ব্যানবেইসের তথ্যমতে, দেশের ২৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা হয়নি। আবার অনেক জায়গায় বিজ্ঞানাগার থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। ছবি: এআই
ব্যানবেইসের তথ্যমতে, দেশের ২৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা হয়নি। আবার অনেক জায়গায় বিজ্ঞানাগার থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। ছবি: এআই
বাংলাদেশে শিক্ষা খাতের পরিকাঠামোগত প্রসারে একদিকে যখন শহুরে অঞ্চলে একের পর এক আধুনিক স্কুল-কলেজ গড়ে উঠছে, অন্যদিকে দেশের মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞান শিক্ষায় নেমেছে চরম দুর্দশা। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা, রাজনৈতিক প্রভাব ও তদবিরের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত হওয়া বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে, অথচ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন কাঠামো ঠিকই বহাল রয়েছে। এই অসামঞ্জস্যতা কেবল সরকারি অর্থের অপচয়ই নয়, বরং একটি প্রজন্মের সম্ভাবনা ধ্বংসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এ অবস্থার অবসান না ঘটালে মফস্বলে বিজ্ঞান শিক্ষার নীরবে মৃত্যু ঘটবে এবং বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের স্বপ্ন স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রসারে ‘এমপিও’ (Monthly Pay Order) একটি সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান করে সরকার। তবে এক সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক তদবির, ভুয়া তথ্য বা অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছিল, আজ সেসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রয়োজনীয় মানদণ্ডের নিচে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ২০২১ সালের সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী, মফস্বলের কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ চালাতে হলে ন্যূনতম ২০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এসব প্রতিষ্ঠান যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন চোখে পড়েনি। এই অবস্থার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, ইউনিয়ন পর্যায়ের অনেক কলেজ ও মাদ্রাসার বিজ্ঞান বিভাগ শিক্ষার্থী শূন্য কিংবা একেবারে সীমিত। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ৫-৭ জন শিক্ষার্থী, বড়জোর ১৫ জন নিয়ে চলছে পাঠদান। অথচ শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৮ জন বা তারও বেশি। তাদের বেতন-ভাতায় সরকারের প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে কয়েক লক্ষ টাকা। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় অব্যাহত থাকলেও, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যকর কোনো হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) এক তথ্যমতে, দেশের ২৯ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনও বিজ্ঞানাগারই স্থাপন করা হয়নি। আবার অনেক জায়গায় বিজ্ঞানাগার থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার নেই বললেই চলে। শিক্ষকরা নিজেরাও অনেক সময় যন্ত্রপাতির নাম পর্যন্ত জানেন না। ব্র্যাকের গবেষণা অনুযায়ী, বেশিরভাগ মফস্বল এলাকায় বিজ্ঞানাগার নামমাত্র থাকলেও সেগুলোর কার্যকারিতা একেবারেই নেই।
বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে বহুমাত্রিক কারণ। এর একটি প্রধান কারণ ক্যারিয়ার সচেতনতার অভাব। মফস্বলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক বিজ্ঞান শিক্ষার ভবিষ্যৎ গুরুত্ব ও পেশাগত সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত নন। চিকিৎসক বা প্রকৌশলী ছাড়া বিজ্ঞানভিত্তিক অন্য পেশার (যেমন: ডেটা সায়েন্টিস্ট, এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চার, বায়োটেকনোলজিস্ট) কথা জানা দূরের কথা, কল্পনাও করেন না অনেকে।
শিক্ষা-অবকাঠামোর দুর্বলতার কথাও বলতে এর সঙ্গে। বিজ্ঞান বিভাগের জন্য প্র্যাকটিক্যাল ল্যাব অপরিহার্য। কিন্তু মফস্বলের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই নেই আধুনিক ল্যাব বা পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি। প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না থাকলে বিজ্ঞান শিক্ষার স্বাভাবিক বিকাশ অসম্ভব।
বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষাদান করতে হলে যে মানের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দরকার তা অনেক শিক্ষকেরই তেমনটা নেই। আবার যেসব যোগ্য শিক্ষক আছেন, তাদের অনেকেই শহরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মফস্বলে থাকতে চান না। ফলে স্থায়ী শিক্ষক সংকট চলে।
বিজ্ঞান বিভাগে বই, ল্যাব উপকরণ, প্র্যাকটিক্যাল খরচ ইত্যাদি অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বেশি। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এই খরচ বহন করা কঠিন। ফলে তারা মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগে সন্তানকে ভর্তি করাতে আগ্রহী হন।
গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নকে ভয় পায় অনেক শিক্ষার্থী। আবার ফলাফল খারাপ হলে পরিবারের পক্ষ থেকেও আসে নেতিবাচক চাপ। এতে তারা বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নেওয়ার আগেই পিছিয়ে যায়।
মফস্বলের শিক্ষার্থীরা আশেপাশে সফল বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞান শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত কাউকে দেখে না। ফলে বিজ্ঞানকে আকর্ষণীয় মনে হয় না তাদের কাছে।
এর ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ব্যয় হয় এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে, যাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
মফস্বলের বিজ্ঞানের মান ও পরিবেশ অনুন্নত থাকায় শিক্ষার্থীরা শহরমুখী হয় অথবা বিজ্ঞান বিভাগ এড়িয়ে চলে।
জাতীয়ভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার মান নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে–যার প্রভাব ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের বাজারে ও গবেষণাভিত্তিক উন্নয়নে দৃশ্যমান হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কোর্সে যোগ্য শিক্ষার্থী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির জন্য কর্মী সংকট বাড়বে।
মফস্বলে বিজ্ঞান শিক্ষাকে প্রসারিত করতে হলে দরকার হবে সচেতনতা বাড়ানো ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং কর্মশালা, বিজ্ঞান মেলা ও স্কুলভিত্তিক ক্যারিয়ার গাইডলাইন চালু করা দরকার। মাধ্যমিক পর্যায়ে সফল বিজ্ঞানী ও পেশাজীবীদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময়ের সুযোগ করে দিতে হবে। সফল বিজ্ঞানীদের গল্প তুলে ধরা উচিত টেলিভিশন ও সামাজিক মাধ্যমে। মাধ্যমিক পর্যায় থেকেই সচেতনতা বাড়াতে পারলে উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী বাড়বে।
প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান শিক্ষার সাহায্য নেওয়া যায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভার্চুয়াল ল্যাব, অনলাইন সিমুলেশন টুলস, ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রতিটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত মনিটরিং চালু করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগ কার্যকর নয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রত্যেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ল্যাবরেটরি স্থাপন ও আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহে বাজেট বরাদ্দ করা জরুরি। মানসম্মত বিজ্ঞানাগার স্থাপন এবং পুরনো যন্ত্রপাতি সচল করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে। সম্ভব না হলে ডিজিটাল ল্যাব বা ভার্চুয়াল বাস্তবতা নির্ভর অনুশীলন পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ সনদ থাকা উচিত। সেই সঙ্গে কর্মরত শিক্ষকদের বার্ষিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনা উচিত। প্রতি তিন বছরে একবার শিক্ষক পুনঃপ্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বিজ্ঞানকে সহজ ও জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে শেখানোর কৌশল, হাতে-কলমে শিক্ষার পদ্ধতি শেখাতে হবে।
বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সায়েন্স স্কলারশিপ’ নামে বিশেষ বৃত্তি চালু করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করলে অতিরিক্ত উপবৃত্তির সুযোগ রাখা যেতে পারে।
স্থানীয় সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধানে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। গ্রামীণ জনজীবনে বিজ্ঞান কিভাবে ব্যবহার করা যায় (যেমন: কৃষি প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, পরিবেশ রক্ষা)–এসব শেখানোর মাধ্যমে বিজ্ঞানকে বাস্তব ও উপযোগী করে তুলতে হবে।
অতিরিক্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষক হ্রাস ও পুনর্বিন্যাস করতে হবে। যেমন যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নেই, সেখানে শিক্ষক-কর্মচারী কমিয়ে সমন্বিতভাবে পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করা যেতে পারে। অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল করে বাজেট সাশ্রয় করে সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পুনর্বিনিয়োগ করা উচিত।
মফস্বলে বিজ্ঞান শিক্ষার এই বিপর্যয় কেবল একটি শিক্ষাগত সংকট নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি অন্ধকার দিগন্তের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আজ যদি আমরা বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নে সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তবে আগামী দশকে আমাদের দেশের প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সরকার, অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসন এবং সামাজিক সংগঠন–সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষাকে এই দুরবস্থা থেকে টেনে তোলা সম্ভব নয়। বিজ্ঞান মানে শুধু একটি বিষয় নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি– যেখানে প্রশ্ন করার, জানার, অনুসন্ধান করার মনোভাব থাকে।
বিজ্ঞান শিক্ষাকে অবহেলা করা মানে একটি জাতিকে তার সম্ভাবনার বিরুদ্ধেই দাঁড় করানো। বিশ্বায়নের এই যুগে বিজ্ঞান শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতিই টিকে থাকতে পারে না। মফস্বলে বিজ্ঞান শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় উন্নয়নের রূপরেখায় যুক্ত করার এখনই সময়।