রাব্বি, তুমি বাড়ি ফিরে যেতে পেরেছ তো? রাব্বি, তোমার মায়ের জন্য কেনা লাল শাড়িটা কি মাকে দিতে পেরেছ? ১৫-১৬ বছরের ছেলের হাত থেকে শাড়ি পেয়ে মা কি আনন্দে হাসছিলেন? রাব্বি, আমি নিশ্চিত বলতে পারি, শাড়ি পেয়ে মা চোখের জল মুছেছেন, কিন্তু সবচেয়ে খুশি হয়েছেন তিনি তোমাকে পেয়ে।

আমরা প্রথম আলো অনলাইনে আসাদুজ্জামানের লেখা ‘রাব্বির ঈদযাত্রা নামের লেখাটি পড়ে আবেগাপ্লুত হয়েছি। কিশোর রাব্বি কয়েক বছর আগে রংপুর থেকে ঢাকায় আসে। প্রথমে কাজ নেয় হোটেলে, ১২ বছর বয়স থেকে সে কাজ করে ফটোকপির দোকানে। থাকে ঢাকার ফকিরার পুল মেসে, খালাতো ভাই মনিরের সঙ্গে। ঈদে সে যাবে বাড়ি। মায়ের জন্য কিনেছে লাল শাড়ি, বাবার জন্য সাদা পাঞ্জাবি, ছোট ভাইয়ের জন্য শার্ট-প্যান্ট আর ছোট বোনের জন্য হলুদ জামা। সেসব দুটো ব্যাগে ভরে নিয়ে সে আসে কমলাপুর রেলস্টেশনে। শুক্রবারে সে রংপুর এক্সপ্রেসের টিকিট কিনেছিল, ট্রেন ছাড়ার কথা শনিবারে। শনিবারে রাত নটার ট্রেন ধরবে বলে সে আসে স্টেশনে, এসে শোনে, ট্রেন আগেই চলে গেছে। রাতের বেলা সে চেষ্টা করে লালমনিরহাট এক্সপ্রেসে উঠতে। ভিড়ের কারণে পারেনি। সারা রাত স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে সে ঘুমিয়ে ছিল। ব্যাগকে বানিয়েছিল বালিশ। কারণ, ব্যাগের ভেতরে তার প্রিয়জনদের জন্য উপহারগুলো আছে। সেগুলো যেন কেউ না নিয়ে যায়। মায়ের জন্য লাল শাড়ি, বোনের জন্য হলুদ জামা। রোববার সারা সকাল সে কাটিয়েছে স্টেশনে, শুধু ঝালমুড়ি জুটেছে কপালে।

তারপর দুপুরের দিকে আসে রংপুর এক্সপ্রেস। ছাদের ওপরে জায়গা হয় তার। সেই রংপুর এক্সপ্রেস কখন পৌঁছেছিল রংপুরে? রাত দশটায়? বারোটায়? দুটোয়।

কল্পনা করতে পারি, রাতদুপুরে রংপুর স্টেশনে নেমে রিকশা নিয়েছে রাব্বি। লালবাগ রংপুর স্টেশন থেকে মাইল তিনেক দূরে। অত রাতে কে আর জেগে থাকবে বাড়িতে? কিন্তু মা ঠিকই জেগে ছিলেন। মা বলে ডাকতে না ডাকতেই খুলে গেছে দরজা। আয় বাবা, ম্যালা রাত হইল? মুখটা শুকনা ক্যানে? খাস নাই কিছু। হাতমুখ ধুয়া নে। মুই ভাত গরম করি আনোম।

ভাইবোনেরা চোখ মুছতে মুছতে উঠে এসেছে। বোন রাবেয়া কত বড় হয়ে গেছে, ভাই শুকুর আলী কি শুকিয়ে গেছে খানিক!

আমরা কল্পনার চোখে দেখতে পাই, রাব্বি ব্যাগ খুলে প্রথমে বোনের হাতে তুলে দিয়েছে হলুদ জামা, তারপর ভাইয়ের হাতে শার্ট-প্যান্ট। বাবা উঠে আসেন সবার শেষে। তাঁকে সে দেয় সাদা পাঞ্জাবি।

মা তো ব্যস্ত ছেলের জন্য ভাত-তরকারি গরম করা নিয়ে। মা, এদিকে আসো, দেখো, তোমার লাগি কী আনছি, লাল রঙের শাড়ি...

বিদ্যুৎবাতির আলোয় মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, লাল শাড়িতে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরখানা লাল দেখায়, আর মায়ের হাসিভরা চোখের কোণের অশ্রুবিন্দুতে হলুদ আলো আর লাল ছায়া খেলা করে।

মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। মায়ের শাড়িতে এখনো সেই পুরোনো গন্ধ, রাব্বি চোখ বুজে জোরে শ্বাস নেয়।

এই তো আমার বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশে ঈদ মানে বাড়ি ফিরে যাওয়া। বাংলাদেশে ঈদ মানে মায়ের কাছে যাওয়া। বাংলাদেশে ঈদ মানে ছেলেবেলার খেলার সাথি, স্কুলের বন্ধুদের আবার ফিরে পাওয়া। আজ মাশরাফি হয়ে উঠবেন কৌশিক, চিত্রা নদীর সাঁতারের বন্ধুরা ঘিরে থাকবে তাঁকে, তামিম হয়ে উঠবেন চট্টগ্রামের তামিম, মুশফিক বগুড়ার মুশফিক।

সবার ঈদযাত্রা যেন শুভ হয়। সারা দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ঈদ উদ্‌যাপিত হচ্ছে, কোথাও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি আজ এখন পর্যন্ত। তা-ই যেন হয়।

সবাই নির্বিঘ্নে ঈদ করুক আর ঈদ শেষে যার যার কাজের জায়গায় ফিরে আসুক নিরাপদে।

গতকাল সন্ধ্যায় চাঁদ দেখার খবরের সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের চ্যানেল ঢুরতে শুরু করি। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ওই অবিস্মরণীয় গানটা শুনলেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’। শোনা গেল গানটা, তবে এত রিমিক্স করা যে মন ভরছিল না। শেষে একটা চ্যানেল আদি গায়কিতে গানটা শুনে শ্রুতি তৃপ্ত হলো। ওই গানের দ্বিতীয় লাইনটাও তাৎপর্যপূর্ণ—‘তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।’

নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই তো সবচেয়ে কঠিন।

ঈদের নামাজ পড়তে যখন যাই, দুধারে এত সাহায্যের হাত দেখি, তারা কীভাবে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নারী-পুরুষ বৃদ্ধ-শিশু, দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল। এমন বাংলাদেশ কবে আসবে, যখন পথের ধারে কোনো সাহায্যপ্রার্থী হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না।

অবশ্য বাংলাদেশ সচ্ছল হচ্ছে, এখনই কাঙালিভোজের জন্য কাঙাল পাওয়া যায় না, বিশেষভাবে ব্যবস্থা নিয়ে জোগাড় করতে হয়। বাংলাদেশ সচ্ছল হোক, আত্মমর্যাদাবান হোক, তার ‘ব্যবস্থা’ এমন হোক, যাতে ব্যবধান না থাকে মানুষে মানুষে। কাজী নজরুল ইসলাম রমজানের ওই রোজার শেষে গানে প্রেমের কথা বলেছেন, দোস্ত-দুশমন ভুলতে বলেছেন। আমাদের ইমাম সাহেবও বললেন, আজকের দিনে পুরোনো শত্রুতা ভুলে যান, নিজে এগিয়ে গিয়ে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুন। কাজী নজরুল ইসলাম বলছেন, তোমাকে যদি কেউ শত্রুতাবশত ঢিল পাথর ছুড়ে মারে, তুমি সেই পাথর কুড়িয়ে নিয়ে প্রেমের মসজিদ গড়ে তোলো।

ঈদ আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আর সম্প্রীতি ছড়িয়ে দিক।
২৬ জুন, ২০১৭।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews