রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কে বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলছে জামদানি উৎসব। দর্শনার্থীদের জন্য ছোট পরিসরে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে ভেতরেই। তবে প্রদর্শনী প্রাঙ্গনে ছবি তোলা নিষেধ, কোনো খাবারও নেওয়া যাবে না, বড় ব্যাগ থাকলে তা বাইরে রেখে যেতে হবে, সেজন্যও আছে সুব্যবস্থা আছে।

নিচে আর দোতলায় মিলিয়ে চলছে প্রদর্শনী। তবে তাঁতের আবহ পাওয়া যাবে মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরই।

বাইরের বসার জায়গাতেই মাথার ওপর সাদা সুতা টানিয়ে রাখা হয়েছে, এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত।

জামদানি উৎসবের তত্ত্বাবধায়ক দলের সদস্য এবং বেঙ্গল আর্টস অ্যাসোসিয়েশনের গবেষক প্রিয়াঙ্কা চৌধুরি জানালেন, তাঁতে বোনার আগে এভাবেই সুতা টানা দিয়ে রাখা হয়, যাকে বলা হয় টানা হাঁটা।

মাথা নামালেই দৃষ্টি আটকে যাবে চারজন বয়নশিল্পীর ওপর। প্রদর্শনী দেখতে আসা দর্শনার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন তারা।

প্রিয়াংকা চৌধুরি বলেন, “প্রদর্শনী চলাকালীন এই চারজন বয়নশিল্পী দুটি জামদানি শাড়ি তৈরি করবেন। যাতে দর্শনার্থীরা নিজের চোখে দেখতে পারেন কীভাবে তাঁতে তৈরি হয় জামদানি শাড়ি।”

নিচতলার মূল প্রদর্শনী প্রাঙ্গনটি যেন এক জামদানি বিষয়ক তথ্য ভাণ্ডার।

ঢুকে হাতের বামের ঘরটি থেকে শুরু করলে প্রথমেই চোখে পড়বে দুইতলার সমান উঁচু করে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন জামদানি মোটিফের প্রিন্ট। এখানকার দেয়ালে আছে মুলত জামদানি নকশার ক্যাটালগ।

দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, জাদুঘর, নথি ইত্যাদি দেখে প্রাচীন আমলের জামদানির বিভিন্ন নকশার নমুনা সংগ্রহ করে দেশের বয়নশিল্পীদের দিয়ে পুনরায় কাপড়ের ক্যানভাসে তুলে আনা হয়েছে সেই নকশাগুলোকে।

‘ঐতিহ্যের বিনির্মাণ’ শীর্ষক জামদানি কর্মের প্রদর্শনীতে দুই দর্শনার্থী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এদের মাঝে কয়েকটি প্রকৃত প্রাচীন জামদানির নিদর্শণও আছে। যেমন- কলকাতার উইভারস স্টুডিওর দর্শন শাহয়ের সংগ্রহশালা থেকে এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের পুরানো জামদানি শাড়ি।

এই ঘর থেকে বেরোতেই সুতা, শানা ও তাঁতের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। তাকে সাজানো আছে মিল ও খাদি সুতা।

শূন্য কাউন্ট থেকে ৩শ’ কাউন্টের খাদি সুতা পাশাপাশি রাখা আছে। আর ঠিক তার নিচেই আছে ৪০/১ কাউন্ট থেকে ১০০/১ কাউন্টের মিলের সুতা।

কাউন্ট যত বেশি, সুতা ততই মিহি। আর কতটা মিহি সুতা দিয়ে পুরানো দিনে জামদানি তৈরি হত তা দেখা যাবে চর্ম চোখেই।

জামদানি প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে জামদানি শাড়ি বোনার সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

জামদানি প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে জামদানি শাড়ি বোনার সুতাসহ বিভিন্ন উপকরণ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এর নিচের তাকে আছে তাঁতের যন্ত্রাংশ কান্টুস, মাকু ও নলি। এগুলো কীভাবে কাজ করে তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সেচ্ছাসেবকও মোতায়েন আছে। পাশেই আছে শানা, সরু করে কাটা বাঁশের টুকরো। থরে থরে বসিয়ে তৈরি হয় শানা, যার প্রতিটির খাঁজে বসানো হয় সুতা। এখানে দেখা যাবে ২৭০০ শানা। যার মানে হল ২৭০০ লাইন সুতা পাশাপাশি বসিয়ে তার খাঁজে খাঁজে সুতা বসিয়ে বোনা হবে একটি শাড়ি।

এর পাশের ঘরের দেয়ালে দেখা যাবে জামদানির প্রাচীন ইতিহাসের একঝলক। জানা যাবে কতটা সমাদৃত ছিল সেকালের জামদানি শিল্প।

প্রাচীনকালের জামদানি বাণিজ্যের ধারা জানার পাশাপাশি পাবেন বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের কোন এলাকাগুলোতে বয়নশিল্পী আজও এই জামদানিকে টিকিয়ে রেখেছেন। এছাড়া্রও জানা যাবে জামদানি বয়ন পদ্ধতির ধাপগুলো। কীভাবে সুতা থেকে শুরু হয়ে, দারুণ শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে তা শাড়িতে রূপ নেয়।

প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন জামদানি শাড়ি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন জামদানি শাড়ি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এর পাশে আছে ‘ফিল্ম অ্যান্ড আর্কাইভ’ যেখানে রয়েছে বয়নশিল্পীদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা কেমন, কীভাবে তাঁতে কাপড় বোনা হয়। আর আকর্ষণীয় বিষয় হল বয়নশিল্পিদের নকশার বুলি। আছে জামদানি নিয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন লেখকের বইও।

এবার দোতলায় যাওয়া যাক। সিঁড়ির শেষ মাথায় পৌঁছে খুব সাধারণ একটি জিনিস দেখা যাবে। যেমন- পানি ভরা মাটির চাড়িতে রাখা মাটির কলসি যার গলায় আবার সুতা পেঁচানো। এই কলসিতে আবার লম্বা লাঠি পোতা, যার মাথায় ঝুলে সুতা পেঁচানো কয়েকটি নলি।

প্রথমে মনে হবে জামদানি উৎসব বিষয়ক সাধারণ অন্দরসজ্জা। তবে এর তাৎপর্য তুলে ধরলেন প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী।

প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন জামদানি শাড়ি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন জামদানি শাড়ি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তিনি বলেন, “নিচের মাটির চাড়ি হল একজন বয়নশিল্পী, তাতে থাকা পানি হল তার চারপাশের পরিবেশ আর তার মধ্যমনি কলস হল বয়নশিল্পীর সহধর্মীনি। কলসিকে কেন্দ্র করে উঠে যাওয়া লাঠি হল বয়নশিল্পীর জীবনকাল যার সম্বল হল সুতা। তবে সময়ের বিবর্তনে এই সুতাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায় যা বোঝানো হয়েছে কলসি গলার সুতা দিয়ে।”

দোতলার মূল প্রদর্শণী প্রাঙ্গনেও আছে প্রাচীন উৎস থেকে সংগ্রহ করে আনা জামদানির নকশাগুলো দিয়ে তৈরি করা নতুন শাড়িগুলো। এই শাড়িগুলো সাজানোর কায়দাটাও আকর্ষণীয়, প্রতিটি শাড়ির নিচে আছে জামদানি শাড়ি তৈরি নিত্য ব্যবহার্য সুতা, শিমুল তুলা, নাটাই, খাঁচি ইত্যাদি অনুসঙ্গ।

বিভিন্ন ধরনের মোটিফ একের পর এক সাজিয়ে, কয়েকটি মোটিফ একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই শাড়িগুলো।

প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন জামদানি শাড়ি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছে বিভিন্ন জামদানি শাড়ি । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

গতবাঁধা জামদানি নকশার বাইরের অনেক নকশা দেখতে পাবেন এখানে। প্রতিটি শাড়ির পাশে রাখা এক টুকরা কাগজ থেকে জানা যাবে ওই শাড়ির দুই বয়নশিল্পীর নাম, বয়নকাল, কত কাউন্টের কোন সুতা ব্যবহার হয়েছে এবং কোন প্রতিষ্ঠান সেটি তৈরি করিয়েছেন।

আড়ং, অরণ্য, কুমুদিনি এবং টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির এই শাড়িগুলো তৈরি করেছেন।

এই শাড়িগুলো মাঝেই দেখা যাবে কাচের বাক্সে ঘেরা ১০০ থেকে ২০০ বছরের পুরানো জামদানি শাড়ি, অঙ্গরাখা পোশাক ইত্যাদি। দর্শন শাহ ছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের নির্বাহী সদস্য ও সাবেক সভাপতি রুবি গজনবী এবং কাশ্মিরের আশাফ আলির সংগ্রহশালা থেকে আনা হয়েছে এই শিল্পকর্মগুলো।

বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই জামদানি উৎসব চলবে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত।

ছবি: মাহমুদ জামান অভি।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews