করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর এই মহামারির সঙ্গে মাদকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পর্কের কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ মানুষ বয়সে তরুণ। অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। মাদকের ব্যবসায়ীরা এই কর্মক্ষম তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের ভোক্তা হিসেবে পেতে চায়। সরকার ইতিমধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে এবং প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। বর্তমান করোনা মহামারির কারণে নজরদারির কিছুটা শিথিলতার সুযোগ নিচ্ছে কারবারিরা।
ডিএমপি থেকে জানা যায়, প্রতি মাসেই ঢাকার ৫০ থানায় গড়ে দেড় হাজার মাদক মামলা হয়। করোনা দুর্যোগের মধ্যেও এ চিত্র বদলায়নি। গত তিন মাসেও একই হারে মামলা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের এই মহামারির মধ্যে মাদকের চোরাচালান বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন যানবাহন যেমন অ্যাম্বুলেন্স, নিত্যপণ্য পরিবহনের গাড়িতে করে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন নিয়ে আসছে কারবারিরা। দেশের মধ্যে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফের ইয়াবা কারবারিরা ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবার চালান বন্ধ রাখেনি। কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো পার্সেলে এমনকি ত্রাণ বিতরণ এবং ওষুধ কেনাসহ বিভিন্ন অজুহাতের মাধ্যমে মাদক বিক্রি করছে তারা। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে পচনশীল পণ্য যেমন শাকসবজি ও ফলমূল বহনকারী যানবাহন গন্তব্যে পৌঁছতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, এ সুযোগটিকেই বেছে নিয়েছে মাদক কারবারিরা।
বাংলাদেশে গবেষকরা ইতিমধ্যে মাদকাসক্তদের ৯০ শতাংশ কিশোর-তরুণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৬০ শতাংশই বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও খুনসহ রাজধানীতে সংঘটিত অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গেই মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে মাদকাসক্তির কারণে প্রায় ২০০ পিতা-মাতা নিজ সন্তানের হাতে খুন হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে মাদক পাচার ও সরবরাহ অনেকটাই কমে গেছে। জাতিসংঘ বলছে, অনেক মাদকাসক্ত বিকল্প হিসেবে আরো মারাত্মক মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে। এরই মধ্যে অনেক দেশে হেরোইন স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সেসব দেশে এখন এমন মাদকদ্রব্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং শরীরের ওপর হেরোইনের চেয়েও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মাদকাসক্তরা অনেকেই ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য প্রয়োগ করছে এবং একই সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করছে। ফলে এইচআইভি বা এইডস অথবা হ্যাপাটাইটিস ‘বি’ কিংবা ‘সি’ ইত্যাদি রক্তবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে হেরোইন ও কোকেনের সংকট তৈরি হচ্ছে। জাতিসংঘের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’(ইউএনওডিসি) বলছে, দেশে দেশে লকডাউন চলার কারণে মূলত মাদকদ্রব্যের এই সংকট। এসব এলাকায় বিমান ও সড়ক পথে বেশির ভাগ মাদক চালান করা হয়। করোনা ভাইরাসের কারণে এই দুই রুটেই পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়েছে মাদক পাচারেও। করোনা মহামারিকালে ভারত মহাসাগরে হেরোইনের একটি বড় চালান ধরা পড়ে। এই ঘটনায় জাতিসংঘ বলছে, এই চোরাচালান প্রমাণ করে যে, নৌপথে মাদকদ্রব্য পাচারের প্রবণতা বেড়েছে। গাঁজার ক্ষেত্রে খুব একটা সংকট তৈরি হয়নি। কারণ, গাঁজা স্থানীয়ভাবেই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।
আরো একটি ভয়ংকর চিত্র হচ্ছে যে, ইয়াবা গ্রহণকারী ৮৫ শতাংশই তরুণ কিংবা যুবক। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানান ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে প্রায় ১৫ হাজার মাদকাসক্ত চিকিত্সা নিচ্ছেন। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ইয়াবাসেবী। একটানা মাত্র দুই-আড়াই বছর ইয়াবা সেবনের ফলেই তারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাদের নার্ভগুলো সম্পূর্ণ বিকল হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই দেশে ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মাদক গ্রহণকারীদের কাছে ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সিসা। গবেষণায় দেখা গেছে, একবার সিসা সেবনে একটি সিগারেটের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি কার্বন মনোক্সাইড গ্রহণ করা হয়ে থাকে। উচ্চমাত্রার কার্বন মনোক্সাইডে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে এবং অচেতন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বর্তমান সরকার ২০১৯ সালের প্রথম দিন থেকেই মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গত বছরের প্রথম দিন থেকেই সারা দেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে এবং প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গিকার মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। দেশের উন্নয়ন যেভাবে চলছিল তাতে মাদক দেশের উন্নয়নে অন্যতম বাধা বলে মনে করছে বর্তমান সরকার। দিনকে দিন মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের হিসাব মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ, ধারণা করা হয়, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। সম্প্রতি সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতেই হয়, বিষয়টি হচ্ছে, এখন থেকে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে। যাদের ডোপ টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হবে, তিনি চাকরির জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন-২০১৮-এর খসড়া/ প্রস্তাবিত আইন সংশোধন; সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইতিমধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন-২০১৮ প্রণীত হয়েছে এবং আইনটি ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। নতুন এ আইন মাদক ব্যবসার নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনে ইয়াবা ব্যসায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সঙ্গে পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ অন্য বাহিনীগুলোও এখন মাদক নির্মূলে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়, যে কারণে কমে এসেছে মাদকের চোরাচালান ও ব্যবহার।
শুধু ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ মাদক উত্পাদনকারী দেশ না হওয়া সত্ত্বেও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে চোরাচালানের মাধ্যমে এ দেশে মাদক প্রবেশ করে। ভৌগোলিকভাবে গোল্ডেন ট্রায়াংগেল রুট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। রূপকল্প ২০২১-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪০ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যত্ যুবসমাজকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে মাদকমুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। দেশকে মাদকমুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি, বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে টার্গেট করে মাদকবিরোধী প্রচারের কাজ করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। আমাদের সংগঠন ‘মানস’ দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত্ এদেশে যুবসমাজের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মাদকাসক্তির পেছনে বিজ্ঞানীরা ও গবেষকরা বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন—কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—১. সমবয়সীদের চাপ; ২. হাতের কাছে মাদকদ্রব্য পাওয়া অর্থাত্ মাদকের সহজলভ্যতা; ৩. বেকারত্ব ও কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতা; ৪. আর্থসামাজিক অস্থিরতা; ৫. মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা; ৬. সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়; ৭. পারিবারিক কলহ; ৮. চিকিৎসা সৃষ্ট মাদকাসক্তি এবং ৯. কৌতূহল।
মাদবাসক্ত ব্যক্তি স্বভাবতই চিকিৎসা নিতে চায় না। কারণ সে বুঝতেই পারে না যে, তার চিকিৎসার প্রয়োজন। আবার অনেকেই শারীরিক যন্ত্রণার ভয়ে মাদক চিকিত্সায় অনীহা পোষণ করে। এক্ষেত্রে পরিবারের স্ত্রী, বাবা, মায়েদের নেশার নেতিবাচক দিক এবং জীবনের সম্ভাবনাময় বিষয়গুলোকে তুলে ধরে প্রতিনিয়ত সহমর্মিতামূলক আচরণের মাধ্যমে তাকে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী করে তুলতে পারেন। এমনভাবে আচরণ করতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে যে, আমরা তাকে ভালোবাসি, তার সুন্দর ও সুস্থ জীবনের জন্য আমরা সহযোগিতা করতে চাই। মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিকে সঠিক ভাবে পরিচর্যা করতে না পারলে যে কোনো সময় তার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। মাদকাসক্তি চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজ ও তার পরিবারের সার্বিক সহযোগিতাসহ সেবা প্রদানকারী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভালো করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।
করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা যেমন মাস্ক ব্যবহার করি, হাত সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধুই এবং সেই সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি তেমনি অন্যান্য ঝুঁকি থেকেও আমাদের দূরে থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, জীবনব্যবস্থার পরিবর্তন করা এখন জরুরি।
সুতরাং, করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাদকাসক্তদের নেশা ত্যাগ করার জন্য চিকিত্সার মাধ্যমে (কাউন্সিলিং/রিহ্যাব) সুস্থ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক, বারডেম হাসপাতাল ও সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড
ইত্তেফাক/কেকে
