঁচুন? অনুবাদকেরা ভালো বলতে পারবেন, কোনটা জুতসই বাংলা হবে বা কোনটা মূল ভাবটাকে বোঝাতে পারবে। সে আরেক তর্ক। তবে প্রাণহানি কমানোর বিষয়টাকে একটু আবেগের রঙে রাঙিয়ে বলার জন্যই বলা হয়েছিল ‘বাঁচুন বলে যাওয়ার জন্য’।
এবার বলা হচ্ছে নিরাপদ গৃহের কথা। গৃহের কাঠামো শক্তপোক্ত হলেই কি তা নিরাপদ হয়? অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ২৪ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষ চলতি বছরে নিজের দেশেই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষ শুধু তার নীড়টা হারায় না, সে তার জীবিকাও হারায়। এক জায়গা থেকে উচ্ছেদ হয়ে আরেক জায়গায় ঘর পাতা যে কী কঠিন, তা ভুক্তভোগীমাত্রই বুঝবেন।
বাড়ি বদলের অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরাও কিছুটা বুঝবেন। ধরেন, এমন জায়গায় আপনাকে বাসা বদল করে চলে যেতে হলো, যেখান থেকে আপনার কাজের জায়গার দূরত্ব অনেক। আপনার সন্তানদের স্কুলও কাছেপিঠে নেই। নেই চেনাজানা দোকানদার, লন্ড্রি কিংবা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন। নতুন বাসাটা যতই আলো-বাতাস আর কার্পেটে মোড়ানো থাকুক না কেন, আপনার ‘ফাঁপর’ লাগবেই। তাহলে একবার ভাবুন, যে মানুষটি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের চর থেকে ভাসতে ভাসতে সিরাজগঞ্জের চৌহালী বা বেলকুচির কোনো এক অবশিষ্ট চরে হাঁড়িপাতিল, খড়কুটো আর ছেলেমেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি কি আটক না মুক্ত? তাঁর পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটাকে তিনি এই নভেম্বরের প্রাথমিক সমাপনীতে ভূঞাপুরের স্কুলে কীভাবে নিয়ে যাবেন? নাকি তার পড়াশোনা এখানেই শেষ। তাকে তুলে দিতে হবে বাল্যবিবাহের কবলে। বেলকুচির চরে তাঁর জীবিকার কী হবে? ভূঞাপুরের কৃষিশ্রমিক চট করে কি বেলকুচির তাঁতশ্রমিক হতে পারবেন? তাহলে তাঁকে যখন রাষ্ট্র বা কোনো ব্যক্তি অথবা সংস্থা একটা ঘর দেবে, তখন সেটা কোথায় বসাবেন তিনি। কাঠামো যা-ই হোক, অবস্থানটাই মুখ্য। কম মজবুত কাঠামোর হলেও ঘরটি যদি তিনি তাঁর আগের জায়গায়, মানে যেখানে তাঁর কাজ ছিল, জীবিকা ছিল, যেখানে তাঁর ছেলেমেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্যে স্কুলে যেতে পারত, দু-চার ঘর চেনাজানা মানুষ ছিল, সেখানেই তিনি থাকতে চাইবেন। সেখানেই তিনি মনের দিক থেকে বেশি নিরাপদ বোধ করবেন।
যে স্থানচ্যুত হয়নি, উদ্বাস্তু হয়ে ভেসে যায়নি, অন্য চরে অন্য ঠিকানায় তার ঘরটিও কি আমরা নিরাপদ করে গড়ে দিতে পারি? ভুল হলো, আসলে আমরা কে তার ঘর করে দেওয়ার। কিন্তু এই ভুলটাই আমরা হরদম করছি। যার বাড়ি, যাদের বাড়ি, তাদের কেন বানাতে দিই না? কেন তারা পারে না?
২০০০ সালে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব (সব বন্যাই কমবেশি অভূতপূর্ব) বন্যা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বন্যামুক্ত অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চল (যশোর এবং তার আশপাশের দু-একটা জেলা) প্লাবিত হয় চোখের পলকে। বন্যার অভিজ্ঞতামুক্ত এলাকার বেশির ভাগ বাড়িঘর ছিল মাটির। নিমেষে তা ধসে পড়ে। অনেকেই সেখানে ছুটে যান গৃহনির্মাণ কর্মসূচি নিয়ে। যার যেমন তৌফিক, সে তেমন ঘর দেওয়া শুরু করে। শর্তজুড়ে দেওয়া হয় যে ঘরের নকশায় হাত দেওয়া যাবে না। প্রথম এক বছর তো নয়ই। ঘরের মাথায়-কানে-গতরে লিপিবদ্ধ থাকবে দাতা সংস্থার নাম ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঘরদুয়ার দেওয়া শেষ হলে কোনো এক দাতা সংস্থার খেয়াল হয়, এত বড় কাজ, একটা মূল্যায়ন হোক। বড়রা এটা-সেটা বলে পাস মার্ক দিলেও শিশুরা এসব ঘর নিজেদের বাড়ির অংশ বলে মানতেই রাজি না। তাদের কথায় ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’-জাতীয় অভিযোগ ছিল। প্রথমে তাদের ‘পাগলা ফটিক’ মনে হলেও তাদের যুক্তি ছিল অকাট্য। কাগজে এঁকে দেখাল তাদের কেমন বাড়ি চাই—কেমন ঘর ছিল তাদের। প্রত্যেকে কাগজেই ঘরের সঙ্গে একখণ্ড বারান্দা আঁকে শিশুরা। বলে, এটাই আমাদের ঘর। বারান্দা দেখিয়ে বলে এখানে আমরা খেলা করি, পড়ি, গরমের দিনে ঘুমাই, বসে দেখি বৃষ্টি। তোমাদের ঘরে কোনো বারান্দা নেই। কোথায় বসি? কোথায় খাই? তোমরা আমাদের ঘর কেড়ে নিয়েছ। তার মানে তাদের শৈশবও হারিয়ে গেছে। দাতাদের ঘরের জঙ্গলে এ কেমন নিরাপত্তা? এ কোন নিরাপদ আবাস?
প্রবীণ মানুষদের ঘর দেওয়া হয়েছিল আইলার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। বেশির ভাগই ছিল বুড়োবুড়ির সংসার। অনেকের সঙ্গে জলে ভেসে যাওয়া পুত্রের অনাথ নাবালক-নাবালিকা নাতিপুতি থাকে। পিতামহ-মাতামহের পিতা-মাতার দায়িত্ব পালন আরেক কঠিন কাজ। যা হোক, শিশুদের যেমন বিশেষ চাহিদা আছে, সব বয়সের মানুষেরই তেমন ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা থাকা বিচিত্র নয়। যারা প্রতিবন্ধী, তাদের ঘরদরজা দেওয়ার সময় আর পাঁচটা ঘরদরজার পার্থক্য থাকতে হবে। কথায় কথায় সাহস করে এক প্রবীণ নারী বলেই ফেললেন, ‘এই ঘরে আমাদের খুব অসুবিধা। একটা দরজা, কেমনে কী করি।’ ১০ ফুট বাই ১২ ফুট ঘরে দুটো দরজা বড় বেমানান হবে। ঠিকাদারের ভাষায়, খরচ বেড়ে যাবে। কিন্তু তার তো দুটো দরজা না হলে চলে না। রাতে বাইরে যাওয়ার সময় (প্রক্ষালনকর্ম) দরজা খুলে ঘুরে আবার ঘরের পেছনে (যেখানে ল্যাট্রিন আছে) আসার নানা হ্যাপা। ঝড়বৃষ্টি আছে, রাত-বিরাত আছে। প্রবীণ নারী আরেক অসুবিধার কথাও বলেছিলেন। তাঁর চার মেয়ে। সবারই বিয়েশাদি হয়েছে। ধারে-কাছের গ্রামেই থাকে সবাই। প্রায়ই মেয়েরা দরদ করে তাদের স্বামীদের পাঠায় মা-বাবার ‘খবর পুচ-কাচ’ করতে। তারা এসে দরজার সামনে শ্বশুরের সঙ্গে বসে পান খায়, কথা বলে। প্রবীণা তাদের ডিঙিয়ে ঘর থেকে আর বেরোতে পারেন না। আটকে থাকেন ঘরে। পেছনে একটা দরজা থাকলে তিনি হাতের কাজগুলো সারতে পারতেন। নিরাপদ গৃহকোণের কতই-না অ্যাঙ্গেল? কে তার হিসাব রাখে।
সাইক্লোন শেল্টারের মজবুত শরীরের চেয়ে মানুষ তার দুর্বল গৃহকোণকে কেন ঝুটঝামেলাহীন নিরাপদ আশ্রয় মনে করে? তার কাছে কাঠামোটাই সব নয়, স্বস্তিটাই বড়। মানুষ যেখানে স্বস্তি পায়, সেখানে সে ‘ফাঁপর’ বোধ করে না। সেটাই তার বাড়ি, সেটাই তার ঘর, সেখানেই সে নিরাপদ।
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়