কী দেবো আজকের তোমাকে?

তোমাকে আমার তোমার বয়সী ...

নিয়ে যাও, আমাকে নিংড়ে নিয়ে যাও… বললেই কি কেউ নেবে যদি তার দরকারই না লাগে? বহু বছরের ব্যবধানে একই শহরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেও কতদূর যে এসে পড়ে মানুষ! বছরগুলো পেরোলে একই শহরে একই সূর্যের নিচে একই পিচঢালা রাস্তায় অন্য কারও জীবন বহু পথ পেরিয়ে আসা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে। সময়ও তবে হাঁটায়, দূরে নিয়ে আছড়ে ফেলে।
সময় যা কিছু বদলায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বদলায় মানুষের তৃপ্তির ঠিকানা। কী পেলে কেউ খুশি হয়? একই বয়সের যুগান্তরের দু’জনকে কি একই জিনিস দিয়ে খুশি করা যায়? হয়তো পসরা সাজিয়ে বসে আছি, স্মৃতির জাদুঘর কেউ নিক, কেউ তাকে খুব যত্ন করুক। কিন্তু নেবে কেন কেউ অদরকারি জিনিস?
কৈশোরে এত এত খেলনার দরকার পড়ত না। খোলা মাঠ ছিল। নিচে ঘাসের বিছানা আর মাথার ওপরে বৃক্ষের ছায়া ছিল। চলাফেরায় পাহারা ছিল না, তাই স্কুলফেরত ঘাড়ের ব্যাগ কোনো রকমে ফেলেই মাঠকে আলিঙ্গন করা যেত। মাঠে না ছিল কোনো খেলার উপাদান, না কোনো বাড়তি আকর্ষণ। মাঠ তো মাঠই– অবারিত সবুজ মনকে প্রশস্ত করত হয়তো। এই কোণে এক গাদা বন্ধুর সঙ্গে বসে আড্ডা খানিকক্ষণ তো আরেক কোণে আরেক দলের সঙ্গে আবার খানিকক্ষণ। মা খেতে ডাকার আগপর্যন্ত মাতাল আড্ডা। খেয়ে নিয়ে হোমওয়ার্কের পরে ফের মাঠই ঠিকানা। গোল্লাছুট বা দাড়িয়াবান্ধা। কোনো কোনো দিন সাতগুটি। খেলার জোশ এসে গেলে কী যে ভয়ানক কঠিন হয়ে উঠত একেকটা রোদে পোড়া লালচে মুখ... তোর গায়ে লাগছে! ...না লাগেনি। দাগে পা পড়েছে, আউট! না পড়েনি। খেলার শেষ হতো মহা ঝগড়াঝাঁটিতে যেন স্টেডিয়ামে মোহামেডান আর আবাহনীর খেলা শেষে দুমদাম মারপিট দর্শকের সারিতে। খেলা নিয়ে ঝগড়া এমন দিকে যেত যে বলতেই হতো, আর জীবনেও কথা বলব না। আজকে থেকে আড়ি। পরদিন কে জানে কেন সেই আড়ি খাওয়া বন্ধুর সঙ্গে আবার একই দলের সদস্য হয়ে যাওয়া হতো। রিলে রেসের লাঠির টুকরো তার হাতে তুলে দিতে গিয়ে হাতে হাতে ছোঁয়া লাগত। চোখে চোখে ঝগড়া মিটে আবারও বন্ধুত্ব। ওই এক টুকরো ঘাসে ছাওয়া মাঠ যে জীবনের কত রং দেখিয়েছে সকাল-বিকেল... খেলার ছলে কতভাবে জীবনবোধ বপন করে দিয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। বর্ষাকালে সেই মাঠে ঘাসের ডগার নিচে পানি লুকিয়ে থাকত। পায়ের পাতা দিয়ে তির্যকভাবে আঘাত করলেই পানি ছিটকে যেত বন্ধুর গায়ে। সে-ও পা চালাত একইভাবে। আর একসময় সেই ভেজা মাঠে ফুটবল জমে উঠত ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে।

একই শহরে সেই মাঠটি এখনও টিকে আছে কোনো রকমে। আজকের কিশোরকে দেওয়া যায় সেই বৃষ্টিভেজা ফুটবল, খুঁজে পেতে জোগাড় করা সাতটা গুটি, দেওয়া যায় দাড়িয়াবান্ধা বা গোল্লাছুটের দাগগুলো কেটে। সে কি নেবে? তার ঢের কাজ আছে। হাতে আছে চৌদ্দটা ডিভাইস, অনলাইন-অফলাইন ক্লাস আছে, কত কত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে সে! ইচ্ছে করে তার মুঠের ভেতরে গুঁজে দিই ভিন্ন আকৃতির মাটির কলস বা হাঁড়ি ভাঙা সাতগুটির সাতটা আঁকাবাঁকা টুকরো। তারপর তাদের একের ওপরে আরেকটি রেখে বলি, ছোটো! কে ছুটবে? কল্পনায় কোনো কিশোরের না-বুঝতে পারা বোকা বোকা মুখ সামনে আসে। আমাকে কি পাগল ভাববে সে? এসব দিয়ে কী করা যায়, তাকে হয়তো বোঝাতেও পারব কিন্তু ভালো লাগার সংজ্ঞা কি আর একখানে থেমে আছে? ভাবতে পারে সে, আজব, মানুষ যে কীসে মজা পায়!
হালুয়া, ফিরনি-পায়েস আর শিঙাড়া-আলুপুরির মাঝখানে হঠাৎ যেদিন টেবিলে ইন্সট্যান্ট নুডলস এসেছিল– কেউ হয়তো উত্তেজিত হয়েছিল, কেউবা বিস্মিত। তবে সময়মতো দুটো শিঙাড়া আর হালুয়ার বরফির আবেদন কোনো দিন কমেনি। তার সঙ্গে কালেভদ্রে কাচের বোতলে কোক বা সেভেন আপ হলে তো কথাই নেই। এখনকার কাউকে বলতে ইচ্ছে করে কাউনের পায়েস দিয়ে চালের গুঁড়ির রুটি খেতে দেবো, দেখবে কেমন মজা। পায়েসে দেবো নতুন রসের নলেন গুড়। কিন্তু কে চায় ওরকম কিছু খেতে? না মন ভরবে, না পেট। খামোখাই শুকনো রুটি আর অতিরিক্ত মিষ্টি দুধের খাবার। ল্যাকটোজে কত কত অ্যালার্জি এখন, বাদামেও। তার চেয়ে বার্গার, পিৎজা, তিরামিসু... এই বেশ। সুযোগ পেলে নামকরা কফিশপে বসে লাতে বা কাপাচিনো। আহা রে, বাচ্চাটা জানল না ঝোলা গুড়ের স্বাদ, সঙ্গে পাউরুটি বা বাখরখানি কিংবা সেদ্ধ করা মিষ্টি আলু। আর রুটির মধ্যে ঘি-চিনি লাগিয়ে পেঁচিয়ে সিলিন্ডার বানানো? জানল না তার স্বাদও। কিন্তু তাতে কী যায়-আসে, যা যার দরকার নেই, সে তা নেবে কেন! পৃথিবীতে কি মজার খাবারের অভাব পড়েছে?
পোশাকশিল্পে শীর্ষে ওঠা দেশটিতে সবার গায়ে তৈরি পোশাক। সারাবছর। কে বুঝবে কেবল ঈদের সময়ে একটি বিশেষ পোশাক পেতে কেমন লাগে? সারাবছর একটি অতুলনীয় পোশাকের অপেক্ষা, তারপর যথাসময়ে কেনা হলে ঈদ অবধি দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে ভাঁজ আধা খুলে দেখা... বলতে ইচ্ছে করে, আসো তোমাকে সেই বুক ঢিপ ঢিপ করা উত্তেজনা দিই, পুরো ভাঁজ খোলার সাহস নেই, কেউ দেখে ফেলল না তো!
বলতে ইচ্ছে করে, আসো শহরের আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলো দিই, যেখানে আমাদের অপরিপক্ব পাগুলো পড়ত; সারাদুপুর, সারাবিকেল কখনও রোদের তাপ উপেক্ষা করে। মায়ের ভাতঘুমের সুযোগে কখনও অনেক বেশি দূরত্বে। অচেনা ছেলেরা তাকিয়ে আছে, কে জানে কেউ পিছু নিয়েছে কি? পেছনে লাগাতার পায়ের শব্দে আতঙ্ক হতো শুধু কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সাহস হতো না। ছাদ থেকে হয়তো একই পরিচিত মুখকে সাইকেল চালিয়ে দ্রুত চলে যেতে দেখি– আমার জন্যই এদিকে ঘুরঘুর করছে কি? বাড়ি চিনে গেছে! নিশ্চিত হতে পারি না। রাস্তায় দেখা হলে জিজ্ঞাসাও করা যায় না। পাকামো ভাববে। অপেক্ষায় আশঙ্কায় একদিন একাকী রিকশায় বসে কোলের ওপরে নীল খাম পাই। পাশে সাইকেল চালিয়ে সেই চেনামুখ চলে গেল যেন... পড়ে যাওয়ার আগে খপ করে ধরে ফেলি খাম। কাঁপা কাঁপা হাতে খুলি, ভেতরে জলছাপের কাগজে সুন্দর হস্তাক্ষর। গন্ধটা নাকে লেগে থাকে। এমনই বুঝি হয় গোপন চিঠি! চাও সে চিঠি কেউ? ভাঁজ খুলতেই চারদিকে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসে, সঙ্গে আসে কাঠগোলাপের রাত-রাত গন্ধ।

কেউ কি চাইবে জলছাপের কাগজটা– যা চট করে ডিলিট করা যায় না,
বহু বছর পরেও চোখে-নাকে লেগে থাকে? কে জানে, আজকে তোমার হাতে মেসেজ আছে, কত কত ছবি আছে কথা-বলা, আছে ইমোজি আর ভয়েস মেসেজ। এখন আর ফাঁকা রাস্তা কি বাড়ির সামনের বারান্দায় দিনের পর দিন চিঠি পকেটে নিয়ে কোলে বা হাতে দেওয়ার জন্য খুঁজতে হয় না কাউকে। অপেক্ষায় থাকতে হয় না। এই মনে হলো, এই টুক করে বলে দেওয়া গেল না-বলা কথা। ব্যস, হয়ে গেল। কথায় কথায় মিললে মিলন, যুক্তিতে আঘাত লাগলে বিচ্ছেদ। দ্রুত জীবনের পথচলা, দূরত্ব-কল্পনা-অনুমানের জায়গা নেই। জলছাপের সুগন্ধি কাগজ পেলে মানুষ কী করে কে বোঝাবে কাকে! চটজলদি বলে কিছু নেই জীবনে, কাগজটার জবাবের জন্য দিনের পর দিন বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে অপেক্ষা কিংবা কোনো বন্ধু-ডাকপিয়নের খোঁজ কী যে হয়রানি-পেরেশানি, তা কোনো দিন কারও জানা হবে না।
শুধু দিতে নয়, নিতেও চাই বহু কিছু আজকের তোমাদের কাছে। অনিশ্চয়তাটুকু দিয়ে দাও, দিয়ে দাও ধর্মান্ধ আর দলকানা কথাগুলো। সব নিয়ে চলে যাই কোথাও। ডিপ্রেশন, ফেইলিয়র, সাইকোথেরাপি– এসব শব্দ কোথায় ছিল আগে? বাবার রাশভারি একটা ধমক বা মায়ের যুক্তিপূর্ণ একটা অনুরোধ হুট করে হতাশা থেকে বের করে এনে দাঁড় করাত। ইচ্ছে করে নিয়ে যাই তোমার শত পাওয়ার মাঝে এইসব না-পাওয়ার বেদনা। বলি, সবকিছুর পরেও পৃথিবী সুন্দর, তুমি বেঁচে থাকো, বহু বছর পরে তোমার যা কিছু স্মৃতির সম্পদ, তা নিয়ে কাউকে দেবে বলে... এত কী খারাপ জীবন, যা শেষ করে দিতে চাও অঙ্কুরেই! এত মরে যেতে চাও কেন তোমরা? কেউ কেউ সবাইকে কাঁদিয়ে হুট করে চলে যাও! অনিশ্চয়তা কার জীবনে কবে ছিল না। তবে আজকের তোমাদেরই বা দোষ দিই কী করে, সে সময় বাড়ি থেকে বেরোলে কেউ জানত না কখন ফিরব। শুধু জানত না, তা নয়; বরং যোগাযোগই থাকত না না-ফেরা পর্যন্ত। কিন্তু কেমন করে যেন প্রত্যেকে ঠিকঠাক বাড়ি ফিরত। বাবা-মায়ের বুকে স্বস্তি আসত– এই তো এসেছে, সন্ধ্যা হয় হয়, তার আগেই চৌকাঠে পা রেখেছে। কিন্তু আসবে না, সে ভাবনা আসত না। একবারই শোনা গেল এক নীহার বানু ধর্ষণ আর হত্যা মামলা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীরা খুন করে পুঁতে রেখেছিল তাকে। সারা কৈশোর ওই এক আতঙ্ক খেলা করত, কোনো দিন বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা পেরোলে সান্ধ্য আইনের পক্ষের পারিবারিক সদস্যরা বলত, নীহার বানুর কী হয়েছিল মনে নাই?
কিন্তু হায়, আজ কে মনে রাখে কত নীহার বানুকে চরম নির্যাতনে মরে যেতে হয়। কোনো নির্যাতিতের কথা কে ধরে বসে থাকে! কতদিন শোক করবে কেউ কারও জন্য? অলিম্পিকের মনোগ্রামের বৃত্তের মতো একের ওপরে আরেক শোক আছড়ে পড়ে। আগেরটা বাধ্য হয়ে ঝাপসা হয়। শুধ খুন, শুধু ধর্ষণ। আজ তোমাকে কী করে খাঁখাঁ দুপুরের সেই ফাঁকা রাস্তাগুলো দিই! জলবায়ুও যে বদলে গেছে, কোথায় মেঘলা আর ছায়া ছায়া রাস্তা, কোথায় মাস ছয়েকের কুয়াশা মোড়ানো প্রকৃতি! এখন চারদিকে ‘দারুণ অগ্নিবাণ’, যেদিকে তাকাও ‘নাই, রস নাই’। কী করে তোমাকে নিশ্চয়তা দিই, বলি যে, তোমার যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে পূরণ করো গে যাও। বরং দেখি কী করে তিন বছর বয়স হতে না-হতেই তোমার গায়ে প্যাকেটের মতো বোরকা ওঠে, নেকাবে তোমার মুখ পায় এক ছদ্মবেশ। মনে পড়ে, কোনো একদিন কিশোরবেলায় রাতের ভৌতিক ভয় কাটাতে মশারিকে আপন মনে হয়েছিল, যেন এই ঘেরাটোপে কেউ আমার কিস্সু বিগড়াতে পারবে না! তুমিও কি তেমনি ঘেরাটোপে নিশ্চিন্ত? কেউ তোমাকে চেনে না। কেউ তোমাকে দেখেনি কোনো দিন। তোমার চুল বাতাসে ওড়ে না, চোখমুখ থেকে তুমি কোমল হাত দিয়ে অবাধ্য চুলকে বারবার কানের পেছনে পাঠাও না। আজকের তোমাকে আমি কী করে দিই প্রেমময় চোরা-নজর!
তাই তোমাকে শুধু জীবনের কঠিন প্রতিযোগিতা দিই, অনিশ্চয়তা দিই। সস্তা আনন্দ-উত্তেজনা আর দিতে পারি না।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews