নদী ও সাগরের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশে বিদ্যমান সম্পদকে কাজে লাগানোর অর্থনীতিই সুনীল অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংকের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারই হচ্ছে সুনীল অর্থনীতি। ইউরোপীয় কমিশনের মতে, নদী-সাগর-উপকূলের সাথে সম্পর্কিত অর্থনীতিই হচ্ছে সুনীল অর্থনীতি। মাছ ধরা, লবণ আহরণ, পরিবহন, পর্যটন, খনিজ সম্পদ, তেল-গ্যাস উত্তোলন, শৈবাল চাষ এবং জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতÑ সবই সুনীল অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত। আদিকাল থেকেই মানুষের জীবনে নদী এবং সাগরের বিরাট ভূমিকা রয়েছে, যা সময়ের সাথে বেড়েছে। সুনীল অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী মার্তৃক এবং সাগর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতির বিরাট সুযোগ এবং সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুযোগ এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে।
ভূপৃষ্ঠের ৭২ শতাংশ পানি এবং ২৮ শতাংশ স্থল। নদী, সাগর, মহাসাগর নিয়েই এই জলভাগ গঠিত। ঐতিহাসিক কাল থেকেই এই জলপথ দিয়ে বিশ্ববাণিজ্যের সিংহভাগ পরিচালিত হয়ে আসছে। এখনো বিশ্ব আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯০ ভাগ পণ্যের পরিবহন এই পানি পথেই সম্পন্ন হয়। বিশাল এই জলরাশির নিচে তেল, গ্যাস, মনিমুক্তাসহ নানা ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থ রয়েছে, এসবের ওপর ভিত্তি করেই শহর, বন্দর, সভ্যতা ও অর্থনীতি গড়ে ওঠেছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড-এর মতে, ২০১৫ সালে সমুদ্রের সম্পদের মূল্য ছিল ২৪ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যা এখন আরো বেড়েছে। মাছের চাহিদার সিংহভাগই নদী-সাগর যোগান দেয়। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০ কোটি টন এবং বাংলাদেশ প্রায় ৮ লাখ টন মাছ সাগর থেকে আহরণ করে। সাগরের পানি থেকেই সংগৃহীত হয় মানুষের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান লবণ। এ কাজে কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত আছে, যা কর্মসংস্থানের বিরাট একটি সেক্টর। অথচ মানুষ কখনোই নদী-সাগরে মাছ এবং লবণের চাষ করেনি। সবই মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তার উপহার। সাগরবিহীন দেশসমূহ মাছ এবং লবণÑ কোনটাই আহরণ করতে পারে না, সবটাই আমদানি করে।
পৃথিবীর ৪৪টি দেশ স্থলবেষ্টিত, যাদের ভূখ-ের সাথে সাগর নেই। অস্ট্রিয়া, মঙ্গোলিয়া, আজারবাইজান, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, ইথিওপিয়া, কাজাখাস্তান, কিরগিজস্থান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কিমেনিস্তান, বলিভিয়া, বেলারুশ, নেপাল, ভুটান, হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, সার্বিয়া, মালি, নাইজার, জিম্বাবুয়ে, জাম্বিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ সুদানসহ অনেক দেশ এর অন্তর্ভুক্ত। স্থলবেষ্টিত হওয়ায় এসব দেশের কোনো বন্দর নেই। ভারতের বিশাল ভূখ-ের সাথে সাগর থাকলেও, এর উত্তরপূর্ব অংশে অবস্থিত সেভেন সিস্টার্সÑ অরুনাচল, আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা প্রদেশ পুরোপুরিই স্থলবেষ্টিত। অথচ, সাগরের তীর ঘেঁষেই বাংলাদেশের অবস্থান, যা প্রকৃতির অপার দান। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটস্থ মিরসরাই, সিতাকুন্ড, আনোয়ারা, বাঁশখালী এবং মহেশখালীর সাগর তীরবর্তী অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ব্যাপক শিল্পায়ন করতে হবে। তখন বাংলাদেশ একটি ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসাবে গড়ে ওঠবে। মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে জাইকার চুক্তি হয়েছে। এখন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বন্দরটি চালু হলে এখানে সমুদ্রগামী বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। ফলে দেশের আমদানি-রপ্তানি কাজে গতি আসবে, সময় এবং খরচ দুটোই কমবে। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ এই বন্দর ব্যবহার করে ট্রান্সশিপমেন্ট করতে পারবে। ফলে এই বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ বড় অংকের টাকা আয় করতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করবে।
বাংলাদেশ নদী মাতৃক দেশ এবং অসংখ্য নদ-নদী দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদী এবং নদীবন্দরসমূহকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করলে তা দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। নদী পথে আভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহন করলে সড়ক পথে যানজট এবং সময় কমবে। সড়কে চাপ এবং দুর্ঘটনাও কমবে। এসব নদীকে কাজে লাগিয়ে আমরা জাহাজ শিল্পকে এগিয়ে নিতে পারি। ২০০৮ সালের ১৫ মে বাংলাদেশ প্রথম জাহাজ রপ্তানি করে এবং তারপর থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে জাহাজ নির্মাণ এবং রপ্তানি করছে। বর্তমানে আনন্দ শিপইয়ার্ড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, খান ব্রাদার্স শিপ বিল্ডিং কোম্পানি, হাইস্পিড শিপইয়ার্ড, খুলনা শিপইয়ার্ড, মেঘনা শিপ বিল্ডার্স, কর্ণফুলী শিপইয়ার্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান জাহাজ নির্মাণ এবং রপ্তানি করছে। বিশ^ব্যাপী আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান বাহন এই জাহাজ। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জাহাজ নির্মাণে বছরে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে, যা প্রতিবছর প্রায় ৬% বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ তার ১% কাজ করতে পারলে পরিমাণ হবে ৪ বিলিয়ন ডলার, ২% কাজ করতে পারলে পরিমাণ হবে ৮ বিলিয়ন ডলার এবং ৫% কাজ করতে পারলে পরিমাণ হবে ২০ বিলিয়ন ডলার। যথাযথ উদ্যোগ নিলে এটা সম্ভব। নদী পথে ব্যবহারের জন্য লঞ্চ, লাইটার জাহাজ, ফিশিং ট্রলারও নির্মাণ করতে পারি, যা দেশে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করতে পারি। নদীর তীরগুলোতে জাহাজ নির্মাণে অসংখ্য শিপইয়ার্ড গড়ে তোলার বিরাট সুযোগ রয়েছে। জাহাজ নির্মাণ খাতে বিদেশি বিনিয়োগও আনতে পারি ।
পর্যটন বর্তমান বিশ্বে আয়ের অন্যতম একটি উৎস, যা সুনীল অর্থনীতিরই অংশ। কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত রয়েছে। কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর চালু হলে বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক সরাসরি কক্সবাজার আসবে এবং তখন কক্সবাজার একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন নগরীতে পরিণত হবে। এজন্য কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পরিবেশ সুন্দর এবং নিরাপদ রাখতে হবে। সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা এবং সুন্দরবনের যোগাযোগ ও পরিবেশ আরো উন্নত এবং নিরাপদ করলে এসব জায়গায়ও প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটবে। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের সাথে সন্দীপের ফেরি যোগাযোগ চালু হয়েছে। ফলে সন্দীপকে পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন কুতুবদিয়ার সাথেও ফেরি যোগাযোগ চালু করা প্রয়োজন। ফেরি চালু হলে কুতুবদিয়াও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। তাছাড়া মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হলে ওই এলাকায় যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ শুরু হবে তার প্রভাবে কুতুবদিয়া পর্যটন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এজন্য এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের ৭২০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখা রয়েছে। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসারে উপকূল তীরবর্তী বাংলাদেশের মালিকানাধীন সাগর এলাকা ২,০৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার, যা দেশের মূল ভূখ- ১,৪৮,৬৪০ বর্গ কিলোমিটারের চেয়ে প্রায় ১.৪০ গুণ বড়। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের এই বিশাল এলাকার যাবতীয় সম্পদের মালিক। মূল ভূখ-ের মতো এই সাগর এলাকায়ও দেশের অধিকার, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবেশী কোনো দেশ আমাদের সাগর এলাকা থেকে যেন মাছ এবং অন্য কোনো সম্পদ চুরি করতে না পারে সেজন্য কোস্ট গার্ড এবং নৌবাহিনীকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনশক্তি ব্যবহার করে এই এলাকা থেকে প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা যেতে পারে, যা দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এই সাগর এলাকায় তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের বিপুল মজুদ রয়েছে। এসব খনিজ সম্পদ আহরণের উদ্যোগ নিতে হবে। সাগরের তলদেশ থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলন করতে পারলে তা দেশের বিকাশমান শিল্প কারখানাকে গতিশীল এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। পাশাপাশি নদী ও সাগরের পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে, যাতে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]