ঝামেলামুক্ত, আরামদায়ক এবং তুলনামূলক নিরাপদ হওয়ায় রেল ভ্রমণে যাত্রীদের আগ্রহ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাংলাদেশ রেলওয়ে ১০ কোটির বেশি যাত্রী পরিবহন করেছে। সড়কপথে যানজট ও পথে পথে বিড়ম্বনা দুর্ঘটনায় মানুষ রেল যাতায়াত পছন্দ করেন। যাত্রীদের আগ্রহ থাকায় রেলওয়ের যে সেবাটুকু দেয়ার কথা তা এখনো দিতে পারছে না।
কমলাপুর বাংলাদেশের প্রধান ও বৃহৎ রেলওয়ে স্টেশন। কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের কাজ সম্পূর্ণ এবং চালু হলে কমলাপুর রেলস্টেশনের গুরুত্ব বহুলাংশে বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কমলাপুর রেলস্টেশন টিকিট বিক্রয়ে রেলওয়ের বিড়ম্বনার শেষ নেই। অনলাইনে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা চালু হলেও রেলযাত্রীদের মধ্যে কোনো স্বস্তি নেই। নিমেষে অনলাইনের টিকিট উধাও। এখনো কালোবাজারির দখলে রেলওয়ের টিকিট। তার পরও রেলওয়ে লোকসান প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের দাবি করে থাকে।
অনিয়ম ও দুর্নীতি, চুরি, লুটপাট, জালিয়াতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে আজও রেলওয়ের সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেণীর রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অহরহ রেলওয়ের জায়গা-সম্পওি, মালামাল, যন্ত্রাংশ ও জিনিপত্র চুরি হয়ে থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, রেলইঞ্জিনের ৩২টির ৫০ লাখ টাকার মালামাল উধাও । এমনকি চালুর আগে চট্টগ্রামের রেলওয়ে পোর্টস গুডস্ ইয়ার্ডে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা নতুন রেলইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যায়। রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার মালামাল এভাবে খোয়া যায়, যা দেখার কেউ নেই। অথচ এখনো রেলওয়ে এককভাবে বেশি সম্পত্তির মালিক।
পৃথিবীর সব দেশে এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতে রেলওয়ে একটি সেবামূলক ও লাভজনক এবং জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশে রেলওয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ের সর্বক্ষেত্রে যেমন টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে ট্রেন ভ্রমণে দেখা যায় টিকিটবিহীন যাত্রীর সংখ্যা বেশি। নিয়োগ থেকে শুরু করে রেলওয়ের নির্মাণ ও মেরামতসহ নানা কাজে জেঁকে বসেছে ভয়াবহ দুর্নীতি। রেলওয়ের লোকসানের অন্যতম কারণ হচ্ছে রেললাইন নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি গড়ে ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে এ কাজে গড়ে যথাক্রমে ৩০ ও ৪০ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে থাকে। এখানে রেলওয়ের উচিত নিজেদের সম্পদ ও সম্পত্তি কঠোরভাবে রক্ষা করা। দুর্নীতি-অনিয়ম প্রতিরোধ এবং তেলের পরিবর্তে ইলেকট্রিক ট্রেন চালুর উদ্যোগ নেয়া। তাহলে রেলওয়েকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
প্রায়ই শোনা যায়, ট্রেন লাইনচ্যুত ও দুর্ঘটনার সংবাদ। এদিকে দক্ষ ট্রেনচালক ও রেলকর্মী তৈরিতে প্রয়োজনে তাদের দেশে-বিদেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে । ট্রেনের সেবা ও সামগ্রিক গুণগত মান আরো বাড়াতে হবে।
একটি স্বাধীন দেশের রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের বেহাল ও দুরবস্থার কথা কোনোভাবে লিখে শেষ করা যাবে না। বর্তমানে যাত্রীসংখ্যার চাপে কমলাপুর রেলস্টেশন দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সকাল ও রাতে যাত্রীদের পক্ষে স্টেশনের অভ্যন্তরে সহজে ঢুকে ট্রেন ধরা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। কারণ প্রধান ফটকের সামনে জটলা; মূলত কমলাপুরজুড়ে হকার, ভিক্ষুক-ফকির ও হেরোইনসেবকরা এই স্টেশনে জটলা পাকিয়ে থাকে। সেই সাথে দরিদ্র যাত্রীদের যত্রতত্র ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। রেলকুলিদের দৌরাত্ম্যে যাত্রীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। সেখানে রেলওয়ে পুলিশের নীরবতা খুব হতাশাজনক। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমল থেকে টিকিটের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির পরও রেলওয়েতে কিছুমাত্র সেবার মান বাড়েনি। ইতোমধ্যে যাত্রীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে রেলওয়েতে গুণগত মান একটুও বাড়েনি।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটির চতুর্দিক সংরক্ষিত না থাকায় হকার, ভিক্ষুক, ফেরিওয়ালা, ছিঁচরে চোর ও হেরোইনসেবীদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবে দমন করা যাচ্ছে না। নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন কমলাপুর স্টেশনকে আধুনিকতার ছোঁয়া দেয়া তেমন কঠিন কাজ নয়। প্রয়োজনে আধুনিক ও সৌন্দর্য বর্ধনে এবং নিয়মের মধ্যে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনকে আনতে জাপান, কোরিয়া বা চীনের কাছে আগামী ১০ বছরের জন্য লিজ দেয়া যেতে পারে। তাতে দুর্নীতি কমবে এবং রেলওয়ের আয় অনেক বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ট্রেনে ওঠানামা করতে বয়স্ক বা অসুস্থ এবং প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য কোনো কার বা ছোট গাড়ি নেই। সেই সাথে যাত্রীদের নিরাপত্তা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে খুব নাজুক। এক্ষেত্রে স্টেশনে রেলওয়ে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তবে আজেবাজে লোকজন ও টোকাই, টিকিট কালোবাজারিদের ঘুরাঘুরি গোটা কমলাপুর রেলওয়ে কর্মচারীদের কাছে যাত্রীরা অসহায়। একটি সংঘবদ্ধ চক্র কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকিট বিক্রি নিজেদের কব্জায় রেখেছে। লম্বা লাইন ধরে টিকিট ক্রয় করতে গেলে ঠিক কাউন্টারের সামনে যাওয়া মাত্র বলা হয়ে থাকে টিকিট নেই। যাত্রীদের এ দুর্ভোগ কোনোভাবে কমানো যায় না? টিকিট চাইলে বলা হয় টিকিট নেই। অথচ দালালদের কাছে সব ট্রেনের টিকিট অতিরিক্ত টাকায় সহসাই পাওয়া যায়। স্টেশন মাস্টার বা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কাউন্টারের লোকদের টিকিট ক্রয়ের দুর্ভোগ কখনো দেখতে আসেন না।
নোংরা, অপরিচ্ছন্ন এবং দুর্গন্ধে ভরপুর গোটা কমলাপুর স্টেশন। যাত্রীদের সুবিধার্থে এর পরিধি আরো বাড়ানো সময়ের দাবি। টিকিট কাউন্টারের স্বল্পতায় যাত্রীদের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা বেড়ে চলেছে। টিকিট বিক্রির স্থানে যাত্রীদের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। চেয়ার ও পর্যাপ্ত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। টিকিট ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ কেন্দ্র না থাকায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা। ট্রেনে বিনা টিকিটের যাত্রীসংখ্যা অনেক। তবে এ ক্ষেত্রে ট্রেনের টিটির সহযোগিতায় অ্যাটেনডেন্টদের আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে বিনা টিকিটের যাত্রী উঠানো নিয়ে অহরহ যাত্রীদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করতে দেখা যায়। টিকিট চেকার বা টিটিরা বিনা টিকিটের যাত্রীদের প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। সঙ্গত কারণে কমলাপুর ছাড়াও বনানী, গেন্ডারিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও এয়ারপোর্ট রেলস্টেশন থেকে সব রকম অনলাইন টিকিট ক্রয়ের সুযোগ প্রবর্তন করলে দুর্ভোগ কমবে তাই নয়, সময় বাঁচবে এবং বিড়ম্বনা লাঘব হবে।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটি আধুনিকীকরণ, দুর্ভোগ লাঘবে কাউন্টার বাড়ানো, অপরিচ্ছন্নতা দূর করা, হেরোইনসেবী ও বহিরাগত, কুলি, হকার টিকিট কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।
সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ের সেবার মান বাড়ানো খুব জরুরি। তাই রেলওয়ে মন্ত্রণালয়কে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনটি পরিচ্ছন্ন ও রঙ করার দাবি জানাই। সাথে সাথে চুরি, দুর্নীতি বন্ধ করে রেলওয়ের মানোন্নয়নে ও যাত্রীসেবায় আরো মনোযোগী হতে হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী