নানা ধরনের প্রাণী, মানুষ, হাতি, ঘোড়া, গরু, ভেড়া, গাছ-পালা, আমরা সবাই এই পৃথিবীর বাসিন্দা। এই পৃথিবী সবার।

সেই মুখের ভাষাহীন প্রাণীদের কল্যাণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর ৪ অক্টোবর বিশ্ব প্রাণী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। প্রকৃত অর্থে এই দিবসটি প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের দিবস বলা যায়। প্রাণীদের মর্যাদা, তাদের জন্য কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মান বৃদ্ধি করা এবং সর্বোপরি বিশ্বকে সকল প্রাণীর বাসযোগ্য ও জীবনধারণের জন্য সুপরিবেশ তৈরি করতে এ দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এই তাৎপর্যকে সামনে রেখে এ দিবসে বিশ্বব্যাপী প্রাণিকল্যাণ সংস্থা, কমিউনিটি  গ্রুপ, তরুণ ও শিশু-কিশোর সংগঠন, বিভিন্ন ব্যবসায়ী নানারকম আয়োজন করে থাকে। প্রাণী দিবস পালনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রাণিকূলের জীবনধারণের জন্য ধীরে ধীরে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, দেশ, বিশ্বাস  অথবা ভিন্ন রাজনৈতিক আর্দশ অনুযায়ী প্রাণী দিবস পালন করা হোক না কেন, এ দিবসের একমাত্র উদ্দেশ্য প্রাণীকূলের কল্যাণ। তাদের জন্য পৃথিবীতে সুস্থ আগামী তৈরি করাই এ দিবসের একমাত্র লক্ষ্য।  

এই লক্ষ্য মাথায় রেখে ১৯২৫ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রথম প্রাণী দিবস পালন করা হয়। যেই আয়োজনে ৫০০০ জনসাধারণ অংশ নিয়েছিলেন। এ দিবসটি এরপর পরিপূর্ণরুপে ১৯২৯ সালের ৪ অক্টোবর পালিত হয়। শেষমেশ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হয়ে ১৯৩১ সালে প্রাণী দিবস সকলের গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করে। ২০০২ সালে ফিনিশ প্রাণী রক্ষা সমিতি প্রাণী দিবসের প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রেখে প্রথম প্রাণী দিবসের আয়োজনের বিভিন্ন কার্যক্রমে স্কুলের শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে।

আয়োজনের কার্যক্রম:

নথিপত্র অনুযায়ী ২০০৩ সালে ১৩টি দেশে প্রাণী দিবসে ৪৪টি ইভেন্ট আয়োজিত হলেও বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১০০টি দেশে ১০০০টি ইভেন্ট আয়োজিত হয়। সেগুলো হচ্ছে-


সচেতনতা  ও শিক্ষা।



আশ্রয় দান ও পোষাপ্রাণী দত্তক নেওয়া।



সচেতনতা বৃদ্ধি, বয়স্ক ও শিশুদের প্রাণীর প্রতি যথাযথ, ভাল আচরণ শেখানো।



ম্যারাথন ও পশু চিকিৎসার ক্যাম্প স্থাপন।



কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপ।



কনসার্টের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ।



র‍্যাবিশ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি ও ভ্যাক্সিনেশন।



বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয় এমন প্রাণীর মালিকদের প্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণ শেখানো।



রেডিও টিভিতে প্রাণীর প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনুষ্ঠান প্রচার। প্রাণী দিবসের লক্ষ্য ও গুরুত্ব জনসাধারণের মাঝে এ অনুষ্ঠানে তুলে ধরা।



প্রাণীর কল্যাণে ও সচেতনতা তৈরিতে শান্তিপূর্ণ  সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদ মার্চ করা এবং প্রশাসনকে প্রাণি রক্ষায় আইন তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা।  

বর্তমান অবস্থা:

এত কিছুর পরও বিশ্বব্যাপী প্রাণী হত্যা বন্ধ নেই। মানুষ কারণে অকারণে প্রাণী হত্যা করছে। নিজের প্রয়োজনে প্রাণীকে ব্যবহার করছে কিন্তু প্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করতে পারছে না। প্রাণীর অস্তিত্ব ছাড়া পৃথিবী টিকতে পারবে না। মানুষের জন্মের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রাণীর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। জন্মের কিছু পর দুধ এরপর ডিম  এরপর মাংস আরও কত কিছুতে আমরা প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল সেটা বলে শেষ করা যাবে না। এরপরও বিপুল  পরিমাণ বনাঞ্চল বিপন্ন হচ্ছে এবং বাঘ শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। বাঘ, সিংহ এখন শুধু খঁচায় দেখা যায়। আমাদের দেশে চিড়িয়াখানার  বদৌলতে হরিণের সংখ্যা আশাতীতভাবে বেড়েছে। প্রকৃতি তার সহজাত প্রবৃত্তিতে দু'পেয়ে প্রাণী অর্থাৎ মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে প্রতি ১০০ বছরে মহামড়কের আবির্ভাব  হয়েছে এবং সেই মড়কে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছে। কারণ প্রকৃতি তার ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। আমাদের মানুষ হিসেবে দম্ভ আমাদের করার কিছু নেই। মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটাতে, সঞ্চয় করতে প্রকৃতি বিপন্ন করছে। কিন্তু  প্রাণীকূল নিজের প্রয়োজন মিটে গেলে কখনোই কাউকে আক্রমণ করে না।  

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:
প্রাণী দিবসের গুরুত্বকে উপলব্ধি করে প্রভা অরোরা বাংলাদেশে প্রাণী দিবসের আয়োজন করছে। প্রভা অরোরা আরো  বিশ্বাস করে প্রাণীর প্রতি ভালবাসা কোনো দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। প্রাণী আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। তার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন তাই প্রতিদিনের চর্চা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাণীর যে এতো অবদান তবুও তাদের কল্যাণে, তাদের টিকে থাকার জন্য আমাদের এতোটুকুও ভাবনা নেই। সত্যি কথা বলতে, প্রথম প্রাণী দিবস পালনের এতো বছর পরেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রাণী দিবস পালন বিশেষভাবে তাৎপর্য বহন করে। প্রভা অরোরা এতো আয়োজন করে প্রাণী দিবস পালন করলেও, অন্য কোনো সংস্থার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ প্রাণীর অবদান ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা মুশকিল। আমাদের দুধ, ডিম, মাংস প্রাণী থেকেই আসে। কিন্তু পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে অবস্থা এমন নয়। প্রাণীর কল্যাণে দেশভেদে, জাতিভেদে অনেক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো প্রাণীর কল্যাণে, তাদের প্রতি সচেতনতায় আইন প্রণয়নে সোচ্চার।  

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে এর সঠিক চিত্রটি ফুটে উঠবে। প্রাণীর কল্যাণে পৃথিবীব্যাপী কতিপয় সাফল্য নিচে তুলে ধরা হলো:



মিশরের প্রাণী রক্ষা ও কল্যাণ সংস্থা (SPARE) অতি সম্প্রতি মিশরের সংসদে প্রাণী রক্ষা ও তাদের কল্যাণে  আইন প্রণয়নে সক্ষম হয়েছে।



সুদানের প্রাণী সেবা ও পরিবেশ সংস্থা প্রাণী রক্ষায় আইন প্রণয়নে সক্ষম হয়েছে, যা প্রাণীর প্রতি আচরণ ও কল্যাণে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

এছাড়া লেবানন ও কলম্বিয়ায় প্রাণী রক্ষায় আশাপ্রদ পদক্ষেপ দেখা যায়।

পৃথিবীকে বাঁচাতে:
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নে (১০০০০ বছর আগে ) ৯৯% বন্যপ্রাণী ও ১% মানুষের বিচরণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে দুঃখজনক  হলেও সত্য, ২০১১ সালের হিসাবে সেটি দাঁড়িয়েছে ১% বন্যপ্রাণী ও ৬৭% পশুসম্পদ ৩২% মানুষের পৃথিবীতে (পপুলেশন মেটার্স সংস্থা, ২০১১)। আমাদের পরিবেশ রক্ষার মূল প্রাণবিন্দু হচ্ছে প্রকৃতিতে বায়োডাইভারসিটি যেমন আছে তেমনই রাখা কারণ এটি আমাদের প্রাণশক্তি। মানুষের খাদ্য, পানি, আরাম যেমন দরকার। ব্যথা, বেদনা যেমন আছে। ঠিক তেমিন প্রাণীর এই প্রয়োজনগুলোও অনুধাবন করতে হবে। আমাদের সমাজ কখনোই প্রাণীর প্রতি বিরুপ ছিল না। মানুষের নিজের প্রয়োজনে সেই নীতিই অবলম্বন করতে হবে। আদি থেকে কবি সাহিত্যিক থেকে শুরু করে সকলেই প্রাণীকে রক্ষা করার কথা বলেছেন। কারণ পৃথিবীতে শুধু মানুষ থাকবে! তাহলে পৃথিবীর এক ভয়ংকর চিত্র ফুটে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দ্রুত জীবনে আমরা সেসব ভুলতে বসেছি। গত ২৫ বছরে ৩০ থেকে ৪০টি রোগের আবির্ভাব হয়েছে আর তার ৭০%-৮০% এসেছে বন্যপ্রাণী থেকে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে কিভাবে? এর প্রধান কারণ বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। যাদের বনে থাকার কথা তারা লোকালয়ে চলে আসছে, তাদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ  যোগাযোগের ফলে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে কোভিড-১৯, এইচআইভির উৎপত্তি সেখান থেকেই। বর্তমানে বন উজাড় হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা যে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা আমাদের জ্ঞান, সর্তকতা ও সচেতনতা দিয়ে, সেই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।

কুকুর, বানর বা অন্য যে কোনো প্রাণীর কথা বলি না কেন? আমরা যদি তাদের ভালবাসি তারা কয়েকগুন বেশি  ভালবাসা ফিরিয়ে দেয়। তারপরও আমরা মানুষরা তাদের কল্যাণে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই না।  

তবে আশার কথা হচ্ছে অনেক সংস্থা প্রাণীর কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশের জনগণ, তরুণ  ও শিশু কিশোররা প্রাণীর প্রতি যত্নশীল হবে। চলমান কোভিড পরিস্থিতিতে তরুণরা পথের কুকুরদের খাবার সরবরাহ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে পাখির জন্য নিরাপদ বাসা স্থাপন করেছে। এদের সংখ্যা খুবই কম তবে শূন্য নয়। আমরা বেশিরভাগ মানুষরা প্রাণীর বসবাস এর স্থান, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সব নষ্ট করছি। লক্ষ্যনীয় কোভিড পরিস্থিতিতে যখন জাতীয়  চিড়িয়াখানাও বন্ধ ছিল। এসময় প্রানীর প্রজনন হার বেড়ে গিয়েছিল। তার মানে আমরা নিজেদের জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে গিয়ে তাদের জীবনযাপন ব্যহত করছি। সেটা শুধু মাটির ওপর সবুজ প্রকৃতির প্রাণীর জন্য হুমকি নয়। পানির নিচের প্রাণীর আবাসস্থল ও আমরা নষ্ট করছি। এর ফলে শত শত মৃত মাছ, ডলফিন, তিমি প্রায়শই সাগরের তীরে ভেসে আসছে। তাই আমাদের প্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। সেটা শুধু প্রানীর জন্য নয়, আমাদের জন্য ও সুফল বয়ে আনবে।  

সঠিক যত্নের মাধ্যমে জাতীয় চিড়িয়াখানায় এখন প্রচুর প্রাণী জন্ম নিচ্ছে। এর মধ্যে অনেক দুর্লভ প্রাণীও রয়েছে। যেমন -ইম্পালা। হরিণ ও ময়ুরের প্রজনন যেখানে আশাতীত। ধারন ক্ষমতার চেয়ে বেশি হরিণ এখন চিড়িয়াখানায় রয়েছে।  চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বিক্রিও করছে। আমাদের যদি চেষ্টা থাকে, পরিবেশ দিতে পারি, সঠিক যত্ন নিতে পারি তবে প্রাণীর কল্যাণে ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। জাতীয় চিড়িয়াখানা পেরেছে অন্যরাও পারবে। প্রাণীর প্রতি ভালবাসা শুধু  দিবস বা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পারিবারিকভাবে শিক্ষা দিতে হবে। কারণ আমরা আমাদের সারাজীবন মনে রাখি, পালন করি। কখনোই যেন ভুলে না যাই। তবেই আমরা আমাদের জীবনের প্রতিদিনের প্রয়োজন। প্রাণীকে ভালবাসতে পারব। তার কল্যাণে কাজ করে যেতে পারব। এর ফলে দশ বছরে এদেশের এক ভিন্ন চিত্র দেখতে পাবো।

কিন্তু মানুষ যদি নেতৃত্ব দিয়ে সচেতনতার সাথে এই অবস্থার পরিবর্তন না করে, তবে যে সমস্যা এসেছে এর চেয়েও  প্রবলগতিতে সমস্যা আসবে। এ কারণেই আমাদের পরিবেশ রক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিতে হবে। প্রকৃতির প্রতি আমাদের যে দায়বদ্ধতা সেটা শুধু ভাসা ভাসা নয় বরং এক্টিভ এনগেজমেন্টের মাধ্যমে আন্দোলনমুখীভাবে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে যুক্ত করেই করতে হবে।

মানুষকে সভা, সেমিনার করে, পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সচেতন হতে হবে। এই পৃথিবী আমাদের। একে বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব আমাদের।  



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews