‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ করার অভিযোগে মামলায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। এই ধারার অপরাধ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু আলাদা একটা সেকশনে বিচার হবে। এটা আলাদা অপরাধ না, একই অপরাধ। একই আইনের আওতায় পৃথকভাবে এটা হলো। অর্থাৎ এ অপরাধের অভিযোগে আলাদা করে মামলা হবে, যেটির সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর। বিষয়টির আইনগত সংজ্ঞা এবং বাস্তবিক প্রয়োগ নিয়ে আমাদের যথেষ্ট চিন্তাভাবনার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ বাক্যের ফলে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ লঘু হয়ে যেতে পারে।
‘প্রলোভন দেখানো’– এটাকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায় ঢুকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ এফআইআরে যখন লেখা হয় বিয়ের-প্রেমের নামে প্রতারণা বা শারীরিক সম্পর্ক করা হয়েছে, এর ফলে যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেটা হলো ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকেও খর্ব করা হবে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের মামলা বাংলাদেশে নতুন না। প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর উঠে আসে। কিন্তু বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের বিষয়ে আইনে কী আছে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারও বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয়, তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী। দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারাতেই ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা। এর পরই রয়েছে নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা। তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয়, তবে তার সম্মতি নেওয়া হোক বা না নেওয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসংগত স্বামী ভেবে তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তাঁর স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে। পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ বা ২০০০ সালের ৮ নম্বর আইন নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৯-এর (১) নম্বর ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান করা হয়। একই সঙ্গে এর ব্যাখ্যায় নতুন একটি শব্দ সংযোজন করা হয়। তা হলো, ‘প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়’। ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত (ষোলো বৎসরের) অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’ অসম্মতিতে ধর্ষণ করা সম্ভব না। যদি সম্মতি আদায় করে ধর্ষণ করা হয় তখন আবার প্রশ্ন চলে আসে– এই সম্মতিটা কীভাবে আদায় করা হয়েছে? যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এর ব্যাখ্যা দেওয়া নেই, তখন আবার আমাদের দণ্ডবিধিকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হচ্ছে। অর্থাৎ দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৫ ধারায় উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে যেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন আরও বিস্তৃত রূপ নেয় এবং কোনো নারীর সঙ্গে প্রতারণা করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টিও এতে সংযুক্ত হয়। ভবিষ্যতের কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার বিষয়টিকেই বর্তমানে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ মামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে।
নারী যে সম্মতি দিলেন, সেটা কি স্বেচ্ছায়, নাকি কোনো না কোনো প্রলোভন দেখিয়ে বা প্রতারণা করে সম্মতিটা আদায় করা হচ্ছে? সম্মতিটা প্রতারণামূলকভাবে হয়েছে কিনা, সে বিষয়টাই আইনে বলা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো পুরুষ যদি ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়ে কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি না রাখেন, তবে সেটাই প্রতারণা হবে। যদিও নারীদের সুরক্ষার জন্য আইনটির প্রণয়ন হবে কিন্তু ভবিষ্যতে অনেক ক্ষেত্রে এটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। অন্যদিকে এই আইন লৈঙ্গিক বৈষম্যমূলক আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেহেতু প্রতারণার বিষয়টি আসছে সেহেতু এটাকে আরও ব্যাখ্যা করার সুযোগ রাখতে হবে। কারণ একই কাজ একটা মেয়ে করলে ছেলেটা কি ধর্ষণ মামলা করতে পারবে? পারবে না কিন্তু।
এই সংক্রান্ত একটা মামলা দায়ের হয় পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায়। সংশ্লিষ্ট মামলায় অভিযুক্ত পুরুষটিকে শাস্তি দিয়েছিলেন নিম্ন আদালত। কিন্তু কলকাতা হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের সেই রায় খারিজ করে দিয়েছেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যবেক্ষণে জানিয়েছেন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি কারও সঙ্গে, সম্পূর্ণ পারস্পরিক সহমতের ভিত্তিতে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকেন, তাহলে পরে যথাযথ প্রমাণ ছাড়া সেই নারী তাঁর পুরুষ সঙ্গীর দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন, একথা বলা যায় না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, যিনি স্বেচ্ছায় এবং কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই তাঁর পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন, পরে তিনি এভাবে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনতে পারেন না, যদি না তাঁর কাছে এই বিষয়ে পোক্ত কোনো প্রমাণ থাকে। আদালতের আরও বক্তব্য, বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা একটা ‘কনসেপ্ট’। যেটা এভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ব্যবহার করতে পারেন না। যদি উভয়ই সম্মতিতে নিজেরা মিলিত হন তাহলে তা কোনোভাবেই ধর্ষণের সংজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে না। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় এই ধরনের আইনগত শব্দ প্রয়োগে মামলার সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়বে। সরকারের উচিত এই টার্মকে আইনগত বৈধতা দেওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা। প্রয়োজন হলে আধুনিক প্রেক্ষাপট চিন্তাভাবনা করে ধর্ষণের নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করাতে হবে। কারণ এই টার্মের অপব্যবহারে এর সামাজিক ও লৈঙ্গিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিথ্যা ধর্ষণ মামলার আড়ালে যেমন প্রকৃত ধর্ষণ মামলা হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি মিথ্যা এসব মামলায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
মো. আসাদুজ্জামান: সহকারী অধ্যাপক, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা