বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশের মাটি খুবই উর্বর। প্রচুর নদী, খাল, বিল, হাওর-বাওর, পুকুর, জলাশয় ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে সাগরের বিশাল উপকূল। স্থলে রয়েছে পর্যাপ্ত মিঠা পানি। আবহাওয়ায়ও খুবই অনুকূল। পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিকও রয়েছে এবং সকলেই কঠোর পরিশ্রমী ও দক্ষ। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে কৃষির ব্যাপক উন্নতির সব অনুকূল অবস্থা বিরাজমান, যা বিশ্বে বিরল। তবুও দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন হয়নি! কৃষি পণ্যের অধিকাংশই আমদানিনির্ভর। তাই খাদ্য আমদানিতে উন্নতির বেশিরভাগ ব্যয় হয়। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উপরন্তু আমদানির কারণে মূল্য বেশি, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২৪ মতে, ১২৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮৪তম। এ তালিকায় বাংলাদেশকে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধাপীড়িত দেশের তালিকায় রাখা হয়েছে। অপরদিকে, কৃষি উপকরণের মূল্য অত্যধিক। কৃষির উৎপাদন হারও খুব কম। তাই কৃষির উন্নতি যে হারে হয়েছে, সে হারে কৃষকের উন্নতি হয়নি। তাই অনেকেই নিরুৎসাহী হয়ে পেশা বদল করছে। শহরে ঠাঁই নিচ্ছে। তাতে শহরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষি খাতের উন্নতির দিকে সরকারিভাবে গুরুত্ব না দেওয়ায় কৃষি খাতের কাক্সিক্ষত উন্নতি হচ্ছে না। বরং দৈন-দশা চলছে। দেশের কৃষি খাতের দৈন দশার অন্যতম হচ্ছে: সেকেলে তথা অযান্তিকরণ, ফসল সংরক্ষণের অভাব, ফসলের ন্যায্য মূল্যের অভাব, মাটির উর্বরতা হ্রাস, প্রয়োজনীয় কৃষি ঋণের অভাব, কৃষি উপকরণের মূল্য বেশি ও অপর্যাপ্ত ইত্যাদি। বিবিএসের ‘উৎপাদনশীল ও টেকসই কৃষি জরিপ ২০২৫’ মতে, দেশের মোট কৃষি জমির ৫৭ শতাংশ এখনো টেকসই ব্যবস্থাপনার আওতায় আসেনি। উপরন্তু ৪০ শতাংশ কৃষক ন্যায্য-মজুরি পায় না। এছাড়া, প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি হয়। সর্বোপরি অদৃশ্য ব্যয়ও রয়েছে। জাতিসংঘের এফএও-এর স্ট্যাট অব ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার- ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, কৃষিখাদ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের বছরে অদৃশ্য খরচ হচ্ছে ১১ হাজার ৮৭৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। বিবিএস’র ‘স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস-২০২৩’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ছিল ১.৩৩%, আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। এফএও’র হিসাবে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশে বছরে ২৫-৩০ শতাংশ কৃষি এবং খাদ্য পণ্য নষ্ট হচ্ছে। ইউনেপের ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট-২০২৪ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের খাদ্য অপচয়ের এ প্রবণতার হার ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। ১০ ডিসেম্বর ’২৪ প্রকাশিত বিআইডিএসের তথ্য মতে, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় গত ৭ বছরে দেশে কৃষির উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩.৫%। একই সময়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম বেড়েছে ১.৩১%। ফলে কৃষি খাতে মুনাফা কমেছে। আবার অনেকে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দেয়ায় কৃষি উৎপাদনশীলতা কমেছে ১২%। মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর, যার প্রায় ৭৫% উর্বরতা ঘাটতিতে ভুগছে। তাই এফএও’র মতে, বাংলাদেশে ২০৫০ সালের মধ্যে খাদ্য উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। জার্মানি-ভিত্তিক বৈশ্বিক বাজার ও অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত সংক্রান্ত ডাটাবেজ স্ট্যাটিস্টারের হিসাবে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের বাজারের আকার ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। প্রতি বছরই ২ শতাংশ হারে এ বাজারের আকার বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে কৃষিপণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার।

কৃষিনির্ভর দেশে কৃষির উন্নতি না ঘটিয়ে সরকারিভাবে শিল্পায়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার সুফল পাওয়া যায়নি। বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ও প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিতে এটা হয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলো শিল্পায়নের নামে খেলাপি ঋণের ভারে ন্যূজ্ব হয়ে পড়েছে, যা স্বাভাবিক হওয়া কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৫ সালের মার্চ শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪.১৩%। উপরন্তু ব্যাংক বহির্ভূত খেলাপি ঋণও রয়েছে। এই বিশাল খেলাপি ঋণের বিরাট অংশ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ! অপরদিকে, দেশে প্রযুক্তি খাতেরও উন্নতি হয়নি আশানুরূপ! তাই দেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড কৃষিই রয়ে গেছে। দেশে যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার সিংহভাগ পকেটস্থ হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের। তাই দেশে আয় বৈষম্য সর্বোচ্চ তথা বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে! দ্বিতীয়ত: ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। তখন গরিব দেশের প্রাপ্ত সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে নানা ধরনের সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে বৈদেশিক বাণিজ্য ও ঋণের ক্ষেত্রে।

দেশে মানুষ বাড়ছে। আর কৃষি জমি কমছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই খাদ্য আমদানি ও ব্যয় বেড়ে গিয়ে দেশের শান্তি ও উন্নতি ব্যাহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এই অবস্থায় দেশের উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখা এবং টেকসই ও সার্বিক করার জন্য, বেকারত্ব কমানোর জন্য, গ্রামীণ মানুষের শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করার জন্য এবং পরিবেশের উন্নতি জন্য কৃষির উন্নতি অধিক কল্যাণকর।

বাংলাদেশের কৃষির উন্নতি এবং দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন করার জন্য পতিত সব জমিকে চাষের আওতায় আনতে হবে এবং চাষযোগ্য সব জমিতে সর্বদা সর্বাধিক ফলনশীল বীজ ব্যবহার করতে হবে। সমগ্র কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তিকীকরণ এবং তা পরিচালনা ও মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি করতে হবে। এইসঙ্গে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠা, স্বল্পমূল্যে সব কৃষি উপকরণ কৃষকের কাছে পৌঁছানো, স্বল্প সুদে ও বিনা ঝামেলায় প্রয়োজনীয় কৃষি ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, সব ফসলের ভরা মওসুমে তথা ফুল সিজনে কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্যে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ক্রয়, কৃষি শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত, কৃষি জমিতে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং কৃষিপণ্য রফতানি সহজতর করতে হবে। তবেই কৃষক লাভবান হবে। কৃষকের আর্থিক উন্নতি না হলে কৃষি খাতের উন্নতি টেকসই হবে না। কৃষক নিরুৎসাহী হয়ে পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাবে, যা দেশের জন্য চরম ক্ষতিকর হবে। উল্লেখ্য যে, সমলয় ও সমবায় ভিত্তিক চাষ, ছাদ বাগান এবং চাহিদা মাফিক ফসল ফলানো কৃষি ও কৃষকের জন্য মঙ্গলজনক। সম্প্রতি পানিতে ভাসমান কৃষি শুরু হয়েছে। ফলনও ভালো হচ্ছে। বাংলাদেশে বহু নদী, খাল-বিল ইত্যাদি রয়েছে। এসবের পানিতে ভাসমান কৃষি চাষ এবং সর্বত্রই শস্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। তাহলে দেশে কৃষির উৎপাদন বেড়ে যাবে। স্মরণীয় যে, চীনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমুদ্রভিত্তিক আধুনিক খামার গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশটির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ও স্থলজ কৃষি জমির ওপর চাপ কমাতে এটা করা হচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। বাংলাদেশে বিশাল সমুদ্র উপকূল রয়েছে। সেখানে চীনের মতো সমুদ্রভিত্তিক কৃষি করতে পারলে খাদ্য উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews