চামড়ার জুতার দাম বাড়লেও চামড়ার দাম কেন কমে? বছর খানেক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নটি ভাইরাল হয়েছিল। অর্থনীতির সূত্র বলে, জুতার দাম বাড়লে চামড়ার দামও বাড়বে। অথচ দেড় যুগ ধরে উল্টো পথে চলছি আমরা। চামড়ার জুতার দাম স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও চামড়ার দাম গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে। মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। অথচ শতভাগ ভ্যালু অ্যাডিশন (মূল্য সংযোজন) করা এই দেশীয় সম্পদটির মূল্য বাড়ার কথা ছিল।
এক পিস গরুর চামড়া থেকে গড়ে ২০ কী ২২ বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এ দিয়ে অন্তত ৪ থেকে ৫ জোড়া চামড়ার জুতা বা সু তৈরি করা সম্ভব। এক জোড়া সু গড়ে ৩ হাজার টাকা ধরলে উৎপাদিত পণ্যের দাম দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় থাকা স্তর গুলোর খরচ বাদ দিলে এক পিস চামড়ার দাম কত হওয়া উচিত? বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো দাম পাওয়া গেছে এবার। কিন্তু দাম না পাওয়া নিয়ে মৌসুমী ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাহাকার ছিল সর্বত্র।
চামড়ার দাম নিয়ে প্রতি বছরই এমন কেন হয়? সংকটটা আসলে কোথায়? প্রধান সংকট লবণে, পরেরটি বেঁধে দেওয়া দামে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিক প্রসঙ্গটি টেনে বলেছে, লবণ রেখা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি বর্গফুট লবণ দেওয়া চামড়ার দাম ঘোষণা করে। অথচ গ্রামেগঞ্জে কিংবা শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় এক কোটি মৌসুমী ব্যবসায়ীরা শোনেন শুধু চামড়ার দাম। তারা লবণের বিষয়টি ভুলে যান। এজন্য সরকারের উচিত হবে লবণ দেওয়া ও লবণ ছাড়া চামড়ার আলাদা দাম ঘোষণা করা।
আবার, এসব মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় ক্যাডার। অনেক তরুণ শখের বশে কিংবা সাময়িক বেকারত্ব ঘুচাতেও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আগে চামড়ার ভালো দাম পাওয়ায় রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকা ফরিয়াদের কাছে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা অনেকটা জিম্মি ছিল। অব্যাহতভাবে চামড়ার দাম কমে আসা ও অন্যান্য ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়ায় পাড়া-মহল্লাভিত্তিক এসব মৌসুমী ব্যবসায়ী এখন কমে গেছে।
বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাই এখন কোরবানির চামড়ার প্রধান সংগ্রহকারী। এর বাইরে অন্য ব্যবসার কিছু মানুষ আছেন যারা এই সময়ে এসে চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। মাদ্রাসাগুলোতে যেহেতু বেশির ভাগ চামড়াই কোরবানিদাতারা দান করে দেন, সেহেতু তাদের সঙ্গে দাম নিয়ে অতটা বেগ পেতে হয় না আড়তদার ও ট্যানারি মলিকদের। সমস্যাটা বাধে মূলত মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ঘিরে। এরা যখন দাম না পাওয়ার কথা তুলেন, তখন মাদ্রাসাগুলোও তাদের বঞ্চনার কথা গোপন রাখে না। প্রায় এক কোটি মানুষের কথা সমাজের আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনি হয়। যা বড় করে আমাদের কানে শোনায়। তবে, দামের টানাটানিতে চামড়া নষ্ট হওয়ার উপক্রম হওয়ায় বাধ্য হয়েই স্বল্প দামে চামড়া ছেড়ে দেন বিক্রেতারা।
এখানে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের মধ্যে সিন্ডিকেট অস্বীকার করা যাবে না। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের বাদ দিলে তারাই অতীতে একে অপরের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেটের অভিযোগ করেছেন। মাঠের একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সেই দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছিল। এ বছরই হয়তো সামনে দেখা যাবে লবণযুক্ত চামড়া কেনা নিয়ে দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন। চামড়ার দাম কমার পেছনে তাদের জোটবদ্ধতা খতিয়ে দেখা উচিত। অথচ সরকারগুলো এখানে হাত দিতে চায় না কিংবা দিতে সাহস করে না।
বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসাকে সরকার এবার বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ দিয়েছে। তবে অভিজ্ঞতা কম থাকায় সেই লবণ তারা সময়মতো লাগাতে পারেনি। যেহেতু মাদ্রাসাগুলো চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে, সেহেতু তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনার প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। এতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে চামড়াখাতের একজন সফল উদ্যোক্তাও হতে পারবে। বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান তৈরিতেও ভূমিকা রাখবে।
এবারে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সোয়া এক কোটি। কাঁচা চামড়ার বাজার দাঁড়াতে পারে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার। যদিও গত বছরের তুলনায় এবারে কোরবানি হয়েছে কম। চামড়ার লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে না বলে শোনা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে চামড়ার দাম কমা নয় রবং সামনের দিনগুলোতে বাড়বে। যারা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেছেন, তারা হয়তো ভালো দাম পাবেন তখন।
রপ্তানির সুযোগ দেওয়ায় চামড়ার দাম বাড়ার সম্ভাবনা ছিল এবার। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বার্তা দিচ্ছেন, বেশি পরিমাণে ওয়েট ব্লু বা পশম ছাড়ানো কাঁচা চামড়া রপ্তানির সক্ষমতা তাদের নেই। এর ফলে ভালো দাম পাওয়ার যে সম্ভাবনার কথা বলছিলাম, সেটি নাও হতে পারে। যথাযথ দাম নিশ্চিতে সরকার চাইলে ট্যানারিগুলোর সক্ষমতা যাচাই করে দেখতে পারে। ১৯৯০ সালের পর এ বছরই বাংলাদেশ থেকে ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হলো। এর আগে ২০২১ সালে কেস টু কেস ভিত্তিতে সীমিতভাবে এক কোটি বর্গফুট রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
কাঁচা চামড়ার দাম না বাড়ার আরেকটি বড় কারণ, এই শিল্পের পরিবেশগত কমপ্লায়েন্স সমস্যা। দূষণমুক্ত পরিবেশসম্মত চামড়া প্রস্তুত হয়েছে মর্মে ইউরোপের লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) সনদ দেয়। স্বাধীনতার এত বছরেও এই সনদ আমরা পাইনি। যে কারণে ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে চামড়া রপ্তানি করতে হয়। সনদ না পাওয়ার সমস্যা আমাদের পুরোনো। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতেই পারে ২০১৩ সালে যেখানে ৮৫ থেকে ৯০ টাকা বর্গফুট ছিল গরুর চামড়া সেটা কেন ২০২০ সালে ৩৫ টাকায় নেমে গিয়েছিল?
সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগসাজশেই এমনটা হয়েছে বলে ধারণা। ওখানেই নতুন সরকারকে হাত দেওয়া উচিত। সেটা না করে এবারও অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পুরোনো দৃশ্য। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে দাম বেঁধে না দিয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়াই উত্তম। ক্রেতা-বিক্রেতাই ঠিক করবে দাম কত হবে। সরকার শুধু যথাযথ ও নিরপেক্ষ নজরদারি করবে। উন্মুক্ত দামের পক্ষে ট্যানারি মালিকদেরও সম্মতি আছে।
চামড়ার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে পারলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বল্পদামে গরুর মাংস খাওয়ানো সম্ভব। একটি গরুর মূল অর্থনৈতিক সম্পদ হওয়া উচিত চামড়া। অথচ ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় সেই দাম গিয়ে পড়ে মাংসের ওপর। এতে মাংসের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অথচ প্রতিবেশী কলকাতা শহরে ঢাকার চেয়ে অর্ধেক দামে গরুর মাংস মিলে।
অসৎ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা এবং সরকারের ভুল নীতির ফলে চামড়ার দামের যে সংকট প্রতি বছর তৈরি হয় তা কাটাতে সবাইকে এক সঙ্গে এক টেবিলে বসে কাজ করতে হবে। সরকারের প্রাধান্য দিতে হবে জনগণ ও অর্থনীতির সমৃদ্ধিকে। দায়িত্বশীল পদে বসে চামড়া সংগ্রহকারীদের তিরস্কার কিংবা ব্যবসায়ীদের পক্ষ নেওয়ার মত মনোভাব পরিহার করতে হবে। না হলে জনগণের কাছে যে বার্তা যাবে তা চামড়ার বাজারকে অস্থিতিশীলই করবে।