ট্রু প্রমিস

ইসরায়েলে ইরানের হামলার ভেতরের ঘটনা

ইরানের এমপি নাবাভিয়ানের সাক্ষাৎকার 

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েল ১ এপ্রিল যে বিমান হামলা চালিয়েছিল তার প্রতিশোধ হিসেবে ১৩ এপ্রিল রাতে ইসরায়েলের ওপর বড়সড় হামলা চালিয়েছে তেহরান। শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের এই হামলা রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্বে এক নজির স্থাপন করেছে।

এর আগে, কোনো একক দেশ কোথাও এত বড় ড্রোন হামলা চালায়নি। দশকের পর দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে বৈরীতা চলতে থাকলেও এবারই প্রথম ইসরায়েলের ওপর সরাসরি হামলা চালায় ইরান। 

এই হামলার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কি কি কাজ করেছে এবং ইসরায়েলে হামলার আগে ইরানের অভ্যন্তরে কি কি ঘটনা ঘটেছে তার একচেটিয়া বর্ণনা করেছেন দেশটির সংসদ সদস্য মাহমুদ নাবাভিয়ান। দ্য ক্র্যাডলকে দেওয়া সাক্ষাতকারের একটি অংশ তুলে ধরা হলো- 

গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই হামলায় সিরিয়া ও লেবাননে চলমান অপারেশনের দায়িত্বে থাকা দুই জেনারেল ও আরও ছয়জন লোকসহ মোট সাতজন আইআরজিসি সদস্য নিহত হন। মূলত ওই হামলার প্রতিক্রিয়াতেই ইসরায়েলের ওপর ইরানের সাম্প্রতিক এই ড্রোন হামলা।

দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলার দুই ঘণ্টা পরেই ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন হয়। পরে সেখানে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হয় এবং সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিক্রিয়া জানাতে তাদের পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে ১০ দিনের সময়সীমা বেধে দেওয়া হয়।

পরে ঈদুল ফিতরের রাতে ইরানের আশেপাশের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক প্রধানদের একটি বৈঠক হয়। আমরা তাদের জানিয়েছিলাম, আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীতার প্রতি আগ্রহী, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আপনাদের কোনো স্থলভাগ ব্যবহার করে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তবে আমরা আপনাদের স্থলভাগে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ করব। 

আর এই বার্তা ওয়াশিংটনকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল এবং তারা বুঝতে পেরেছিল ইরান খুব সিরিয়াস। তারা আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেন। এমনকি জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা- যারা গাজার যুদ্ধকে সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে বোমা, অস্ত্র সরবরাহ করে তারাও আমাদেরকে শান্ত থাকতে বলে। 

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইসরায়েলে ইরানের হামলার পরের রাতে ফোন করে জানান, তিনি গত রাত ঘুমাতে পারেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন- ইসরায়েলে তিনশটির বেশি ড্রোন হামলার কারণে। তখন যে ইরানি কর্মকর্তা তার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি বলেছিলেন, গত ছয় মাস ধরে গাজার জনগণের ওপর বিমান হামলা হয়েছে তখন প্রতিরাতেই আপনি ভালো ঘুমিয়েছেন।

আরেকটি বিষয় হলো আমাদের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তার ঈদুল ফিতরের খুতবায় বলেছেন, আমরা অবশ্যই আমাদের শত্রুকে শায়েস্তা করবো। সেখানে আমাদের বার্তা সর্বস্তরে সমন্বয় এনেছিলো। কারণ, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সর্বস্তরে সমন্বয়। 

ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) অপারেশনটির নাম দিয়েছে 'ট্রু প্রমিস'। এমন নাম দেওয়ার পেছনে রয়েছে বিশেষ কারণ। তেহরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারা এর আগে ইরানের ওপর চালানো ইসরায়েল ও তার মিত্রদের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে 'শাস্তি'র যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা তারা রক্ষা করেছেন– সেটি বোঝাতেই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে 'ট্রু প্রমিস' বা সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার। 

আর এখানে আমাদের লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার। প্রথমত, আমরা অবশ্যই ইসরায়েলকে আঘাত করব; দ্বিতীয়ত আমরা ইরানের ভূখণ্ড থেকে সরাসরি হামলা করব এবং তৃতীয়ত, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার উত্তরে এটি প্রতিবন্ধক হবে।

এদিকে হামলার আগে আজারবাইজান আমাদের জানিয়েছে যে, তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, আমরা বাকুতে ইসরায়েলি দূতাবাসে বোমা হামলা চালাতে পারি। তারা আমাদেরকে তাদের ভূখন্ডে কোনো পদক্ষেপ নিতে না করেছে। আমি মনে করি, এটা আমাদের প্রতি একটা বার্তা ছিল যে, আমরা যেন প্রতিবেশী দেশগুলোতে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা না করি। 

আমরা যে কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে বার্তা পেয়েছি বিষয়টা এমন নয়। আমরা এই অঞ্চলের কিছু দেশ থেকেও বার্তা পেয়েছি। এসময় আমরা গাজায় যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর জন্য বিষয়টি নিয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা সবাইকে বলেছি, এটি সমাধান হতে পারে। 

তারা আমাদের জিজ্ঞাসা করেছিল, গাজায় যুদ্ধবিরতির মানে কি আমরা সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকব। আমরা বলেছিলাম, আমরা যে কোন মূল্যেই ইসরায়েলকে আঘাত করবো। তবে যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হলে আক্রমণের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করবে। 

এতে করে সবাই বুঝতে পেরেছিল যে, আমরা ইসরায়েলে হামলা চালাব। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ব্রিটেন, সৌদি আরব, জর্ডান, কাতার সতর্ক অবস্থানে ছিল। তারা তাদের জলসীমায় ২ হাজার থেকে ৩ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার সজ্জিত করে। তারা সব আধুনিক স্যাটেলাইট এবং রাডার ব্যবহার করেছে আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলিতে আঘাত করার জন্য। এছাড়া তাদের সব বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মার্কিন তত্ত্বাবধানে রাখে। 

মজার বিষয় হল যে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইসরায়েলে হামলা চালানোর ২৪ ঘণ্টা আগে আমাদের ফোন করে অনুরোধ করেছিলেন- আমরা যেন ইরানের ভূখন্ড থেকে ইসরায়েলকে লক্ষ্যবস্তু না করি। তারা ভেবেছিল যে, আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি অন্যান্য দেশের প্রতিরক্ষা লাইন অতিক্রম করতে সক্ষম হবে না। একটা ক্ষেপণাস্ত্রও ইসরায়েলে প্রবেশ করবে না। 

ইসরায়েলে হামলার ২৪ ঘণ্টা আগে ওয়াশিংটনও একটি দৃঢ় বার্তা পাঠিয়েছিল- আমরা যদি আমাদের ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলে হামলা চালায় তবে তারা তেহরানের বিরুদ্ধে সামরিকভাবে জবাব দেবে। আমরা বলেছি- আমরা আমাদের ভূখণ্ডের ভেতর থেকেই ইসরায়েলে হামলা চালাব এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি কোন ভুল করে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের এসব অঞ্চলে তাদের সমস্ত ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করব। 

আমরা সৌদি আরব এবং এই অঞ্চলের দেশগুলোকেও জানিয়েছি যে, তাদের ভূখণ্ড থেকে ইরানের ভূখণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করা হয় তবে আমরা অবশ্যই জবাব দেব। 

এদিকে আমরা জানতাম যে, ইরাক এবং জর্ডানের আকাশসীমা সম্পূর্ণরূপে মার্কিন নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে আমাদের দুটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার সিদ্ধান্ত ছিল। একটি নেভাটিম বিমানবন্দর এবং দ্বিতীয়টি গোলানে ইসরায়েলি গোয়েন্দা কেন্দ্র। কাকতালীয়ভাবে যে যুদ্ধবিমানটি কনস্যুলেটকে লক্ষ্য করে হামলা করেছিল, সেটিই এই গোয়েন্দা সদর দপ্তরের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল।

আমাদের প্রায় ১৩০টি ড্রোন তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুরো ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল। ১৭টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ১৫টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে, অর্থাৎ, ৮৯ শতাংশ সফল। এর দ্বারা পুরো বিশ্বের কাছে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। 

এদিকে ইসরায়েলে হামলার পর ১৫টি দেশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তারা গাজায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এছাড়া ইসরায়েলকে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া জানাতে না করেছে। 

এরপর যুক্তরাজ্য এবং জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যদি ইসরায়েল আবার ইরানের ওপর আক্রমণ করে?  আমরা বলেছিলাম, আমাদের ওপর হামলা হলে আমরা দশগুণ শক্তিশালী জবাব দেব। 



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews