প্রিয় পাঠক, প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, একজন বড় লেখকের কথা বলতে গিয়ে নিজের গল্প দিয়ে শুরু করার জন্যে। গল্পের নাম, দুঃখ কষ্টের গল্প। বাবাকে নিয়ে। মনে পড়ে, সারারাত জেগে, বলা যায়, একটানে গল্পটি লিখেছিলাম, আর লিখেই পরদিন দুপুরে দৈনিক বাংলায় কবি-সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আহসান হাবীবের টেবলের সামনে
হাজির। শুকনো মুখ আর চোখে নিদ্রাহীনতার ক্লান্তি দেখে হয়তো মায়া হয়েছিল, হাবীব ভাই গল্পটি ছেপেছিলেন রবিবাসরীয় সাহিত্য পাতায়। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত আমার প্রথম গল্প। অই গল্পের একটি চরিত্র, টুনটুনি। পায়ে সমস্যার কারণে একটু বাঁকা হয়ে হাটা বাস্তব চরিত্র। হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ এবং‘শঙ্খনীল কারাগার’ পড়ে আমি, সত্যি বলতে কি, তরুণ বয়সে গল্পটি লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। কিংবা বলা যায় বাধ্য হয়েছিলাম। দুঃখ কষ্টের গল্প-এর জন্মের সুতিকাগারে এই শুভ্র-সত্যটি লুকিয়ে আছে। এখনো মাঝে মাঝে আমার মনোজগতে ভেসে ওঠা ‘নন্দিত নরকে’র মন্টু একটি বাস্তব চরিত্র। টুনটুনির মতো। অনেকটা যেন উডি এলেনের ছবি ‘পারপল রোজ অব কায়রো’র অবাস্তব জগতের পর্দা থেকে বাস্তবে নেমে আসা নায়ক চরিত্রটির মতো। হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য চরিত্রে আছে বাস্তব-অবাস্তবের এই মহামিলন। আছে জীবন্ত হয়ে ওঠা অবাস্তবতার হিরন্ময় জগত।
বাস্তব-অবাস্তবের অই হিরন্ময় জগত থেকে এবার ফিরে আসি প্রকৃত বাস্তবে।
আমরা সেবার, ক্যামেরার মানুষ নাসির আলী মামুন ও আমি নুহাশ পল্লী গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে।
গাড়িতে তিনি একের পর এক গল্প বলে যাচ্ছিলেন।“ শুরু করি সুলতানকে দিয়ে। খুবই বড় মাপের শিল্পী। তাঁর
রং ও ব্রাশ দুটোই খুব পাওয়ারফুল। নাসিরের তো একটা এলবাম আছে তাঁকে নিয়ে। চমৎকার। তো ভাবলাম, এতোবড় একজন শিল্পীÑ এর সঙ্গে আমার ছেলেমেয়েদের পরিচয় হওয়া দরকার। স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে নড়াইলে গেলাম তাঁর ওখানে। শিল্পী ও তাঁর পরিবেশ পারিপার্শি¦কতা দেখে আমার ছেলেমেয়েরা তো অবাক। স্বাভাবিক। সুলতান ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের মানুষ। তিনি নিজস্ব যে জগতে বাস করতেন অই জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন, খাতির যতœও করলেন। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল এ পর্যন্ত। ফেরার সময় ফিসফিস করে বল্লেন, বড় যন্ত্রনায় আছি ভাই।
কেন কী হয়েছে?
খালি কানের কাছে বিড়বিড় করে।
কারা ?
কারা আবার! জ্বীনেরা। ভাই এই জ্বীনদের যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে আছি। সারাক্ষন কানের কাছে বিড়বিড় করে। কী যে বলে কিছুই বুঝি না।”
জ্বীনদের কথা উঠলো যখন এবার একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলি।
আমার এক বোনের মেয়ে, নামটি উহ্য রাখলাম। আচ্ছা ধরা যাক, ওর নাম পরী। নাম পরী হলেও ও দেখতে মোটেই পরীদের মতো নয়। তবে একবারে ফেলানিও না। বাংলাদেশে ‘ফেলানি’দের বিয়ে হতে সময় লাগে, ওর লাগেনি! ওর বিয়েও হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের এমন কোনো লেখা নেই যা ও পড়েনি। ওর প্রিয় চরিত্র হিমু নয়, মিসির আলী। হিমুকে ওর ভালো লাগে না। কারণ, হিমু খালি পায়ে হাটে। আর হলুদ রং ওর খুব অপছন্দের। যে কারণে গাঁেয় হলুদের সময়, তখন ছিল শীতকাল, ও একটু ঝামেলা করেছিল।
২০১০ এ আমি যখন বাংলাদেশে গেলাম পরী তখন শ্বশুড় বাড়ি থেকে পিতৃগৃহে, ইচ্ছে করে যে বেড়াতে এসেছে তা নয়। বিয়ের দু’বছরের মাথায় ওর স্বামী ও শ্বশুর এসে ওকে বাবার বাড়ি রেখে গেছে। অভিযোগ, ওর মাথায় ‘ছিট’ আছে। শীতকালে ও অনর্গল কথা বলে একা একা। বৌকে চিকিৎসা করানোর সময় ও সাহস স্বামীর নেই। কিছু পুরুষ মানুষ আছে, বাইরে বাঘ আর ঘরে বিড়াল। পরীর স্বামী এই গোত্রের। সে রাজনীতি নিয়ে সদা ব্যস্ত। সবসময়ই সরকারী দলে থাকে। তার বাড়িতে নৌকা, ধানের শিষ আর লাঙ্গলের পাশাপাশি হাসিনা, খালেদা ও এরশাদের ছবি মজুদ আছে। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের অধিপতি দেয়ালে উঠে যায়। তো আমি ওকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, ...তা বাবাজি এভাবে বারবার দল বদল..., উত্তরে কোনো রাখঢাক নেই, বল্লো, আঙ্কেল আমিতো বদলে যাইনি। আমিতো আমার জায়গায়ই আছি। সরকার বদলে গেলে আমার কী দোষ।
পরীর চিকিৎসার দায়ীত্ব তাদের নয়। শ্বশুরের এক কথা, জেনেশুনেই ওরা ছিটগ্রস্থ মেয়েকে ছেলের সঙ্গে গছিয়ে দিয়েছে। পিতা মহাদয়ের এই অকাট্য যুক্তির সামনে ‘বিড়াল’ স্বামীর মিউমিউ করা ছাড়া আর কীইবা করার আছে।
পরী আমাকে দেখেই বল্লো, মামা তুমিতো খুব বিখ্যাত হয়ে গেছ। জানো?
কিভাবে?
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর আত্মজীবনী ‘ফাউন্টেনপেন’ এ তোমাকে নিয়ে লিখেছে। তোমাকে বিখ্যাত করে দিয়েছে। তুমি খুশি না?
বাহ, খুশি হবো না কেন? উঁনার মতো একজন জনপ্রিয় প্রতিভাবান লেখক আমার মতো একজন মেধাহীন মানুষের কথা লিখেছেন এটাইতো আমার জন্যে যথেষ্ট। আমাদের দেশের বড় লেখকরা তো কারো নামই উচ্চারন করতে চায়না।
তোমাকে একটা কথা বলি। উঁনার উচিত হয়নি তোমাকে নিয়ে লেখা।
তা কেন ?
কারণ তুমি হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে যা খুশি তাই লিখেছো। যে সাক্ষাৎকারটির কথা উনি উল্লেখ করেছেন সেটি আমি কয়েকবার পড়েছি তোমার ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ’ বইটিতে। দেশি-বিদেশি লেখকদের কথা বলে আর নানা কায়দা কৌশল করে তুমি প্রমাণের চেষ্টা করেছো যে উঁনি কোনো বড় লেখকই না। আমার কী মনে হয়েছে জানো, তুমি উঁনার ভালো ভালো বইগুলো পড়ে দ্যাখোনি। একটিও না।
এই অভিযোগটি সর্বাংশে সত্য নয়।
হান্ড্রেট পারসেন্ট সত্যি। মনে পড়ে, আমি তোমাকে হুমায়ূন আহমেদের মাত্র পাঁচটি বইয়ের নাম বলেছিলামÑ তুমি একটিও পড়োনি। তারপরও উঁনি খুব মহৎ ও বড় হৃদয়ের মানুষ বলেই তোমাকে নিয়ে লিখেছেন।
বড় লেখকরা এরকমই হয়, মহৎ এবং বড় হৃদয়ের মানুষ।
পরীর সঙ্গে উপরুল্লিখিত কথোপকথনে আমার একবারও মনে হয়নি, ওর মাথায় ছিট আছে কিংবা ও শীতকালে একা একা কথা বলার মানুষ।
বরং মনে হয়েছে ওর প্রতিটি কথা যুক্তিপূর্ণ। ও হুমায়ূন আহমেদ’কে একজন বড় মাপের অসাধারন লেখক মনে করে।
বল্লাম, আমিও ওর সঙ্গে একমত। হুমায়ূন আহমেদ এই সময়ের সবচে’ জনপ্রিয় লেখক। এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
গল্পের চৌকষ কারিগর হুমায়ূন আহমেদ নিষ্ঠা মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে আমাদের সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তোলার জটিল ও দুরুহ কাজটি সপন্ন করেছেন। যা এর আগে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের হাতেই সম্পন্ন হয়েছিল।
গল্পের কথা বলতেই পরী বল্লো, তোমাকে একটি তথ্য দেবো হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে যা তুমি জানো না। কেউ জানে না। তবে প্রমিজ করতে হবে তুমি আমার একটি অনুরোধ রাখবে।
তথ্যটি আগে শুনবো। তারপরে প্রমিজ।
নো, আগে প্রমিজ তারপর তথ্য।
ওকে, প্রমিজ।
তুমি আমাকে নুহাশ পল্লী নিয়ে যাবে ?
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে বলতে পারবো। ( কর্তৃপক্ষ মানে অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম )। তবে নিয়ে
যেতে পারবো আশা করি। এবার তথ্যটি বলো।
কাউকে বলবা না তো।
না, বলবো না। এবার বলো।
আমি মরে গেলে তারপর বলতে চাইলে বলবে।
উহ গড! এতো প্যাচাচ্ছো কেন ? তুমি এতো তারাতারি মরছো না। তথ্যটি এবার শুনি।
তথ্যটি হুমায়ূন আহমেদের গল্প নিয়ে। আই মিন তাঁর গল্পের উৎস নিয়ে।
মানে ? আর না পেঁচিয়ে দয়া করে এবার তথ্যটি বলো।
বলছি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে। হুমায়ূন আহমেদ নিয়মিত নুহাশ পল্লী যায়। যায় না ?
হ্যা যায় তো। তা কী হয়েছে।
কেন যায় জানো ?
ওটা তাঁর সেকেন্ড হোম।
না, সে কারণে না। ওখানে যায় গল্প পেতে। হিহিহিহিহি।
ওভাবে বোকার মতো না হেসে খুলে বলো।
শোনো মামা, আমি যা জানি তুমি তা জানো না। হুমায়ূন আহমেদ ওখানে রাতের বেলা থাকেন। গভীর রাতে যখন পৃথিবীর সব আলো নিভে যায় তখন তিনি উঠে ড্রয়িংরুমের অন্ধকার মেঝেতে গিয়ে বসেন, অনেকটা ধ্যানমগ্ন গৌতম বুদ্ধের মতো। তখন তাঁর কাছে জ্বীন আর পরীরা আসে। ওরা গোল হয়ে বসে তাঁর চারপাশে। তারপর গল্প শোনায়। হুমায়ূন আহমেদ মুখস্থ করে রাখেন, খুবই ট্যালেন্টেড মানুষ, ক্যামিষ্ট্রিতে পিএইচডি, কিছুই ভুলেন না। পরে লেখেন এক এক করে। এই যে প্রথম আলো, সমকাল, অন্যদিন, কালের কন্ঠে প্রতিবছর তাঁর উপন্যাস ছাপা হচ্ছে, তোমার কি ধারনা এগুলো সব তিনি বানিয়ে বানিয়ে লিখেছেন! মোটেই না। এগুলো সব জ্বীনদের কাছ থেকে পাওয়া গল্প। আর অই হিমু, মিসির আলী, ওসব জ্বীন পরীদের দেয়া নাম।
পরী, এসব আজগুবী তথ্য কে দিয়েছে তোমাকে ?
কেউ দেয়নি, আমি নিজের চোখে দেখেছি।
মানে ? এবার আমার সত্যি বিস্মিত হবার পালা।
আমি একদিন গভীর রাতে পরীদের সাথে নুহাশ পল্লী গিয়েছিলাম। অমাবশ্যার রাত ছিল। নিজের চোখে সব দেখে এসেছি। চারপাশে জ্বীন- পরী, আর মাঝখানে গৌতম বুদ্ধের ব্রোজ্ঞ মূর্তির মতো বুকের সামনে একহাত তুলে বসে আছেন তিনি।
আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রাত অনেক হয়েছে, বাইরে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ হেলে পড়েছে কিছুটা পশ্চিমে।
পরীর ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়লো একদম শেষ মুহূর্তে। মাত্র দু’মাস আগে ঝরা পালকের স্মৃতি রেখে অলৌকিক ডানায় ভর করে পরী উড়ে গেছে দূর কোনো নক্ষত্রের দিকে।
থান্ডার বে’, অন্টারিও, কানাডা