বাঙালি সমাজে সব সময় সকালবেলার পাখির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (২৫ মে)। আর তিনি দেহান্তরিত হয়েছেন ২৭ (২৯) আগস্ট ১৯৭৬ সালে, অর্থাৎ ৭৭ বছর বয়সে। এর ভেতর তাঁর সচেতন ও সৃষ্টিশীল জীবন ছিল মাত্র ৪৩ বছর। কেননা ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ে (১০ জুলাই ১৯৪২) বাক্শক্তি হারানোর পর থেকে দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি চেতনারহিত জীবন যাপন করেছেন। তবে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তাঁর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ নিয়ে কিঞ্চিৎ মতভেদ আছে। নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশিত (২০১১) নজরুলের হালতক অ্যালবাম ‘দি রেবেল পয়েট’-এ নজরুল গবেষক ইমেরিটাস প্রফেসর রফিকুল ইসলাম লিখেছেন, ২৪ মে তাঁর জন্ম তারিখ, আর ২৯ আগস্ট তাঁর মৃত্যু তারিখ। অন্যদিকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে তাঁর জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালন করা হয় যথাক্রমে ২৫ মে ও ২৭ আগস্ট। প্রখ্যাত নজরুল গবেষক আজহারউদ্দিন খান তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ শীর্ষক আকরগ্রন্থেও ২৪ মে তারিখটিকেই নজরুলের জন্মতারিখ হিসেবে প্রমিত করেছেন। নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থেও এই তারিখ দুটি লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আমরা এর ব্যত্যয় দেখছি। বিভিন্ন সময় পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে কথা বলার সময় আমি বা আমরা প্রায় এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে থাকি। বাস্তব ব্যাখ্যাটি জানা প্রয়োজন।

আসলে এই ভিন্নতা কোনো নজরুল গবেষকের নয়। এটি হচ্ছে ১০০ বছর ধরে বারকয়েক বাংলা বর্ষপঞ্জির পরিবর্তন ও ইংরেজি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে তার সমন্বয় বিধানের ফল। বাংলা একাডেমি বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রমিতকরণ করে ইংরেজি তারিখের সঙ্গে সমন্বয় বিধানের সমস্যাটি স্থায়ীভাবে সমাধান করেছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবেও এটি গৃহীত। এর ফলে নজরুলের বাংলা জন্মতারিখ ও মৃত্যু তারিখ  যথাক্রমে  এক দিন আগে ও দুই দিন পরে গিয়ে ঠেকেছে।

চলমান বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৫ মে, আর ১২ ভাদ্র ২৭ আগস্ট। বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের কবি কাজী নজরুলের জন্ম-মৃত্যু তারিখ যেহেতু সংগত কারণেই বঙ্গীয় সাল অনুযায়ী হওয়া বিধেয়, সেহেতু সেই তারিখগুলো অভিন্ন রেখে তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ইংরেজি তারিখগুলো ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত। সেই বিবেচনা থেকেই এখন প্রতিবছর ২৫ মে ও ২৭ আগস্ট তারিখ দুটি ইংরেজি তারিখ হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত হয়েছে। যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা ও ইংরেজি ক্যালেন্ডারে কোনো হেরফের হচ্ছে না, সেহেতু আমরা প্রতিবছর বাংলাকে অভিন্ন রেখে পরিবর্তিত ইংরেজি তারিখ দুটি ব্যবহারিকভাবে গ্রহণ করেছি। আবার এ-ও মনে রাখা দরকার যে ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জি বাংলাদেশের মতো নয় বিধায় সেখানে ইংরেজি তারিখগুলো আগের মতোই রয়ে গেছে। মূল কথা, নজরুলের জন্ম ও মৃত্যু তারিখ যথাক্রমে ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ও ১২ ভাদ্র (১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) আর বাংলাদেশে তার ইংরেজি প্রতিরূপ ২৫ মে ও ২৭  আগস্ট। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, নজরুলের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ইংরেজিতে উল্লেখ না করে বাংলায় উল্লেখ করলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। ২৫ মে বা ২৭ আগস্ট নয়, ১১ জ্যৈষ্ঠ ও ১২ ভাদ্র আসলে সঠিক, বিতর্কমুক্ত ও সর্বজন গৃহীত।

নজরুলকে নিয়ে নানা সময়ে নানা তর্ক হয়েছে। মৌলিক মানুষ, মুক্ত মানুষ, স্বশিক্ষিত মানুষ, জন্ম-স্বাধীন মানুষ ও পূর্ণাঙ্গ মানবধর্মে দীক্ষিত মানুষ নজরুল। তাঁর জীবনযাপন, আদর্শ, কর্ম, দর্শন, সৃষ্টির বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব বারবার পাঠক, শ্রোতা, দর্শক বা সব শ্রেণির বোদ্ধার মনে নানা অনুসন্ধিৎসার জন্ম দিয়েছে। শতাধিক বছর ধরে বাঙালি নানা পর্যায়ে তাঁকে নিয়ে মেতে আছে, উত্তর খুঁজছে নানা প্রশ্নের। বাঙালি জীবনে ধর্ম-বর্ণ-আচার-কৃষ্টি নির্বিশেষে নজরুল প্রায় সব ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও গোত্রের কাছে প্রায় সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। এককালে তাঁকে যারা কাফের ফতোয়া দিয়েছে আজ তাঁকে তারাই ধর্মীয় ঐতিহ্য ও পুনর্জাগরণের কবি বলতে আপসহীন।  

এ তো গেল মানুষ ও হিতকরী নজরুলের মঙ্গলসত্তাকে ব্যবহারে আমাদের ব্যর্থতার কথা। তার পাশাপাশি আসা যাক নন্দনশিল্পী ও স্রষ্টা নজরুলের ভূমিকায়। ‘বিদ্রোহী’র মতো তুলনারহিত উত্তরাধুনিক টেক্সটের স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও স্বকাল ও উত্তরকালের বিশুদ্ধ নন্দনবাদীরা তাঁর রচনার প্রতি এখনো এক ধরনের উন্নাসিক কটাক্ষ নিক্ষেপ করে থাকেন।

নজরুলের মতো সামাজিক, রাজনৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক তাত্পর্যে ঋদ্ধ কবির প্রয়োজন ফুরায় না কোনো কালে, কোনো সমাজে। আজ আমাদের সমাজে যে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে, সেখানেও নজরুলের ব্যক্তি ও সামষ্টিক ‘আমি’র ধারণা সম্ভাব্য সমাধানের পথ উন্মুক্ত করতে পারে। আমি কোনো বিচ্ছিন্ন আমি নই, আমি সমাজের সব আমি-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক সামষ্টিক আমি। এখানে স্ব্পক্ষ আছে, বিরোধীপক্ষ আছে। বৈপরীত্যকে সর্বাংশে প্রত্যাখ্যান নয়, বরং তার সঙ্গে ইতিবাচকভাবে সহাবস্থানই সামষ্টিক আমি-র অন্বিষ্ট। এটিই গণতন্ত্র। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য। ’ একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এই বৈপরীত্যকে মিলিয়ে রণতূর্যকে বাঁশিতে পরিণত করাই প্রত্যেক গণতন্ত্রীর কাজ। বাংলাদেশের চলমান মানবিক ও গণতান্ত্রিক সংকটে নজরুলের মতো জাতীয় কবির কাছ থেকে এই হচ্ছে আদর্শ অনুপ্রেরণা, এই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত চাওয়া। জাতীয় জীবনের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁর কাছ থেকে আপাত বৈপরীত্যকে মেলানোর এই হিতকরী পাঠ গ্রহণ করতে বাধা কোথায়?

লেখক : কবি



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews