ইংরেজি সাহিত্যে সর্বকালের সেরা নাট্যকার, কবি, অভিনেতা ও লেখক হিসেবে সমাদৃত ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া উইলিয়াম শেকসপিয়র (১৫৬৪-১৬১৬)। তিনি ১৫৯৯ সালে এককভাবে একজন অভিনেতার জন্য লেখা ‘এজ ইউ লাইক ইট’ নাটকের (মনোলগ) দ্বিতীয় অংশের সপ্তম দৃশ্যের শুরুতে লিখেছেন, ‘সমগ্র পৃথিবী হলো একটি নাট্যমঞ্চ এবং পৃথিবীর সব নারী-পুরুষ (নাটকের) এক একটি চরিত্র মাত্র। তাদের (মঞ্চে) প্রবেশ ও প্রস্থান করতে হয়। এক একটি মানুষ তার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ে নানা চরিত্রে অভিনয় করে।’ শেকসপিয়রের দৃষ্টিতে জীবন নাটক মঞ্চস্থ হয় সাত পর্বে। প্রথমে শিশু এবং দ্বিতীয়তে শিক্ষার্থীরূপে শুরু। এরপর পৃথকভাবে আসে প্রেম ও জীবনসংগ্রাম বা যুদ্ধ। একসময় জীবনযুদ্ধও থামে এবং শুরু হয় পঞ্চম পর্ব। এই পঞ্চম পর্বে মানুষ শান্ত হয় এবং বিচারকের মতো প্রাজ্ঞ ও বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ করে। আবারও শিশুর মতো দাঁত, দৃষ্টিশক্তি, স্মৃতিশক্তি ও স্বাদ নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে ষষ্ঠ পর্বে। শেষ দৃশ্যে বা সপ্তম পর্বে যবনিকা ঘটে ঘটনাবহুল এক জীবন ইতিহাসের।

সব মানুষের জীবন যদি এমন সাত পর্বে পরিচালিত হতো, তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতো। বাস্তবে তা হয় না। আর হয় না বলে মাঝে মাঝেই আমরা হোঁচট খাই, খেই হারিয়ে ফেলি। মনের অজান্তেই প্রশ্ন করি, হচ্ছেটা কী? সম্প্রতি এমনি একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন অবন্তিকা নামের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সদ্য প্রয়াত ছাত্রী। সাত পর্বের জীবন নাটকের দ্বিতীয় পর্বেই (শিক্ষার্থী) স্বেচ্ছায় ও পিতাসম কতিপয় শিক্ষক ও বন্ধুবেশী সহপাঠীর প্রতি ঘৃণায় জীবন নাটকের হঠাৎ যবনিকা টেনেছেন পিতৃহারা অবন্তিকা।

৮ মার্চ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ঘটা করে বিশ্ব নারী দিবস পালিত হয়। এদিন নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর নিরাপত্তা নিয়ে সরব ছিল যাবতীয় গণমাধ্যম। অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একজন নারীকে যে কী প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়, তারই এক কেস স্টাডি যেন অবন্তিকার জীবনের যবনিকা। সহপাঠীর হয়রানির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে অভিভাবক নিয়ে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার না পাওয়া তদুপরি একটি মহলের উসকানিতে দলবদ্ধভাবে তাকে একঘরে করে রাখার মানসিক চাপ সইতে না পেরে ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় অর্থাৎ ১৫ মার্চ কুমিল্লার নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা।

নাট্যমঞ্চে কয়েক মুহূর্তে আমরা যে দৃশ্য মঞ্চায়ন হতে দেখি, তার নেপথ্যে থাকে অনেক ঘটন ও অঘটন। জীবন নামক নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। অবন্তিকা ট্র্যাজেডির নেপথ্য ঘটনার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় আত্মহত্যার আগে তার নিজ হাতে লেখা চিঠি বা সুইসাইডাল নোট থেকে। যেখানে উল্লেখ আছে, ‘আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এত ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম... এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’

অবন্তিকার বাবা নেই। এমন একটি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষকের মধ্যে অন্তত একজনকে যদি বাবার মতো আপন ভাবতে পারতেন কিংবা বাবার মতো মমত্ব নিয়ে দাঁড়ানো একজন শিক্ষক যদি অবন্তিকার পাশে দাঁড়াতেন, তবে কুমিল্লায় এমন করুণ ক্রন্দন কানে আসত না। তবে অবন্তিকা ট্র্যাজেডি যে সাগরে নিমজ্জিত বিশাল বরফের পাহাড়ের চূড়ার ভেসে থাকা বিন্দুমাত্র, তা প্রমাণ করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্রী ফারজানা।

ফারজানার বিষয়টি আজ মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও জানা। ১৯ মার্চ মঙ্গলবার অকুতোভয় ফারজানা রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি জানিয়েছেন- ‘...২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে উপাচার্য মহোদয় বরাবর আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া বুলিং ও যৌন নির্যাতনের বিচার চেয়ে একটি আবেদন দায়ের করি। বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয় আমার যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলের দায়িত্বে ছিলেন। এটার বিচার আমি এখনো পাইনি, উল্টো আমাকে যৌন নিপীড়নকারী শিক্ষক এবং তার সমর্থনে বিভাগের চেয়ারম্যান, অনার্স পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে ফেইল করিয়েছেন। অভিযুক্ত শিক্ষকেরা আমাকে ভীষণরকম বহিষ্কার ভয়ভীতি, পরীক্ষায় ফেইল করানো, অন্যান্য শিক্ষার্থী থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে মানসিকভাবে নির্যাতন করে, মৃত্যুহুমকি দিয়েই যাচ্ছে, আমাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে আমি নিউজ মিডিয়াতে বিষয়টি প্রকাশ করি।’

একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এতটা মেধাশূন্য হওয়ার কথা নয় যে একাধিক বিষয়ে ফেল এমনকি অনার্স ফাইনালের ভাইবায় শূন্য পাবে। তার যদি এত দুর্বলতা থাকত, তবে পরীক্ষায় আগেও তা প্রকাশ পাওয়ার কথা। সেই মোতাবেক তাকে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা ও অভিভাবককে অবহিত করাও জরুরি ছিল। আর এসব পদক্ষেপের দালিলিক প্রমাণও (রেকর্ড) থাকার কথা। না, এ বিষয়ে কোথাও কোনো আলাপ শুনতে পাইনি।

এ দুটি ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে কারা আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসক রূপে? শুধু ভালো ফলাফলই কি একজন শিক্ষক হওয়ার জন্য যথেষ্ট? পাশ্চাত্য বিশ্ব বা অনেক দূরে যাব না। আমাদের দেশেরই তরুণ সামরিক অফিসারদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়া হয় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে, যা চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে অবস্থিত। এমনিতেই তরুণ অফিসার ক্যাডেট হিসেবে এই একাডেমিতে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা পরিমাপের জন্য জ্ঞান ও শারীরিক সক্ষমতা নানা পর্বে যাচাই করা হয়। তারপর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা যাচাইয়ের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হলেই ধরা হয় একজন আগ্রহী প্রার্থী সামরিক অফিসার তথা তার অনুসারীদের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।

আবার মিলিটারি একাডেমিতে শিক্ষক (প্রশিক্ষক) হতে হলে একজন ক্যাপ্টেন বা মেজর পর্যায়ের অফিসারকে কয়েক মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে নির্দিষ্ট মানে পৌঁছতে হয়। এ সময় আবারও একদল মনোবিজ্ঞানী নানাভাবে প্রতিটি হবু প্রশিক্ষককে আলাদা আলাদাভাবে মূল্যায়ন করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো ফলাফলের পাশাপাশি মানসিকভাবে সুস্থ হলেই কেবল প্রশিক্ষক হওয়ার দুর্লভ ও সম্মানসূচক স্বীকৃতি মেলে। তরুণ-তরুণীরা এসব প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে নিবিড় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই নবীন অফিসার হয়ে ওঠেন। পশ্চিমা ধারণা মতে, নবীন এসব অফিসারের মানসপটে একজন আদর্শ প্রশিক্ষক বা শিক্ষক দ্বিতীয় ঈশ্বর (সেকেন্ড গড) হিসেবে সারা জীবন বিচরণ করেন। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, আমাদের নানা পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিশেষত জাতীয় পর্যায়ের শিক্ষকদের কেবল জ্ঞানী হলেই চলবে না, হতে হবে আদর্শ ও পিতাসম শিক্ষক।

কেবল জ্ঞানী হলেই যে শিক্ষক হওয়া যাবে, বিষয়টি আবার এমনও নয়। এ বছর ১৩ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে এলএলবি ও এলএলএম পাস করা শিক্ষার্থী মো. নুরুল হুদা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ও তৎকালীন উপ-উপাচার্য অবৈধ আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যকে অবহিত করলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি বরং অভিযুক্তদের দিয়েই নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করেন। এমন দুর্নীতির প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।

হাসপাতালে শিশু মরছে একশ্রেণির চিকিৎসকদের অবহেলায়, রেস্তোরাঁয় আগুনে মানুষ মরছে একশ্রেণির পরিদর্শকের অবহেলায়, শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করছে একশ্রেণির শিক্ষকের অবহেলায়, শিল্পী আত্মহত্যা করছে একশ্রেণির মূল্যায়নকারীদের অবহেলায়, একশ্রেণির আইনজীবী মারামারি করছে আদালত চত্বরে, একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিষ খাওয়াচ্ছে আর দাম বাড়িয়েই চলেছে, অতঃপর...?

শুরু করেছিলাম শেকসপিয়রের ‘এজ ইউ লাইক ইট’ নাটকের উদ্ধৃতি দিয়ে। শেষ করব একই নাট্যকারের লেখা ‘দি মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের তৃতীয় পর্বের প্রথম দৃশ্যে শায়লকের কণ্ঠে উচ্চারিত আরেকটি সংলাপ দিয়ে, যেখানে শেকসপিয়র লিখেছেন ‘তোমরা যদি আমাদের আঘাত কর, আমাদের কি রক্ত ঝরে না? তোমরা যদি সুড়সুড়ি দাও, আমরা কি হাসি না? তোমরা যদি আমাদের বিষ প্রয়োগ কর, আমরা কি মরি না? এবং তোমরা যদি আমাদের প্রতি অন্যায় কর, আমরা কি প্রতিশোধ নেব না?  

♦ লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

email : [email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews