সংবাদপত্রে খবর এসেছে, বিদায়ী মন্ত্রীদের একান্ত সচিব (পিএস) ও সহকারী একান্ত সচিবদের (এপিএস) দুর্নীতি ও অপকর্মের অনুসন্ধানে নামবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদের মধ্যে যেসব মন্ত্রীও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের ব্যাপারেও খোঁজ নেবে তারা। এর জন্য ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে হতেই একটি টেকনিক্যাল কমিটি প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করেছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে তদারকি করতে কমিশনের উচ্চ পর্যায়ের একটি শীর্ষ কমিটিও গঠন করতে যাচ্ছে কমিশন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। তিনি কোনো ধরনের দুর্নীতির দায় নিতে চান না৷ 

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের বক্তব্যও হলো- যত বড় প্রভাবশালী হোক না কেন, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাব, আমরা অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেব। সেখানে মন্ত্রী, এপিএস বা পিএস বলে কথা নেই। কারণ এই সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পথ ধরেই দুদক এগোবে। কোথাও কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আগামী দুই মাসের মধ্যে সব কিছু দৃশ্যমান হবে। এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

বিগত সময়ের মন্ত্রীদের পিএস ও এপিএসদের ওপর যে সরকার ক্ষুব্ধ, তার প্রমাণ মিলেছে এবার পিএস নিয়োগের  পদ্ধতি বদলানোর রীতি থেকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা কেউ নিজেদের পছন্দের পিএস নিয়োগ দিতে পারেনি৷ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের পিএসদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়ম ও দৌরাত্ম্যের অভিযোগ ওঠায় এবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজ থেকেই তাদের জন্য পিএস ঠিক করে দিয়েছে। এর আগে মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের জন্য তার এলাকার ও পছন্দের কোনো কর্মকর্তাকেই পিএস হিসেবে নিয়োগ দিতেন। এবারই এই পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটলো৷

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের তিন মাস আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে মন্ত্রীদের পিএস ও এপিএসদের ব্যাপারে তথ্য নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে মন্ত্রীদের নানা কর্মকাণ্ডের তথ্যও উঠে এসেছে। এতে নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের চিত্র উঠে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব তথ্যের ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসনকে পিএস নিয়োগের দায়িত্ব দিয়েছেন৷ গত ডিসেম্বরে দুদক মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি প্রতিরোধে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে একাধিক সুপারিশ পাঠায়। সেখানে মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বন্ধে রাজনৈতিক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) বাতিলের সুপারিশ করা হয়। কারণ মন্ত্রীদের বিভিন্ন অপবাদের প্রধান কারণ এসব এপিএস। এপিএসদের ক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের চেয়েও বেশি। মন্ত্রীদের ৭০ শতাংশ এপিএসই নানা দুর্নীতি এবং অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। এরা মন্ত্রীদের নাম ভাঙিয়ে নানা অনিয়ম করে থাকে৷

দুদকের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন সময়ে এপিএসদের  কারণে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের সমালোচনার মুখে পড়তে দেখা যায়। এপিএসদের ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার নানা খবর বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে।

দুদকের কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানী টিম জানতে পারে, বিগত সময়ে মন্ত্রীদের পিএস ও এপিএসরা অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। মন্ত্রীর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এবং কখনো কখনো মন্ত্রীর অগোচরে, নাম ভাঙিয়ে ও স্বাক্ষর জাল করে নানা ধরনের দুর্নীতি করেছেন। এর মাধ্যমে তারা সহজেই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন। বিভিন্ন জায়গায় চিরকুট পাঠিয়েও অনৈতিক ফায়দা লুটেছেন।

এ ব্যাপারে প্রশাসন ও রাজনৈতিক অঙ্গনের সবাই কম-বেশি অবগত। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কখনোই তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এসবের সঙ্গে মন্ত্রীদের জড়িত থাকার তথ্যও দুদকের কাছে রয়েছে। কিন্তু এখন কথা হলো এই সম্পৃক্ততা কি কেবলই বিদায়ী মন্ত্রীদের? যারা মন্ত্রিসভায় বহাল রয়েছেন তারা সবাই কি এসব অভিযোগের ঊর্দ্ধে ছিল?

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, পিএস যেভাবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা ভালো। তবে আমি বলব, এপিএসও খোঁজখবর নিয়ে ভালো সৎ ব্যক্তিদেরই দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দিতে বলব। কারণ এসব পিএস ও এপিএসদের কারণে সরকারের দুর্নাম হয়। মন্ত্রীরাও বিপাকে পড়েন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মন্ত্রীরাও এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাই সবার ব্যাপারেই খোঁজ রাখা উচিত। এসব পিএস বা এপিএস সৎ না হলে সরকারের দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন হবে না।

অনেকবার সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে এপিএসরাই৷ যেমন- সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের এপিএস, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের এপিএস৷ চার দলীয় জোট সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের এপিএস হায়দারকে নিয়েও অনেক লেখালেখি হয়েছে৷ বহুল আলোচিত ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী৷ ক্ষমতা হারার সাথে সাথেই অপকর্মে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে তিনি দেশত্যাগ করে পালিয়ে যান৷ এখন পর্যন্ত তিনি পলাতকই আছেন৷

একজন মন্ত্রীর কয়জন পিএস, এপিএস থাকবে? একজন প্রতিমন্ত্রীর কয়জন পিএস, এপিএস থাকবে? একজন এমপির কয়জন পিএস, এপিএস থাকবে? তাদের বেতন-ভাতার উৎস কী? তাদের গ্রেড কী? এগুলো সুনির্দিষ্ট করা উচিত নয় কি? এই এপিএসদের কারণে মন্ত্রী-এমপিরা গণবিচ্ছিন্ন ও দলবিচ্ছিন্ন হচ্ছেন৷ নেতাদেরকেও এপিএসদের ধর্না দিয়ে চলতে হয়৷

দুদকের সুপারিশ অনুযায়ী এই এপিএস প্রথা বাতিল হলে মন্ত্রীদের মন্ত্রীত্ব ও এমপিদের এমপিত্ব পরিচালনায় কি কোনো সমস্যা হবে? সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য হতে আসা পিএসদের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, কিন্তু মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এপিএসদের তা থাকে না, তাই তারা অধিকতর বেপরোয়া হয়ে ওঠে৷ মন্ত্রী-এমপিদের জ্ঞাত, অজ্ঞাতে তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়৷



































সবার কাছেই এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে,  পিএস, এপিএস মানেই ক্ষমতার আঁধার৷ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে কে চেনে? কে খবর নেয় তার? একজন উপসচিবকে কে চেনে? কে খবর নেয় তার? কিন্তু যেই তারা কোনো মন্ত্রীর পিএস হয়ে যান তখন তারা হয়ে যান ক্ষমতার মধ্যমনি৷ এমপির এপিএসরা এলাকায় গেলে হুমরি খেয়ে পড়ে প্রশাসন ও নেতাকর্মীরা৷ রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে বড়লোক হয়ে যায় তারা৷ আর এমপি, মন্ত্রীরা হয় গণবিচ্ছিন্ন৷

আমরা আইনজীবীদের সহায়কদের দেখি, তারা কেবলই উকিলদের অফিসিয়াল ফাইল-পত্রে সহায়তা করে থাকে৷ তারা কিন্তু কেউ উকিলের সঙ্গে উকিল হয়ে যেতে পারে না৷ পিএস, এপিএসরা কিন্তু এমপি মন্ত্রী হয়ে যেতে পারে৷ যে যার পিএস, এপিএস কেবল তার কাজকর্মে সহায়তাদানই কি সঙ্গত হওয়া উচিত নয়? তাদের গণসম্পৃক্ততা বন্ধ হলে ও প্রশাসনিক ও দলীয় তোয়াজ বন্ধ হলে হয়তো নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতাবাজীর সুযোগ বন্ধ হতে পারে৷ পিএস নিয়োগ জনপ্রাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হওয়াটা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত৷ অন্যান্য সহকারীদেরও সেভাবেই হওয়া উচিত৷ দুদকের সুপারিশে এপিএস প্রথা বাদ দিতে পারলে ভাল৷ না পারলে এ নিয়োগ এমপি-মন্ত্রীদের পছন্দে না হয়ে দলীয় প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্তে হওয়াটাই কাম্য৷ দুদক কেবল বিদায়ী মন্ত্রীদের পিএস-এপিএস নয়, সকল এমপি-মন্ত্রীদের ব্যাপারে নজরদারি বাড়াবে এমনটিই প্রত্যাশা সকলের৷

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews