বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম আর পক্ষপাতের সংস্কৃতি চলে আসছে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বহুল আলোচিত ‘মৌখিক পরীক্ষা’—যা কাগজে-কলমে যোগ্যতা যাচাইয়ের মাধ্যম হলেও বাস্তবে অধিকাংশ সময়ই তা ক্ষমতাবানদের প্রিয় প্রার্থীকে বৈধতা দেওয়ার খেলার মাঠে পরিণত হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষা চালুর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। বাইরে থেকে মনে হতে পারে, এটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মানোন্নয়নের চেষ্টা। কিন্তু ভেতরের বাস্তবতা ভিন্ন। লিখিত পরীক্ষার এই প্রবর্তন অনেকটা দায়সারা ব্যবস্থা—প্রভাবশালী মহলের পছন্দের প্রার্থীকে সরাসরি বাদ দিতে না পারার অজুহাত তৈরি করার এক কৌশল। একটি মসৃণ আড়াল, যাতে উপাচার্যের ওপর সুপারিশের বোঝা খানিকটা হালকা হয়, সেই সঙ্গে নিয়োগের নাটকটিতে স্বচ্ছতার ছদ্মাবরণ ব্যবহার করা যায়।
প্রকৃত চিত্র হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ফল নির্ধারণে প্রার্থীর একাডেমিক যোগ্যতা বা গবেষণার দক্ষতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কার প্রতি বোর্ডের সদস্যদের ব্যক্তিগত অনুরাগ, উপাচার্যের পক্ষপাত কিংবা মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশপত্র। ফলে নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া পরিণত হয় ভাগাভাগি আর সমঝোতার খেলায়। শিক্ষক হওয়ার জন্য যে গুণাবলি সবচেয়ে জরুরি—জ্ঞান, গবেষণার গভীরতা, শ্রেণিকক্ষ পরিচালনার দক্ষতা—তা পড়ে যায় দ্বিতীয় সারিতে; অগ্রাধিকার পায় রাজনৈতিক আনুগত্য ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক।
যে ‘লিখিত পরীক্ষা’ চালুর মাধ্যমে পরিবর্তনের দাবি তোলা হচ্ছে, বাস্তবে তার চেহারা কেমন? বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই ফাঁস হয়ে যায়, কিংবা এমনভাবে প্রশ্ন তৈরি করা হয় যাতে নির্দিষ্ট দুয়েকজন ছাড়া কেউই ভালো করতে না পারে। ফলে লিখিত পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে এক ধরনের দায়সারা নাটক। উদ্দেশ্য একটাই—যাকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি, তার জন্য একটি অজুহাত তৈরি। তখন উপাচার্য নিশ্চিন্তে বলতে পারেন,‘স্যার, আমি তো আপনার প্রার্থীকেই নিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় সে ভালো করতে পারেনি, তাই আর পারিনি।’ এভাবেই লিখিত পরীক্ষা হয়ে ওঠে এক প্রকার ‘ক্লিনচিট’—একটি ঢাল, যার আড়ালে লুকানো থাকে নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রকৃত অনিয়ম।অর্থাৎ, এটি কোনো গুণগত উন্নয়ন নয়; বরং ক্ষমতার কাঠামোতে টিকে থাকার ছদ্মব্যুহ।
অথচ, বিশ্বের উন্নত ও পেশাদার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদেরও মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু ডিগ্রি বিতরণের কারখানা নয়; এগুলো একটি জাতির বৌদ্ধিক ও নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার জায়গা। তাই শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্ন আসলে জাতির দিকনির্দেশনা নির্ধারণের প্রশ্ন। যতদূর জানি উন্নত বিশ্বে শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থায় নেই এ ধরনের প্রশ্নফাঁস বা সুপারিশের খেলা। বরং নিয়োগ হয় সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ, বহুপাক্ষিক ও জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সেখানে মৌখিক পরীক্ষা বা লিখিত পরীক্ষা কখনোই নিয়োগের মূল কেন্দ্রবিন্দু নয়। গুরুত্ব দেওয়া হয় প্রার্থীর সার্বিক পেশাগত যোগ্যতা, গবেষণার পরিকল্পনা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান কৌশল, সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগের সামর্থ্য, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তার সামঞ্জস্যতায়। এই ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় থাকে গভীর প্রস্তুতি, কঠোর মানদণ্ড ও স্বচ্ছ জবাবদিহিতা।
সাধারণত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয় বিভাগীয় স্তরে। বিভাগের চেয়ারম্যান ও ডিন মিলে ঠিক করেন, নিয়োগ হবে কি না গবেষণাভিত্তিক শিক্ষক (রিসার্চ ট্র্যাক) নাকি শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষক (টিচিং ট্র্যাক)। এরপর প্রকাশিত হয় বিস্তারিত বিজ্ঞপ্তি, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে যোগ্যতার মানদণ্ড, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট, গবেষণা ও শিক্ষাদানের পরিকল্পনা।
প্রার্থীরা জমা দেন বিশদ সিভি, কভার লেটার, রিসার্চ স্টেটমেন্ট, টিচিং স্টেটমেন্ট, রেফারেন্স লেটার, এমনকি অনেক সময় ডাইভারসিটি ইনক্লুশন প্ল্যান পর্যন্ত। এরপর গঠিত হয় সার্চ কমিটি, যারা নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী প্রার্থী বাছাই করে এবং প্রাথমিকভাবে অনলাইনে সাক্ষাৎকার নেয়।
প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে থাকে দলীয় আলোচনা, রেকর্ড সংরক্ষণ, এবং শেষ ধাপে একদিনব্যাপী ক্যাম্পাস ভিজিট—যেখানে প্রার্থীর ওপর চালানো হয় বহুমাত্রিক মূল্যায়ন।
উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া যে কতটা কঠোর ও বহুস্তরীয়, তা বোঝা যায় ক্যাম্পাস ভাইভার ধাপগুলোতে। এখানে প্রার্থীকে একে একে সার্চ কমিটি, বিভাগীয় শিক্ষক, ডিন, প্রভোস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট, এমনকি মনোবিজ্ঞান বা ভাষাবিদ বিভাগের প্রতিনিধি এবং ছাত্রছাত্রীদের সামনেও দাঁড়াতে হয়। ক্লাসরুমে নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঠদান ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে যাচাই করা হয় তার শিক্ষাদান দক্ষতা। গবেষণা উপস্থাপনের মাধ্যমে দেখা হয় প্রার্থীর চিন্তাশক্তি, একাডেমিক গভীরতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এমনকি লাঞ্চ বা ডিনারের সময়ও চলে অনানুষ্ঠানিক মূল্যায়ন—সেখানে খেয়াল করা হয় সহকর্মীদের সঙ্গে মিশে প্রার্থীর যাওয়ার সক্ষমতা, সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই পুরো ক্যাম্পাস ভাইভার খরচ বহন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই। এতে প্রতিফলিত হয় নিয়োগ প্রক্রিয়ার পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতা।
এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে প্রার্থীদের র্যাঙ্কিং করা হয় এবং সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা প্রার্থীকে চাকরির প্রস্তাব পাঠানো হয়। তিনি রাজি না হলে পরবর্তী প্রার্থীদের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এখানেই বাংলাদেশি ব্যবস্থার সঙ্গে মূল পার্থক্য—কেউই শুরুতে স্থায়ী নিয়োগ পান না। বরং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই সময়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় শিক্ষকতার তো বটেই, অন্যান্য কর্মদক্ষতারও মূল্যায়ন। ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের মূল্যায়ন, ক্লাস পর্যবেক্ষণ, গবেষণা প্রকাশনা, শিক্ষার্থী সুপারভিশন এবং গবেষণা অনুদান আনার সক্ষমতা—সবকিছুর ওপর নির্ভর করে সেই মূল্যায়ন। নির্ধারিত সময়ে সাফল্যের প্রমাণ মিললে তবেই নিয়োগ স্থায়ী হয়।
ফলে গড়ে ওঠে একটি স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও মেধাভিত্তিক সংস্কৃতি। শিক্ষাদান আর গবেষণার মানোন্নয়নের জন্য এটি হয়ে ওঠে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক চাপ, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যায় গুণগত পরিবর্তনের দিকে।
এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি পেশাদার এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত। এমন ব্যবস্থায় শিক্ষক নিজের অবস্থান তৈরি করেন নিয়োগদাতার কাছে নয়, বরং পেশাগত মানদণ্ড, গবেষণার অবদান এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপনের দক্ষতার ভিত্তিতে। ফলস্বরূপ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা হয় প্রাণবন্ত, গবেষণায় আসে বাস্তবমুখিতা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে কয় জন সচেতন ও দক্ষ উপাচার্য কিংবা বিভাগীয় প্রধান আছেন—যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন—তারা অবশ্যই এসব পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, প্রয়োজনে তারাও মৌখিক পরীক্ষাকে বৈধতা দেন কিংবা লিখিত পরীক্ষার নামে নতুন এক চাতুর্য প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ, পেশাদার পদ্ধতি চালু হলে তাদের ক্ষমতার বলয় ছোট হয়ে আসবে, আর সুপারিশ-নির্ভর নিয়োগ থেকে অর্জিত অর্থনৈতিক সুবিধাও হ্রাস পাবে—এমন আশঙ্কাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তার উত্তরে কেবল লিখিত পরীক্ষা চালু করাই কোনো সমাধান নয়। প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নিয়োগ কাঠামো—যেখানে মেধা ও পেশাদারিত্ব হবে নিয়োগের একমাত্র মাপকাঠি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই এই কাঠামো গড়ে তোলার মৌলিক পদক্ষেপ, নেই নীতিগত সদিচ্ছা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষার আড়ালে যে ‘উপাচার্যতন্ত্র’ আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, তা আসলে পুরোনো দুর্নীতিরই নতুন ছদ্মবেশে পরিণত হবে বলে অনুমান করা যায়। বদলাবে কেবল বাহ্যিক চিত্র, অন্তর্নিহিত অনিয়ম থেকে যাবে আগের মতোই।
একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিক্ষকের মান ও মেধার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেই শিক্ষক বাছাইয়ের প্রক্রিয়া যদি অনিয়ম আর পক্ষপাতের বেড়াজালে আটকে থাকে, তবে জাতি কখনোই উন্নত, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে পারবে না। তাই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো শক্তিশালী নিয়োগ কাঠামো প্রতিষ্ঠা—যেখানে থাকবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা।
এমন কাঠামো হতে হবে ছাত্র, শিক্ষক ও সমাজ—তিন পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। লিখিত পরীক্ষা চালুর আড়ালে দুর্নীতির নতুন ছদ্মবেশ নয়, প্রয়োজন কাঠামোগত বিবর্তন। এখন সময় এসেছে দেশের উচ্চশিক্ষা নীতিনির্ধারকদের সেই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার—কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ শুধু একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের মূল ভিত্তি।