‘জাতীয় সম্পদ এভাবেই ধ্বংস হয়’-এ ক্ষোভের কথা অভিনেত্রী সুচন্দার। তাঁর প্রয়াত স্বামী বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের নামে এফডিসিতে স্থাপন করা হয়েছিল ‘জহির রায়হান কালার ল্যাব’। প্রায় এক যুগ ধরে অব্যবহৃত থাকা এ ল্যাবটি দেখভালের অভাবে এখন ধ্বংস হতে বসেছে। এখানে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার মেশিন ও যন্ত্রপাতি। অথচ ল্যাবটিকে আর্কাইভ করে একে সংরক্ষণ করা যেত। এফডিসিতে এমডি আসে এমডি যায়। কিন্তু এ কালার ল্যাবের প্রতি কারও নজর পড়ে না। অভিনেত্রী সুচন্দার কথায়- অনেক মেশিন এবং যন্ত্রপাতি নেই এবং অনেকগুলো আবার যতেœর অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি যা আছে তা-ও নষ্টের পথে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় এগুলোকে ভাঙারির কাছে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। অথচ এক সময় এফডিসিকে চলচ্চিত্র নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে এবং দেশেই রঙিন ছবি নির্মাণে এখানে স্থাপন করা হয়েছিল জহির রায়হান কালার ল্যাবটি। এ ল্যাবে কালার নেগেটিভ পরিস্ফুটন করে সপ্তাহে আয় হতো প্রায় ২ কোটি টাকা। মানে মাসে এখান থেকে আয় ছিল কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। ঈদে এ আয় বেড়ে দাঁড়াত প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে এফডিসির ব্যয় নির্বাহ করে আরও টাকা জমা থাকেত। এফডিসিতে ৩৫ মিলিমিটার কালার ফিল্ম ডেভেলপের জন্য ১৯৮৩ সালের ১৪ মার্চ জহির রায়হান কালার ল্যাবের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদ। ওই সময় এফডিসির এমডি ছিলেন কর্নেল শাহাবউদ্দীন। এরপর থেকে দেশেই রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণে নেগেটিভ পরিস্ফুটন শুরু হয়। তখন এ দেশে ৩৫ মিলিমিটারের চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং এর জন্য নেগেটিভ ব্যবহার করা হতো। এ পদ্ধতির চলচ্চিত্র নির্মাণকে এনালগ প্রযুক্তির চলচ্চিত্র বলা হতো। কিন্তু ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় এবং ডিজিটাল যুগের সূচনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এফডিসির অ্যানালগ যুগের প্রযুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এফডিসির একটি সূত্র জানায়, ২০১১ সাল পর্যন্ত জহির রায়হান কালার ল্যাব থেকেই প্রতিষ্ঠানটির ৮০ ভাগ আয় হতো। সর্বশেষ একটি ছবির প্রিন্ট বাবদ আয় ছিল ৯০ হাজার টাকা। এ আয় দিয়েই সচ্ছলভাবে এফডিসি চলত। ২০১২ সাল থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছবি নির্মাণ শুরু হলে ধীরে ধীরে ল্যাবে কাজ কমে আসতে থাকে। সর্বশেষ এ ল্যাবে কাজ হয় ২০১৪ সালে। তখন এখানে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ও ডিএফপির জন্য দু-একটি প্রিন্টের অর্ডার পাওয়া গেলেও তা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। এরপর এ ল্যাব একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির চলচ্চিত্র নির্মাণে আর নেগেটিভ ব্যবহার হয় না বলে প্রিন্টের প্রয়োজন পড়ে না। অথচ নেগেটিভ ফিল্মের যুগে ল্যাবে কাজের জন্য নির্মাতারা সহজে সিরিয়াল পেতেন না। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে সময়মতো প্রিন্ট ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা চলত। এখন প্রায় জনশূন্য ও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এফডিসির প্রশাসনিক ভবনের নিচতলায় অবস্থিত জহির রায়হান কালার ল্যাবটি। প্রতিষ্ঠানটির মূল আয়ের উৎসই ছিল নেগেটিভ ফিল্ম বিক্রি, ল্যাবরেটরিতে শুটিংকৃত ফিল্মের ডেভেলপ, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ইন্সট্রুমেন্ট এবং শুটিং ফ্লোর ও স্পট ভাড়া দেওয়াসহ ডাবিং-এডিটিং ইত্যাদি। এসব আয়ের উৎস এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। ফলে আয়ও কমে গেছে। চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এফডিসি প্রধান আয় সংকটে পড়েছে জহির রায়হান কালার ল্যাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। জানা গেছে, হলিউড বলিউডে এখনো ৩৫ মিলিমিটারে নেগেটিভের মাধ্যমে অনেক ছবির দৃশ্য ধারণ হয়ে থাকে আর এর জন্য কালার ল্যাবও ব্যবহার হয়ে থাকে। যা এদেশেও হতে পারত। কিন্তু নির্মাতারা নাকি ব্যয় কমানের জন্যই এটি করেন না।

চলচ্চিত্রকাররা বলছেন, ‘এ কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই যে সময়ের দাবিতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অ্যানলগ প্রযুক্তি বিলুপ্ত হয়েছে ও বর্তমান সময়টা আধুনিক প্রযুক্তির পথে হাঁটছে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এভাবেই এগোতে হবে। তাই বলে এফডিসির এ মূল্যবান ল্যাবটির দামি জিনিসপত্রকে কেন অবহেলা করে নষ্ট করতে হবে। এগুলো জাতীয় সম্পদ, জনগণের করের টাকায় কেনা। ল্যাবের মেশিন ও যন্ত্রপাতি নষ্ট না করে তা আর্কাইভ করে রাখা যেতে পারে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম অ্যনালগ চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে ধারণা লাভ ও এ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা এখান থেকে তাদের লেখাপড়ার তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পেতে পারে। জহির রায়হান কালার ল্যাব পরিদর্শন করে ও এ সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ল্যাবটি দেখাশোনা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো লোকবল দীর্ঘদিন ধরেই নেই। মাঝেমধ্যে ঝাড়ুদাররা গিয়ে ঝাড়ু দিয়ে আসে। সরেজমিনে দেখা গেছে, এখানে এখন ভগ্নদশায় রয়েছে ফিল্ম প্রসেসিং মেশিন ১টি, সাউন্ড নেগেটিভ মেশিন ১টি, পজিটিভ ফিল্ম ডেভেলপ মেশিন ১টি, ফিল্ম ক্লিনিং মেশিন ১টি, প্রিন্টিং মেশিন ১টি এবং ৩৫ মিলিমিটারের কালার এনালাইজার মেশিন ১টি। এসব মেশিনের একেকটির  ওজন ৫ থেকে ১০ টন বলে জানিয়েছেন সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, অনেক মেশিন ভাঙা অবস্থায় এবং কিছু যন্ত্রপাতি খোয়া গেছে। এফডিসির কর্তাব্যক্তিদের কাছে ল্যাবটিকে আর্কাইভ করে তা সংরক্ষণ করা হবে কিনা জানতে চাইলে বলা হয়-‘হ্যাঁ আমরা এখন সেই

চিন্তাভাবনাই করব।’



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews