ইসরাইল গত ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ কারখানা এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিদের অবস্থানে হামলা করে। ‘অপারেশান রাইজিং লায়ন’ নামের এই হামলায় ইরানের সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান হোসেইন সালামি এবং একাধিক শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মারা যান। ইরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে না পারে তার জন্যই নাকি এই হামলা। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতই ইসরাইলকে সমর্থন করে। ইরান পরবর্তীতে ‘ট্রু প্রমিজ-ত্রি’ নামে ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালায়। এভাবে হামলা-পাল্টা হামলা চলে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গত ২১ জুন ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইস্পাহানে হামলা করে। প্রতিক্রিয়ায় কাতার এবং ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ২৪ জুন ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি হয়। এতে বিশ্ববাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইরানে হামলার সুদূরপ্রসারী দুটো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, ইরানের পরমানু প্রযুক্তি ধ্বংস করা, দ্বিতীয়ত, ইরানের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন। এসব বাস্তবায়ন করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের বিরোধীতাকারী এবং প্রতিপক্ষ থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল হয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের একক নিয়ন্ত্রক। কিন্তু ইরানের দৃঢ়তা এবং পাল্টা আক্রমণে ইসরাইল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা সফল হয়নি। মূলত ইরানে আগ্রাসন ইসরাইলের জন্য বুমেরাং হয়েছে।
ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ১৯৭৯ সালে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ চলছে। ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দেশটি পারমাণবিক বোমা বানানোর চেষ্টা করছে। ইরানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র নাকি বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি। ইরান যদিও বার বার বলছে, তার পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ তবু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল তা মানে না। পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছে। ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগের আহ্বান জানিয়ে বলেছে, পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ না করলে সামরিক হামলা চালানো হবে। যুক্তরাষ্ট এবং ইসরাইল জাতিসংঘের মাধ্যমে ইরানের বিরদ্ধে একাধিকার অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। ইরান বরাবরই দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে, এটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং হুমকি, অবরোধ ও চাপের মুখে পরমাণু কর্মসূচি বাতিল করবে না। এভাবে পরমাণু ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরাইলের বাকযুদ্ধ চলছে। এ রকম পরিস্থিতিতে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা করে। অথচ, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অনেক আগে পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে, পারমাণবিক বোমার বিরাট মজুদ গড়ে তুলেছে এবং ১৯৪৫ সালে জাপানে পারমাণবিক বোমা হামলা চালিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিরোধিতার প্রকৃত কারণ : মুসলিম দেশসমূহ জ্ঞানবিজ্ঞানে এবং সামরিক প্রযুক্তিতে দক্ষতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুক, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা তা চায় না। ইরানের মতো একটি ইসলামপন্থী, জাতীয়তাবাদী এবং পাশ্চাত্যবিরোধী মুসলিম দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকুক, তা পশ্চিমা বিশ্ব কিছুতেই মানতে পারে না। কারণ, এর ফলে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্য এবং আধিপত্য হুমকির মুখে পড়বে। তারা চায় মুসলিম দেশসমূহ চিরদিনই অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ এবং জ্ঞানবিজ্ঞান, সামরিক প্রযুক্তিতে তাদের উপর নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী থাকুক। পশ্চিমারা চায় জ্ঞানবিজ্ঞান এবং সামরিক প্রযুক্তির দক্ষতা কেবল তাদের হাতেই থাকুক এবং এর মাধ্যমে বিশ্বকে চিরদিন শাসন করুক। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র কোনো মুসলিম দেশকে সামরিক প্রযুক্তি এবং সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী হতে সাহায্য করে না। পাকিস্তান পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ করলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এর বিরোধিতা এবং একে ইসলামিক বোমা নামে অভিহিত করে। অথচ, ভারত পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ করলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা চুপচাপ ছিল এবং বিরোধিতা করেনি। একইভাবে ইসরাইলের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের অভিযোগ নাই, বরং সহযোগিতা আছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে পশ্চিমারা যতটাই সরব, ইসরাইলের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ততটাই নীরব। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা এখানে বরাবরই দ্বিমুখী নীতি পালন করছে।
ইসরাইলের এই সময়ে ইরানে হামলার কারণ: মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানের বিরাট প্রভাব থাকলেও, তা বর্তমানে কিছুটা হলেও কমেছে। ইসরাইলের লাগাতার সামরিক হামলায় ইরান সমর্থিত হামাস, হিজবুল্লাহ অনেক দুর্বল হয়েছে। ইসরাইলি হামলায় হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াসহ হামাসের অনেক শীর্ষ নেতা এবং হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ অনেক নেতা মারা যায়। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। অপরদিকে সিরিয়া ছিল ইরানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র। সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে আসাদের পতনে সিরিয়া ইরানের হাত ছাড়া হয়ে যায়। হামাস, হিজবুল্লাহ এবং আসাদ সরকার ছিল ইরানপন্থী এবং ইসরাইল বিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই এই অবস্থানকে ইসরাইল সুযোগ হিসাবে লুফে নেয় এবং ইরানে হামলা চালায়।
ইসরাইলের বেপরোয়া আচরণ এবং দম্ভ চূর্ণ হয়েছে: ফিলিস্তিনি ভূমি দখল এবং ফিলিস্তিনিদের দমনে ইসরাইল যা ইচ্ছা তা করে চলেছে। যখন ইচ্ছা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। সাম্প্রতিককালে ইসরাইল গাজার ছাপ্পান্ন হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। ইসরাইল প্রতিদিনই গাজার মুসলমানদের হত্যা করছে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা মানছে না। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং ত্রাণ সংগ্রহে আসা ফিলিস্তিনিদেরও নির্বিচারে হত্যা করছে। ইসরাইল জানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্ব সাথে আছে এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সমর্থন করবে। বাস্তবে সেটাই হচ্ছে। ইসরাইলের অপকর্মের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে উত্থাপিত সব প্রস্তাবেই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করেছে। ফলে ইসরাইলকে কখনো শাস্তি পেতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলকে সবসময় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইসরাইল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ইসরাইল নিজেকে অপরাজেয় এবং ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে করত। সে মনে করত কোনো মুসলিম দেশ তার ভূখ-ে আঘাত করতে পারবে না। সুতরাং সে নিরাপদ। কিন্তু ইরান সে ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছে। বিশ্বসেরা আয়রন ডোম এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলে আঘাত করে এবং ইসরাইল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ইসরাইলের দম্ভ চূর্ণ হয় এবং ইসরাইল স¤পর্কে প্রচলিত ধারণা ভেঙ্গে যায়। অধিক ক্ষতির আশংকায় ইসরাইল ভীত হয়ে পড়ে এবং যুদ্ধ বিরতিতে যায়। যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে বলেই ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধে রাজি হয়। আক্রমণকারী দেশ যখন যুদ্ধ বন্ধ করে, তখন বুঝতে হবে সে পরাজিত হয়েছে।
ইরানের জনগণ আরো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে: ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানী জনগণকে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানায়। কিন্তু তাদের এ আহবানে ইরানী জনগণ সাড়া দেয়নি। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনকে ইরানের অধিকাংশ জনগণ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে চিহ্নিত করে এবং এর মোকাবেলায় দেশটির বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানায়। তারা রাজপথে মিছিল করে এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। আসলে এটাই স্বাভাবিক। কোনো দেশ বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হলে, সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো নেতৃত্বকে জনগণ সমর্থন জানায় এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম জেগে ওঠে। ইরানের বেলায়ও তাই হয়েছে। এভাবে আগ্রাসন ইরানের নেতৃত্বকে শক্তিশালী এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
ইরান এখন পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করবে: ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালায়। তাদের হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় অনেক পরমাণু বিজ্ঞানী মারা যায় এবং ফোরদো, নাতাঞ্জ এবং ইস্ফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব যখন ক্ষমতায় রয়েই গেছে এবং তারা যেহেতু পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর, সুতরাং আগামীতে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি আরো জোরদার করবে। শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন পরমানু বিজ্ঞানী মারা গেলেও ইরানে আরো অনেক পরমাণু বিজ্ঞানী রয়েছেন। ইরান দ্রুত পরমাণু বোমা বানালে অবাক হবার কিছু থাকবে না। ইরান বলবে, সে আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তা রক্ষায় পরমাণু বোমার প্রয়োজনীয়তা আছে। ইরানের এই বক্তব্য অযৌক্তিক নয়। ইরান এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরমাণু বোমা বানানোর কাজে হাত দিতে পারে।
লেখক : প্রকৌশলী এবং রাষ্ট্র চিন্তক।
[email protected]