এক সময় হাঁস-মুরগি পালন কেবল ঘরোয়া পর্যায়েই সীমিত ছিল। সময় বদলেছে, এটি এখন বাংলাদেশের বৃহৎ বাণিজ্যিক বা শিল্প খাত। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পোলট্রি খাত এখন দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১.৫০ শতাংশেরও বেশি; আর সামগ্রিক কৃষিভিত্তিক জিডিপিতে প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি। পোলট্রি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ উপখাত ব্র্রিডার খামার ও হ্যাচারি। গত দুই মাসের বেশি হলো এই দু’টি উপখাত বড় সঙ্কটে পড়েছে। এক দিনের ব্রয়লার, লেয়ার এবং কালার জাতের মুরগির বাচ্চার লাগাতার দর পতনের ফলে হাজার হাজার খামার ও হ্যাচারি এখন আর্থিক ক্ষতির মুখে। এই খাতে গত দুই আড়াই মাসে ৫৩০ কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছেন খামারিরা। আর পুরো পোলট্রি খাতে মোট ক্ষতি বা লোকসানের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের পোলট্রি খাত বড় হয়েছে।
৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি মার্কেট হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তবে, এখাত এখনো স্থিতিশীল হয়নি।
খামার মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে দুই-তিন ভাগ কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে হচ্ছে, অথচ উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। এখনই সরকার কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পোলট্রি শিল্পের মূল ভিত্তি ভেঙে পড়তে পারে। যার প্রভাব পড়বে ডিম ও গোশতের বাজারে। হুমকির মুখে পড়তে পারে দেশের সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তা।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) জানিয়েছে, গত এপ্রিল ও মে মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ টাকা, যা মে মাসের শেষে নেমে এসেছে ৮-১০ টাকায়। অথচ সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য ছিল ৫৮ টাকা। লেয়ার বাচ্চার দাম ছিল গড়ে ৪৭ টাকা, যেখানে সরকার নির্ধারণ করেছে ৫৭ টাকা। কালার জাতের বাচ্চার দাম ছিল ১৫-২০ টাকা, যা উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম। চলতি জুন মাসেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
বিএবি সভাপতি মাহাবুবুর রহমান বলেন, বর্তমানে যে হারে বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে, তাতে প্রতি সপ্তাহে আমাদের কয়েক কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। দুই মাসে শুধু ব্রয়লার বাচ্চাতেই লোকসান হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকা। এটা আর শুধু ব্যবসায়িক সমস্যা নয়, কৃষিভিত্তিক শিল্পের জন্য বড় হুমকি। এ ছাড়া গত বছরের জুন-অক্টোবর মাসেও হিটস্ট্রোক, অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে খাতটি লোকসান গুনেছে প্রায় ৪১৭ কোটি টাকা।
সঙ্কটে পড়ে গাজীপুর, চট্টগ্রাম, জয়পুরহাট, নওগাঁ, কুমিল্লাসহ দেশের নানা প্রান্তে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তরা তাদের খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। কারণ, বাচ্চা কম দামে কিনলেও পরে বিক্রি করে লাভ করা তো দূরের কথা, মূলধনও মিলছে না। শুধু জয়পুরহাটেই গত তিন মাসে বন্ধ হয়েছে ১২০টির বেশি ছোট খামার।
খামারিদের মতে, ব্রিডার খামার ও হ্যাচারি হলো দেশের ডিম ও গোশত উৎপাদনের প্রথম ধাপ। এগুলো ভেঙে পড়লে পুরো পোলট্রি চেইনে ধাক্কা লাগবে। গাজীপুরের হ্যাচারি মালিক আবদুস সামাদ বলেন, একটা হ্যাচারি বন্ধ হলে শুধু মালিক নয়, তার অধীন শতাধিক খামার, শ্রমিক, সরবরাহকারী- সবাই বিপদে পড়ে। এই বাস্তবতা বুঝতে হবে নীতিনির্ধারকদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বাচ্চার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে; কিন্তু বাজারে সমপরিমাণ চাহিদা বাড়েনি। তার ওপর রয়েছে গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ ও রোগবালাইয়ের ভয় তো। ফলে খামারিরা নতুন বাচ্চা তুলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
২০২৩ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ব্রয়লার বাচ্চার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যনির্ধারণ করেছিল ৫৩ টাকা। গত এপ্রিলে ব্রিডার ও হ্যাচারি মালিকরা মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্রয়লার বাচ্চার দাম ৬০ টাকা এবং লেয়ার বাচ্চার দাম ৬৫ টাকা (ভ্যাকসিন ছাড়া) নির্ধারণের দাবি জানায়। তবে এখন পর্যন্ত সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে গত ১৮ মে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (বিএবি) চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে অংশীজন নিয়ে সমন্বয় সভা করার আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি।
জানা যায়, দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে পোলট্রি। প্রায় ৮০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এ খাতে। প্রাণিজ প্রোটিনের প্রায় ৪০ শতাংশ আসে পোলট্রি থেকে। ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাজার পোলট্রি খাতে। কিন্তু এখনো স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হয়নি এ খাতে। সাধারণত মনে করা হয় পোলট্রির চাহিদা ও জোহানের স্বাভাবিক ভারসাম্যহনীতা এ খাতের সংকটের কারণ। কিন্তু গভীরে গেলে এর পেছনে আরো একাধিক কাঠামোগত সমস্যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে সঠিক চাহিদা নিরূপণ না করে অপরিকল্পিত উৎপাদন। ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন বলছে, দেশে প্রতি সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা প্রায় এক কোটি ৭০ লাখা। অথচ উৎপাদন হচ্ছে প্রায় দুই কোটি। সোনালি ও রঙিন জাতের বাচ্চাসহ মোট উৎপাদন দুই কোটি ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে। অতিরিক্ত উৎপাদন প্রায় ৪০-৪২ লাখ বাচ্চা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সমন্বিত জাতীয় উৎপাদন পরিকল্পনার অভাবেই এই অতিরিক্ত বাচ্চা উৎপাদন বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
লাগামহীন ফিডের উৎপাদন খরচ
পোলট্রি ফিডের প্রধান দু’টি উপাদান ভুট্টা ও সয়াবিন। দুটোই বলা চলে আন্তর্জাতিক বাজার নির্ভর। এর মধ্যে দেশে ভুট্টা উৎপাদন বাড়লেও সয়াবিন নিয়ে তেমন আশার খবর নেই আপাতত। আন্তর্জাতিক কৃষি সংস্থা এফএও এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডলারের উচ্চ বিনিময় হার এবং বৈশ্বিক কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফিডের খরচ ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে উচ্চ আয়কর ও টার্নওভার কর এবং পরিবহন ও বিতরণ ব্যবস্থার উচ্চ ব্যয়- যা খামারিদের জন্য উৎপাদন ব্যয় বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
মধ্যস্বত্বভোগীর পেটে অতিরিক্ত লাভ
জানা যায়, খামারিরা কখনো কখনো ১০-১৫ টাকায় একটি মুরগির বাচ্চা ক্রয় করতে পারলেও প্রতি কেজি ফিডের দাম ৩-৪ টাকার বেশি কমেনি। ফিডের কাঁচামাল-বিশেষ করে সয়াবিন মিলের দাম কিছুটা কমলেও ভুট্টার দাম বিগত এক বছর ধরে ৩০ টাকার আশপাশেই রয়েছে। ফলে ফিডের বাজার আশানরূপ কমেনি। অন্য দিকে ব্রয়লাল, সোনালি ও রঙিন জাতের মুরগির দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এতে বড় বড় করপোরেট হাউজের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের খামারিরাও মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছেন। ডিমের বাজারেও একই অবস্থা। পোলট্রি ভ্যালু চেইনের এক প্রান্তে খামারিরা চরম সঙ্কটওে থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগী বিশেষ করে হোলসেলার ও খুচরা বিক্রেতারা এই সুযোগে অতিরিক্ত লাভ তুলে নিচ্ছে বলে অভিযোগ। খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম ও ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা দমের ব্যবধান ২০-৩ টাকার মধ্যে থাকার কথা হলে ৪০-৬০ টাকা পর্যন্ত এই ব্যবধান। এ ছাড়াও প্রতি কেজি ফিডে ডিলারদের কমিশন ৪-৫ টাকার মধ্যে সীমিত থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। যার ফলে খরচের খামারির ওপর গিয়ে পড়ছে।
পোলট্রি খাতের আরেক সমস্যা বৈরী আবহাওয়া ও বহুমুখী রোগের প্রাদুর্ভাব। খামারিরা বলছেন, গত ছয় মাসে খামারগুলোতে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রচলিত ভ্যাকসিন এই রোগ প্রতিরোধে কার্যকর হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ব্যাপক পরিবর্তন এই সঙ্কটকে আরো তীব্র করে তুলছে। খামারিদের ভাষায় শুধু এপ্রিল-মে মাসেই ৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত মুরগি নানা রোগে মারা গেছে।
এই খাতে আরেকটি ভুল ধারণা রয়েছে ‘সেটা হলো চাহিদা কমলে দাম কমবেই’। কিন্তু পোলট্রি শিল্পের বর্তমান সঙ্কট শুধু কোনো সাময়িক চাহিদাভিত্তিক মন্দা নয়। বরং এটি একটি গভীর অবকাঠানোগত সঙ্কট। যখন কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্কারোপ করা হয়, রিটেইল ও হোলসেল বজার একটি নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী থাকে এবং যখন সরকারের পরক্ষ থেকে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পিত উৎপাদন নীতিমালা থাকে না- তখন তাকে ‘স্বাভাবিক’ বাজার চক্র বলা যায় না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো: আবু সুফিয়ান নয়া দিগন্তকে বলেন, শীতকালে পোলট্রির চাহিদা বেশি থাকে। এই সময়ে একটু কম। এর উপর আবার ক’দিন আগে ঈদুল আজহা গেল। ফলে পোলট্রির বাজার কমেছে। পোলট্রি খাতের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় আমরা একটি নীতিমালা করতে যাচ্ছি।
অতিরিক্ত বেশি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের কারণে দাম একেবারে কমে গেছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, হয়তো কিছুটা হয়েছে।