তৈমূর আলম খন্দকার
মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে পরিহার করে সভ্যতার দিকে মানবসমাজ অগ্রসরমান বা ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ সভ্য সমাজ তার মাপকাঠিতে পূর্ণতা লাভ করেছে, কথাটি কি সঠিক? সভ্যতার সংজ্ঞা কী? পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর পরিবর্তে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালালেই কি মানুষ সভ্যতার শিরোমণি হয়ে যায়? নাকি গাছের ছাল দিয়ে লজ্জা নিবারণের পরিবর্তে স্যুট-প্যান্ট পরিধান করলেই ‘সভ্য’ হয়ে গেল, নাকি যে মানুষ গাধার পিঠে চড়ত, সে মানুষ এখন রকেটে চড়ে গ্রহ-নক্ষত্র-নভোমণ্ডল পরিভ্রমণ করছে, এটাই কি সভ্যতা? বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কারের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু মানবজীবন অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে জীবনযাত্রা, মন-মানসিকতা কি ‘মানসম্মত’ হয়েছে?
মধ্যযুগীয় লোমহর্ষক বর্বরতার কথা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। প্রাক-ইসলামিক যুগটি আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ হিসেবে পরিচিত। সে যুগে দুর্বলের ওপর বিনা বিচারে চলত সবলের অত্যাচার, কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দেয়া, নারীদের যৌনদাসী হিসেবে হাটবাজারে বিক্রি করা হতো, মনিবের ঔরসে দাসীদের গর্ভের সন্তানদের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। মোটা দাগে বলতে হয়, মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র প্রভৃতি শব্দমালা তখন আবিষ্কার হয়নি। তলোয়ার চালাতে যে যত শক্তিমান, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ছিল ‘আইন’, হোক তা পাশবিক বা কল্যাণকর! প্রাক-ইসলামিক যুগে সবল দ্বারা দুর্বল যেভাবে নির্যাতিত হতো, এখন কি তার পরিবর্তন হয়েছে? বর্বরতার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং কৌশল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় এক নায়কতন্ত্রের পরিবর্তন কি হয়েছে?
বর্তমানে মানুষ শিক্ষাদীক্ষা ও বিজ্ঞানের চরম শিখরে পৌঁছলেও নৈতিকতা ‘মানসম্মত’ হয়েছে কি? আন্তর্জাতিক রাহুগ্রাস ছাড়াও পিতা-পুত্রকে, জন্মধাত্রী মা তার সন্তানকে, স্ত্রী স্বামীকে ও স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করছে, প্রেমিক-প্রেমিকাকে, বন্ধু প্রতারণা করছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে। যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করা হয়, সেই আঘাত হানে সঙ্গোপনে। সীমা অতিক্রম করে যার উপকার করা হয়, সেই চোখ পাল্টিয়ে চরম বিরোধিতা করে, সর্বোপরি বর্তমান সমাজে চলছে এ অস্থিরতা।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পরই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে, সর্বস্তরের মানুষ ফিরে পায় তাদের ন্যায্য অধিকার। শুধু ইসলাম কেন, সব ধর্মের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য ধর্মের আবির্ভাব। অথচ এক শ্রেণীর মানুষ ধর্মকে আঘাত করে নিজেকে প্রগতিশীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য; সরকার এদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিসেবে জাহির করতে চায়।
কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ ধর্মকে আঘাত করেই নিজেকে ‘প্রগতিশীল’ বানাচ্ছে। প্রগতিশীল অর্থ কী? কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ এবং ধর্মের বিরুদ্ধে দু-চার লাইন কবিতা লিখলেই সে কি প্রগতিশীল? ধর্মের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও অশালীন কথা বলে বড় কবি হয়েছেন কেউ কেউ।
ধর্মবিহীন জীবন থেকেই হতাশার জন্ম এবং হতাশা থেকে মানুষ উদ্ভট কথা বলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করে; এ জন্য যে তারা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছে, ফলে তারাই প্রগতিশীল। এ প্রগতিশীলেরা সরকার কর্তৃক মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে কথা বলে না, বরং সরকারের আঁচলের তলে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং সরকারও ‘ডাস্টবিনের’ মতো তাদের ব্যবহার করছে।
অনেক অজ্ঞতার মাঝেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার ‘স্বাধীনতা’, অর্থাৎ বাংলাদেশ এবং ‘আল্লাহ’ (যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং ইহকাল ও পরকালে আমার মালিক)। বিশ্বাস ও আনুগত্যের প্রশ্নে এ দুটো বিষয়ে আমি কোনো প্রকার আপস করি না। শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এক সময় বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু না মুসলমান এটা আমাদের যতটা না পরিচয়, তার চেয়ে বড় পরিচয় আমরা বাঙালি।’ এ মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সবিনয়ে দ্বিমত পোষণ করে দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, ‘আমি একজন বাংলাদেশী এবং একজন মুসলমান।’ পাশাপাশি অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি তার ধর্মের পরিচয়ে গৌরবান্বিত হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। এতে বাধা দেয়াই সাম্প্রদায়িকতা। ইসলাম সাম্প্রদায়িকতা সমর্থন করে না। তারপরও গোটা বিশ্ব মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।
নাস্তিকতা জঙ্গিবাদকে উসকানি দিচ্ছে। নাস্তিকতা ও জঙ্গিবাদ পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা থেকে সৃষ্ট, যার কোনোটার প্রতিই জনগণের সমর্থন নেই। জনগণের সমর্থন ছাড়া কোনো ‘বাদ’ই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। পাকিস্তানিদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের কোনো প্রকার সমর্থন ছিল না বলেই ৯৩ হাজার সুসজ্জিত চৌকস সৈন্য ও গোলাবারুদ মজুদ থাকার পরও স্বেচ্ছায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানিদের প্রতি এ দেশবাসীর যদি বিন্দুমাত্র সমর্থন থাকত, তবে এভাবে তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা নয়।
‘জনসমর্থন’ পৃথিবীর যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী। শক্তি (জনসমর্থন) বুঝতে যে ভুল করেছে, সে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন ধ্বংস অনিবার্য, এটাই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
দেশব্যাপী আলাপ-আলোচনা, বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিশিষ্টজনরা এই অভিমত ব্যক্ত করছেন, জঙ্গিবাদ যতটুকু না আছে বা নির্মূল হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি সরকার প্রচার-প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, শুধু বহির্বিশ্ব থেকে সমর্থন আদায়ের জন্য এ কারণে যে, সরকার নিজে জানে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার প্রশ্নে তাদের ভিত কতটুকু শক্ত? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রবৃত্তি আগেও ছিল, বর্তমানেও আছে। বিশ্বের যারা মুরব্বিয়ানা করে, অথচ নিজেরাই সন্ত্রাসী (আমেরিকা) তারাও বলেছে, জঙ্গিদের হত্যার পরিবর্তে জীবিত ধরে তাদের কাছ থেকে জঙ্গিবাদের তথ্য-উপাত্ত আদায় করতে হবে। এ দাবি এখন সবার পক্ষ থেকে। জীবিত রাখলে থলের বিড়াল বেরিয়ে যায় কি না এ ধরনের অভিমতও রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে করা হচ্ছে।
হোলে আর্টিজান দেশবাসীকে একটি নতুন মেসেস দিয়ে গেল। সরকার, সরকারি প্রচারযন্ত্র, সরকারপন্থী নাস্তিক ও বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করে বেড়াত যে, মাদরাসায় জঙ্গি ট্রেনিং দেয়া হয়, মাদরাসার ছাত্ররাই জঙ্গি। ফলে মাদরাসায় কোনো সাহায্য না দেয়ার জন্য সুদূর লন্ডন, আমেরিকা পর্যন্ত নাস্তিকেরা অপপ্রচার করে বেড়াত। হোলে আর্টিজান তাদের মুখে চুনকালি মেখে প্রমাণ করেছে যে, মাদরাসার ছাত্ররা নয়, বরং ইংরেজি শিক্ষিত ও সরকারি ঘরানার পুত্ররাই এ খাতায় নাম লিখিয়েছে।
নাস্তিকতা ও জঙ্গিবাদ উভয়ই জনসমর্থনহীন পরস্পরবিরোধী হলেও নাস্তিকেরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, কোথাও কোথাও পুরস্কৃত করা হচ্ছে এ জন্য যে, এতে বিদেশীরা খুশি হয়। সমকামী হত্যা হলেও আমেরিকার টানাপড়েন শুরু হয়, কারণ আমেরিকা অশ্লীল সমকামিতাকে উৎসাহিত করে। অতএব, আমেরিকার খুশিই আমাদের খুশি হওয়ার কারণ হতে পারে না। নাস্তিকতা, অশ্লীলতা, অপসংস্কৃতি, জবরদখল, গৃহবিবাদ, গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ সব কিছুই আমেরিকার সৃষ্টি। আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আইএস আমেরিকার সৃষ্টি।’ প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রেই আমেরিকা বিভিন্ন অজুহাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।
ধর্মের যারা বিরোধিতা করে পৃথিবীতে, তাদের শেষ বিদায় কিন্তু ধর্মীয় বিধি মোতাবেক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। এখন তো টাকা দিলেই বা টাকা না দিলেও প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে একশ্রেণীর মৌলভী-মাওলানা মাথা বিক্রি করে দিচ্ছেন। নতুবা ধর্মবিরোধীদের জানাজা হয় কিভাবে? মুসলিম নামধারী নাস্তিকদের জানাজা তো আর তাদের সন্তানেরা পড়ায় না। ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন কোনো না কোনো মৌলভীকেই তো জানাজা পড়াতে হয়! ধিক্কার জানাই সেসব মৌলভী-মাওলানাকে, যারা আত্মস্বীকৃত নাস্তিকদের জানাজা পড়ানোর জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন। তাদের ঈমান ও লাজ-শরমের অভাব আছে বলেই নাস্তিকদের বেহেশতে নেয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। যারা আল্লাহ পাকের অস্থিত্বই স্বীকার করে না, তাদের জন্য দোয়া কেন? এটা কি রসিকতা নয়?
নাস্তিকদের আচরণ হিংস্র পশুর চেয়েও হিংস্র, তাদের বক্তব্যে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলা একটি ফ্যাশন। দু-একজন নীতিনির্ধারকও রয়েছেন, যারা ধর্মকে কটূক্তি করে কথা বলেন। তাদের শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধানে হওয়া কি বাঞ্ছনীয়?
এ দেশে সরকারপন্থীদের সমালোচনা করলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সাজা হয়। ওই আইনে সম্ভব না হলে হাতে গাঁজা ধরিয়ে দিয়ে দুই বছর সাজা দেন। অন্য দিকে আল্লাহ-রাসূলের সমালোচনা করলে দেশজোড়া খ্যাতি অর্জন করে খেতাব পায় প্রগতিশীল।
লেখক : আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com