সেই শৈশব থেকে ঢাকা শহরে বসবাস করলেও বেশ কয়েক বছর আগেই এ শহর আমার কাছে তার আকর্ষণ হারিয়েছে। কেন জানি এতদিন এক ধরনের বিষণ্নতা, অস্থিরতা ও একাকিত্ব আমাকে সবসময়ে গ্রাস করেছে। আমি একা কেন এরকম বিষণ্নতায় ভুগছি তা নিয়েও আমি নিজেও উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় আশ্বস্ত হলাম এটা দেখে যে, শুধু আমি নই, ঢাকা শহরের প্রায় ২ কোটি মানুষের মধ্যে ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতা, উদ্বেগ আর কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
বিআইডিএসের এই গবেষণা তো ইতোমধ্যে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। একই গবেষণার আরও কিছু পরিসংখ্যান সবাইকে অবাক করেছে। যেমন নগরবাসীদের মোট আয়ের ৯ শতাংশ খরচ করতে হয়ে চিকিৎসার পেছনে বা সুযোগ-সুবিধা পেলে ৫৭ শতাংশ মানুষ গ্রামে ফিরে যাবেন। তিন বেলা না খেতে পাওয়া মানুষের কথা বা ধনী-দরিদ্রের সম্পদের বিশাল ব্যবধানে কথাও এই গবেষণায় উঠে এসেছে।
কিন্তু গবেষণা তো মাত্র কয়েকটি সূচক নিয়ে কাজ করে। আমরা আমজনতা, যারা বছরের পর বছর এ শহরে বসবাস করছি, তারা জানি কী কষ্ট আর  যন্ত্রণাদায়ক ঢাকাবাসীর প্রাত্যহিক জীবন! কেনাকাটা বলুন, শিক্ষাব্যবস্থা বলুন, চিকিৎসা বলুন বা যাতায়াত বলুন–অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টে কাটে সাধারণ নাগরিকদের জীবন। সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা তো আছেই, তবে একশ্রেণির নাগরিকের দুর্নীতি, অসততা, সম্পদলিপ্সাও এ এক্ষেত্রে কম দায়ী নয়। যার বলি হচ্ছে অগণিত সাধারণ নিরীহ জনগণ।

ডেঙ্গুর কথা দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। পত্রিকার রিপোর্টে এসেছিল যে পুরো শহরবাসীকে ডেঙ্গুভীতি প্রকৃত অর্থেই মনোবৈকল্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কারও পরিবারে সবাই, কারও পরিবারে কেউ কেউ, কারও আত্মীয়স্বজন, কারও প্রতিবেশী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ মারা গিয়েছেন,  চিকিৎসা করতে গিয়ে কোনও কোনও পরিবারের লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে ইত্যাদি। সে ছিল এক চরম ভীতিকর পরিবেশ। শিশুদের নিয়ে মহাআতঙ্কিত বাবা-মা কীভাবে যে সন্তানদের স্কুল, কলেজ, কোচিংয়ে পাঠিয়েছেন, তা একমাত্র তারাই জানেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলেও মশার প্রকোপ কিন্তু কমে নাই। ডেঙ্গুতে এখনও অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। 

তবে, স্কুল-কলেজের সমান্তরালে প্রাইভেট টিউশন আর কোচিং সেন্টারের নামে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা ঢাকার সন্তানদের অভিভাবকদের চরম ভোগান্তি দিচ্ছে। অনেককেই সকালে একবার তার সন্তানদের স্কুলে দিয়ে আসতে হয়। এরপর দুপুরে নিয়ে আসতে হয়। আবার বিকেলে কোচিংয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় বা রাতে নিয়ে আসতে হয়। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আপনি দেখবেন অনেক বাসা বা কোচিং সেন্টারের সামনে সন্ধ্যায় অভিভাবকদের জটলা। এটা যে কত বড় এক শাস্তি তা অভিভাবক মাত্রই জানেন। সন্তানদের পড়াশোনার চিন্তা আমাদের সামাজিক জীবনকে শেষ করে দিয়েছে।

কিছুদিন আগে মোহাম্মদপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। রাতে তার স্কুলপড়ুয়া মেয়ের কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের কথাবার্তা শেষ করতে হলো। আমাদের প্রশ্ন হলো কোচিং সেন্টার যদি শিক্ষাব্যবস্থায় অপরিহার্য হয়ে উঠে তাহলে স্কুল, কলেজের কী প্রয়োজন? প্রাইভেট পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেই তো হয়। আগে অঙ্ক বা ইংরেজিতে প্রাইভেট পড়ার প্রচলন থাকলেও ইদানীং সব বিষয়ে কোচিং করতে হচ্ছে যা অভিভাবকদের অর্থক্ষয়ের পাশাপাশি সামাজিক জীবনকেও প্রভাবিত করছে। একে অন্যের সঙ্গে আমরা আর মিশতে পারছি না। 

বহুলচর্চিত প্রাত্যহিক জ্যামের কথা বা প্রায় প্রতিটি খাবারে ভেজালের কথা বাদ দিলেও চিকিৎসা নিয়ে নগরবাসীর ভোগান্তির কথা না বললেই নয়। এই মুহূর্তে আমার পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী ক্যানসারের রোগিনী থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন পরিচিতদের বেশ কয়েকজনই ভারতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্বল্পব্যয় বা সঠিক চিকিৎসার জন্য একটু জটিল রোগের ক্ষেত্রেই বিদেশে পাড়ি জমাতে হচ্ছে অনেককেই। একটু কম পড়াশোনা জানেন বা দরিদ্রদের জন্য এ ভোগান্তি চরম। তারা জানে না কোথায় কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে, কীভাবে ওষুধ খেতে হবে। 

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভোগান্তি নিয়ে শুধু ডাক্তারদের দায়ী করে লাভ নেই। চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল, ক্লিনিক, প্যাথলজিকাল ল্যাব, ওষুধ কোম্পানি ইত্যাদির মধ্যে যে অচ্ছেদ্য চক্র গড়ে উঠেছে ডাক্তাররা তার একটি অংশ মাত্র। অতিরিক্ত টেস্ট না দিলে বা বেশি ওষুধ না লিখলে ডাক্তাররা ক্লিনিক তো দূরের কথা, পাড়ার চেম্বারেও বসতে পারবেন না। 

মাস খানেক আগে বাচ্চাদের মাকে নিয়ে এক ডেন্টিস্টের কাছে যেতে হয়েছিল। চেম্বার থেকে বের হয়েছি মাত্র, ওর হাতে প্রেসক্রিপশন। একটু দেখি বলে ছোঁ মেরে এক তরুণ তার হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ছবি তুলে নিল। বুঝলাম ওষুধ কোম্পানির লোক। এ চিত্র মোটামুটি ডাক্তারদের সব চেম্বারের সামনে। প্রেসক্রিপশন তো একটা ব্যক্তিগত বিষয়। এর ছবি কীভাবে নেয় বা প্রেসক্রিপশন কীভাবে ওষুধ কোম্পানির লোকজন দেখতে চায়? কিন্তু কী বলবো! অনেক সময় ওষুধ কোম্পানির তরুণটি বিষণ্নমুখে যখন প্রেসক্রিপশন চায়, আমরা না করতে পারি না। কিন্তু এটা তো কোনও চিকিৎসার সুস্থ পদ্ধতি নয়।

খেলাধুলার জায়গা বা হাঁটাহাঁটির জায়গা না থাকায়  বয়স্করা তো বটেই শিশু-কিশোররাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই গবেষণায় এসেছে ঢাকা শহরের সোয়া ৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এছাড়া উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগী রয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বাড়িতে শিশুরা শ্বাস-প্রশ্বাসের বিভিন্ন সমস্যার ভুগছে। ফ্ল্যাট বাড়িতে শিশু-কিশোরদের একমাত্র বিনোদন মোবাইল আর কম্পিউটার। বেশিরভাগ পরিবারেই দেখছি এতে বাচ্চাদের চোখের বারোটা বাজছে।

 

ঢাকাবাসীর বিনোদন এখন কোথায়? ঢাকার আশেপাশে যেসব রিসোর্ট হয়েছে সেগুলোয় এমনকি একরাত অবস্থানের মূল্য মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। পর্যটনের জন্য বিখ্যাত দেশগুলোয়ও এত খরচ করতে হয় না। এটা তো ডিসেম্বর মাস। ছেলেমেয়েরা ঢাকার বাইরে বেড়াতে যেতে আবদার করে। কিন্তু সাধ থাকলেই তো হবে না। কয়টি পরিবারের সাধ্য আছে সন্তানদের নিয়ে কয়েকদিন বাইরে অবস্থানের?  

সমস্যার তো আর শেষ নেই। আছে সড়ক দুর্ঘটনার ভয় বা চুরি, ডাকাতি ছিনতাইয়ের ভয়। এ পর্যন্ত কতবার যে আমার মোবাইল হারালাম তা আমি নিজেও জানি না। কেনাকাটায় ঠকার অভিজ্ঞতা তো ঢাকাবাসীর প্রাত্যহিক জীবনের অংশ। কিছুদিন আগে ফোনে দোকানে অর্ডার দিলাম ২৫ কেজি চালের। বাসায় আনার পর কৌতূহলবশত নির্ভুল ওজন মাপার মেশিনে মেপে দেখলাম কাঁটায় কাঁটায় এক কেজি কম। এগুলো নিয়ে আর কোনও প্রতিবাদ করি না। এগুলোকে ভবিতব্য হিসেবে মেনে নিয়েছি। সবকিছুর প্রতিবাদ করতে গেলে নিজেকে পাগল একসময় পাগল হয়ে যেতে হবে। 

ঢাকাবাসীর বিষণ্ন না হওয়ার তাই কোনও কারণ নেই। কী কী কারণে আমরা বিষণ্ন তাও আমরা জানি। ওপরে যেসব কথা বললাম, তাও নতুন কোনও কথা নয়। তবু, বিআইডিএসকে ধন্যবাদ আমরা ঢাকাবাসী যে প্রকৃত অর্থেই বিষণ্নতায় ভুগছি তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। এই বিষণ্নতা কাটানোর উপায় এখন ঢাকাবাসীকেই বের করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

ইমেইল: [email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews