‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’– এই জনপ্রিয় গান ঢাকার নব্য নবাব ও বাবুবিবিদের মনের কথা হতে পারে। কিন্তু আর সবার জন্য ঢাকা এক জীবনবিনাশী রাজধানী। ঢাকা আর আশা মেটায় না, বরং সকল আশার সমাধি এই ঢাকা। তবে একটাই গর্ব আমাদের, ঢাকার রায়েরবাজারে আমরা এশিয়ার বৃহত্তম গোরস্তান বানাতে পেরেছি। শুধু কি তাই? নিজের বুকের মধ্যেই মরে যাচ্ছে এই মহানগরী। সবার আগে মরেছে ঢাকার নদী ও খালগুলি। ২৬টি খাল নিয়ে ঐতিহাসিক বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ মরবার পথে। নদীর দিকে মুখ করে গড়ে উঠেছিল ঢাকাই রাজধানী। অথচ সেই নদীর দিকেই আমরা মলমূত্র ও কারখানার বিষাক্ত ময়লার নালাটা ঘুরিয়ে দিয়েছি। এই শহরের ধমনিতে পানি নয়, বয়ে যায় বিষাক্ত কালো তরল। নদীর নামে ঠিকানা হয়েছিল যেই দেশের, সেই দেশের রাজধানী এখন নদীর শ্মশান।
ঢাকার বায়ু ভয়াবহ দূষিত– বিশ্বের মধ্যে মন্দদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন নগরী। ঢাকার জীবন আয়ু খেয়ে ফেলে। ঢাকায় দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যার মৃত্যুও রেকর্ডসম। বিআইডিএসের ২০১৮ সালের এক গবেষণার চিত্র হলো, ঢাকার ৬৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে অসুস্থ। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ুতে বসবাস করতে গিয়ে ঢাকাবাসীর জীবনের ৭.৭ বছর আয়ু নষ্ট হয়ে যায়। অথচ টোকিও বা লন্ডনবাসীদের মতো একটাই তো জীবন আমাদের। এত উন্নয়নের পরও ঢাকার যানজটের গল্পের কোনো উপসংহার দেখা যায় না। পানিদূষণ, জলাবদ্ধতা, শব্দদূষণ, খোলা জায়গা ও জলাশয় দখল সব ব্যাপারে ঢাকা নির্লজ্জভাবে এগিয়ে। যানজটের কারণে জীবন থেকে কত কর্মঘণ্টা লোপাট হয়ে যায়, সেই হিসাব কি কেউ রাখে?
ঢাকা যেন এক বাক্স-বাক্স কারানগরী– সবাই মাথা নিচু করে বাক্স ধরনের ঘর থেকে মুড়ির টিনের মতো বাক্স টাইপ বাসে করে বাক্স ধরনের কর্মস্থলে যায়, আবার সারাদিনের কষ্ট-যন্ত্রণা সয়ে ওই ঘর নামক বাক্সে ঢোকে। পরিকল্পিত আবাসন বা মেট্রোরেলের ফায়দা ঢাকার বিপুল গরিব মানুষের ভাগ্যে জোটে না। যে ডজনখানেক নাগরিক পরিষেবা সংস্থা আমাদের রয়েছে, তাদের কাজের দ্বারা নগরবাসীর যন্ত্রণা কমে না বাড়ে, সেটাও জটিল প্রশ্ন। ঢাকার মাত্র ১৫ ভাগ মানুষ ওয়াসার পানি পায়, সেপটিক ট্যাংক সুবিধা মাত্র ৩০ ভাগের। অথচ ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় নিউইয়র্কের সমান। একে জীবনযাপন বলে না, বলে টিকে থাকা।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-ও আছ। চারপাশের তুলনায় ঢাকা যেন এক উত্তপ্ত দ্বীপ– হিট আইল্যান্ড। এই কংক্রিটের মরুভূমিতে মাটি দেখা যায় না, ঘাস দেখা যায় না; শুধু দালান আর দালান। দালানদারির এই রাজধানীতে গরমকালের তাপমাত্রা মরুভূমির তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে গত বছরের শেষে ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়ককে বৃক্ষহীন করা হলো, গত সপ্তাহে বৃক্ষহীন করা হলো বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাকে। এখন বলা হচ্ছে, গাছ লাগাতে হবে। লাগাবেন যে, তত জায়গাও কি আছে? ড্যাপ নামে যে ঢাকার ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান করা হয়েছিল, যেখানে খোলা জায়গা ও জলাশয়ের জন্য আশ্বাস ছিল, আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে সেসব আশ্বাসের ধারা কেটে দেওয়া হয়েছে।
৫৩ বছর হলো ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী। কিন্তু গর্বের চাইতে তিক্ত হতাশার চিত্রই চোখে ভাসে। ব্রিটিশ আমলে ঢাকাকে সমতল বৃষ্টিভূমি হিসেবে নগরপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানেরও কিছু পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা কল্পনার স্তরেই থেকে গেছে। স্বাধীনতার পরপরও মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছিল। কোথায় গেল সেসব?
একটি দেশের রাজধানী সে দেশের শাসকশ্রেণির, ধনিকশ্রেণির মনের প্রতিচ্ছবি। তাদের দেশকল্পনা কতটা সুন্দর, ঢাকা নির্মমভাবে তা দেখিয়ে দিচ্ছে।
চীনের শাসকেরা খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে তাদের দেশের সুরক্ষায় মহাপ্রাচীর বানানো শুরু করেছিল। সেটা শেষ হয় ১৬ শতকে। অর্থাৎ তারা ২ হাজার বছরের পরের বাস্তবতাও কল্পনা করেছিল, তেমন দূরদর্শিতা তাদের ছিল। দিল্লির শাসক শেরশাহ গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড তৈরি করেছিলেন। তার সুফল আজও মানুষ পাচ্ছে। কারণ, এসবের নির্মাতারা শুধু নিজেদের আমল না, পরের প্রজন্মগুলিকেও হিসাবের মধ্যে ধরেছিলেন। তারা এমন কল্পনা করেছিলেন, যা ছিল ভবিষ্যৎমুখী। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সেই দূরদর্শিতা কোথায়? আমরা চলতি প্রজন্মের কথাই মনে রাখি না, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তো দূরের কথা। তা যদি থাকত হাওরকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে সড়ক বানানো হতো না, সেই বৃক্ষহীন সড়কে আলপনা আঁকার আহ্লাদি দেখতে হতো না। ঢাকার ফ্লাইওভারগুলির কোনো কোনোটি ভবিষ্যতে ঢাকার যান চলাচলে গুরুতর সংকটের জন্ম দেবে শুধু না, বর্তমানেই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিমত দিচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা। আসলে আমরা চুরি করে নিচ্ছি পরের প্রজন্মগুলির আয়ু, সময়, সম্পদ ও সুখের সম্ভাবনা। আমরা ভবিষ্যৎ-ঘাতক।
অথচ ঢাকার মতো সুন্দর ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অবস্থান খুব কম রাজধানীরই ছিল। দেশের বৃহৎ নদীব্যবস্থার বৃহৎ নদীগুলি যেমন– পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র ঢাকা ঘেঁষে বয়ে গেছে। এইসব নদীব্যবস্থার শাখা নদীগুলি ঢাকাকে জালের মতো বেষ্টন করে ছিল। ঢাকা ছিল খাল ও জলাশয়ের শহর। ঢাকার একদিকে লালমাটি ও অরণ্যভূমি, অন্যদিকে বিস্তৃত পলিমাটির জলাভূমি। ঢাকার বাতাস নদীবাহিত বলে বিশুদ্ধ ও মনোরম হবার কথা ছিল। সেই ঢাকাকে আমরা এখন ইটভাটার জ্বলন্ত ও কালো ধোঁয়া উগরানো চুল্লি দিয়ে ঘিরে রেখেছি। সেই ধোঁয়ার কালিতে উন্নয়নের মুখ কালিমালিপ্ত হয়ে আছে। কোনো রূপচন্দনে তা ঢাকা পড়বে না।
এ শহরে টিকে থাকতে গিয়ে মানুষের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে যায়। মানুষ ক্ষ্যাপাটে আচরণ করা শুরু করে। বায়ুদূষণের সাথে বিষণ্নতার সম্পর্ক রয়েছে। আগে ঢাকার রিকশাচালকদের মধ্যে বিষণ্নতার প্রকোপ ছিল বেশি। এখন এটা সব স্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। বিআইডিএসেরই সেই গবেষণার তথ্য- ঢাকার মোট জনগোষ্ঠীর ৪৪ শতাংশই বিষণ্নতায় ভুগছে। এই বিষণ্নতার কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে নগরীর ট্রাফিক জ্যাম, বাতাসের মান, বিশুদ্ধ পানির অভাব, ইভিটিজিংসহ আরও কিছু সমস্যাকে। মূলত অসুস্থতায় ভোগা, দারিদ্র্য এবং জীবনযাত্রার মান ও অনিশ্চয়তাই হলো কারণ।
তাই মূল প্রশ্ন এটাই, কার শহর এই ঢাকা? ঢাকা এখন আর কারও স্বপ্নের শহর নয়। এ শহরে যারা বেড়ে উঠছে, তারা কবি শামসুর রাহমানের মতো বলতে পারবে না যে, স্মৃতির শহর ঢাকা। আমাদের প্রজন্ম বা তার পরের প্রজন্মগুলির জন্য ঢাকা স্মৃতির শহর নয়, বরং নন্দিত নরক। এই শহরের স্মৃতি বরং কষ্টদায়ক।
আদতে ঢাকা এক ট্রানজিট শহর। তা সারাদেশের গরিবের সাময়িক কর্মসংস্থানের উপনিবেশ। মধ্যবিত্তের সন্তানদের বিদেশ গমনের আগের বাসস্থান। বিদেশে সম্পদ গড়া লুটেরাশ্রেণির সম্পদ বানাবার এই কারখানাকে কেউ ভালোবাসে না। সারাদেশের বড়লোকের ভোগবিলাসের ভার, সারাদেশের গরিবদের রুটিরুজির ভার, উদ্ধত রাজনীতির দাপিয়ে বেড়ানোর চাপ ঢাকা আর নিতে পারছে না। ঢাকাকে সত্যিই আর কেউ ভালোবাসে না। ঢাকা হলো প্রয়োজন মেটাবার নিরুপায় জনপদমাত্র। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে একে আগে ভালোবাসতে হবে। যাদের ভবিষ্যৎ এই দেশে, সেই দায় তাদেরই বেশি।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক; সমকালের
পরিকল্পনা সম্পাদক