মহররমের অর্ধচন্দ্র উঠলে ইসলামী বর্ষপঞ্জির নতুন বছর শুরু হয়- উৎসব দিয়ে নয়, বরং স্মরণ দিয়ে। এ মাস, বিশেষ করে আশুরার দিনটি, মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত স্মৃতিতে এক পবিত্র ও বেদনাবিধুর স্থান অধিকার করে আছে। এটি এমন এক সময়, যখন হৃদয় ফিরে যায় কারবালার উত্তপ্ত বালুকায়, যেখানে রাসূল মুহাম্মদ সা:-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন ইবনে আলী রা:- একাকী দাঁড়িয়ে থেকেও অপরাজিত ছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। তার এ আত্মত্যাগ ছিল না ক্ষমতার জন্য, ছিল না প্রতিশোধের জন্য- এটি ছিল নীতির জন্য, পবিত্রতার জন্য এবং নবুয়তির আদর্শ রক্ষায়।
কারবালা : ন্যায়ের চিরন্তন উচ্চারণ
৬১ হিজরিতে (৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) ইমাম হোসাইন রা:-এর অবস্থান বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ ছিল না; এটি ছিল ইসলামী নেতৃত্ব সঙ্কটের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। মুআবিয়াপুত্র ইয়াজিদ ইসলামী শূরা বা পরামর্শমূলক নেতৃত্বের নীতির পরিপন্থী পথে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তার শাসন ছিল নৈতিক পতন, সহিংসতা ও ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি অবহেলায় পূর্ণ।
তাই ইমাম হোসাইনের বায়আত না নেয়া ছিল রাজনীতি নয়; বরং বিবেকের ব্যাপার। তিনি বলেছিলেন- ‘আমি বিদ্রোহ করছি, না দুর্নীতির জন্য, না অত্যাচারের জন্য, না বিশৃঙ্খলার জন্য। আমি আমার নানা হজরত মুহাম্মদ সা:-এর উম্মতের সংস্কার করতে চেয়েছি। আমি ন্যায়ের আদেশ দেবো এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করব।’ (ইমাম হোসাইন রা:)
বক্তব্যটি প্রতিধ্বনিত হয় কুরআনের মৌলিক আহ্বানে: ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, ন্যায়ের আদেশ দেয় এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখে- তারা-ই সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান-৩ : ১০৪)
হোসাইনের ঐতিহ্য নিয়ে পণ্ডিতদের মত
হানাফি মাজহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা একবার বলেছিলেন, ‘হোসাইনের বিদ্রোহ না হলে ইসলামের চেহারা চিরতরে পাল্টে যেত।’
ইমাম শাফেয়ি কারবালার কথা স্মরণ করে কেঁদে বলেছিলেন, ‘কারবালায় নবীপরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল, অথচ উম্মাহ নিশ্চুপ রইল... তাদের রক্ত ঝরল, কিন্তু জিহ্বা অবরুদ্ধ রইল।’
ইমাম হোসাইনের আত্মত্যাগকে কবিতায় স্মরণ করেন প্রাচ্যের কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল- ‘শাহ্ আস্ত হোসাইন, বাদশাহ্ আস্ত হোসাইন,/ দীন আস্ত হোসাইন, দীন পনাহ্ আস্ত হোসাইন।/ সর দাদ, নাদাদ দস্ত দর দস্ত-ই ইয়াজিদ,/ হাক্কা কে বেনা-এ ‘লা ইলাহা’ আস্ত হোসাইন’।
অনুবাদ : হোসাইন রাজা, হোসাইন সম্রাট,/ হোসাইনই ইসলাম, ইসলাম রক্ষাকারী।/ তিনি মাথা দিলেন, কিন্তু ইয়াজিদের হাতে হাত দিলেন না।/ নিঃসন্দেহে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-র ভিত্তিই হোসাইন’।
কারবালার সর্বজনীন বার্তা
কারবালা কোনো নির্দিষ্ট মাজহাব বা দলীয় পরিচয়ের বিষয় নয়- এটি সত্য ও মিথ্যার দ্ব›দ্ব। ইমাম হোসাইন কোনো গোষ্ঠী রক্ষায় নয়- ইসলামের আসল আদর্শ রক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন। তার অবস্থান আজো নিপীড়িতদের প্রেরণা জোগায়- যে ধর্ম, যে দেশ বা যে সময়ে হোক না কেন।
মাওলানা রুমি এ বিষয়ে বলেছিলেন, হোসাইনের শাহাদাতের মধ্যে ইসলামের পুনর্জন্ম আছে।
কারবালার নৈতিক শিক্ষা
নৈতিক সাহসিকতা : ইমাম হোসাইন জানতেন, তিনি বাহিনীর শক্তিতে বিজয়ী হতে পারবেন না। কিন্তু নীরবতার বদলে তিনি মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন। এ শিক্ষা প্রতিটি নির্যাতিতের পথপ্রদর্শক। ‘অত্যাচারের মুখে নীরবতা এক প্রকার জুলুম।’ (হজরত আলী রা:)
ত্যাগ মানে ইবাদত : কারবালা শেখায়, আল্লাহর প্রতি সত্যিকার আনুগত্য মানে ন্যায়, দয়া ও মর্যাদার পক্ষে দাঁড়ানো- এমন কি যদি সব কিছু হারাতে হয়।
নেতৃত্বের দায়িত্ববোধ : ইমাম হোসাইন কখনো ক্ষমতা চাননি- তিনি সত্য ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষায় জীবন দিয়েছেন।
জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে- ‘তোমরা জালিমদের দিকে ঝুঁকো না, তাহলে আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে।’ (সূরা হুদ-১১ : ১১৩)
আশুরা : কেবল শোক নয়
আশুরার দিনে রোজা রাখা সুন্নত, কারণ এ দিনে মূসা আ:-কে ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল এবং কারবালার শাহাদাতও এই দিনে সংঘটিত হয়। কিন্তু দিনটি কেবল রীতি নয়, এক আহ্বান- অর্থবোধক শোক, শুধু কাঁদা নয়, সংশোধন করাও স্মরণে কর্ম, শুধু মনে রাখা নয়, পরিবর্তন আনা ও ভালোবাসায় দায়িত্ব, কেবল আহলে বাইতকে প্রশংসা নয়, তাদের আদর্শ অনুসরণও।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারবালার তাৎপর্য
কারবালার ট্র্যাজেডি সপ্তম শতকের মরুভূমিতে থেমে যায়নি- তা আজো প্রতিধ্বনিত হয়, প্রতিটি যুগকে জবাবদিহির মুখে দাঁড় করায়। আজকের পৃথিবীতে, যেখানে অবিচার সাধারণ হয়ে গেছে, যেখানে স্বৈরশাসকরা সত্যকণ্ঠকে রোধ করে, যেখানে মিডিয়া স্বার্থান্বেষী শক্তির হয়ে সত্যকে বিকৃত করে এবং যেখানে মানুষকে সততার চেয়ে ভণ্ডামির ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা হয়- সেখানে কারবালা কেবল ইতিহাস নয়; বরং এক নৈতিক ও আত্মিক দর্পণ।
এই দর্পণ আমাদের জিজ্ঞাসা করে- অন্যায়ের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা হোসাইনের পাশে, না ইয়াজিদের? আমরা কি শুধু দর্শক, না সত্যের সেনানী? আমরা কি নীরবতার আরামে আশ্রয় নিই, না ন্যায়ের জন্য কষ্ট স্বীকারে প্রস্তুত? ড. আলী শরিয়তীর কালজয়ী উক্তি- ‘প্রতিদিনই আশুরা, প্রতিটি স্থানই কারবালা’ এটি কাব্য নয়; বরং চেতনাজাগানিয়া স্মরণ। হোসাইনের মতো নৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান প্রতিদিন আমাদের সামনে আসে। জুলুম বেঁচে থাকে যদি ভালো মানুষেরা চুপ থাকে, নিরপেক্ষরা পিছিয়ে যায় এবং আরামপ্রিয়রা মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কারবালার ট্র্যাজেডি একা ইয়াজিদের তরবারির দ্বারা ঘটেনি; এটি ঘটেছিল কুফাবাসীর নীরবতা, দ্বিধা, ভয় আর বিশ্বাসঘাতকতায়। যারা সত্য জানত কিন্তু নিরাপত্তার নামে নীরব ছিল- ইতিহাস আজো তাদের কার্যকলাপকে বিচার করে। আজ ইয়াজিদ একজন ব্যক্তি নন- একটি পদ্ধতি, একটি ব্যবস্থা, যা জুলুমকে বৈধতা দেয়, বিবেককে অপরাধ বানায়, ধর্মকে অস্ত্র করে ফেলে। আর হোসাইন বাস করে প্রতিটি সেই মানুষে, যিনি বিক্রি হন না, যিনি সত্য বলেন, অত্যাচার সহ্য করেন কিন্তু আত্মসমর্পণ করেন না।
আমরা আজকের কারবালা দেখি গাজার ধ্বংসস্তূপে, কাশ্মিরের চাপা কান্নায়, রোহিঙ্গা শিবিরে, কিংবা সেই সব কারাগারে- যেখানে চিন্তাবিদ, সাংবাদিকরা বন্দী, কেবল সত্য বলার অপরাধে। সেখানে আজো হোসাইন বনাম ইয়াজিদের লড়াই চলছে। ভয় হলো- আমরা মুখে কারবালা স্মরণ করি কিন্তু কাজে ভুলে যাই। আমরা হোসাইনের জন্য কাঁদি, কিন্তু আজকের হোসাইনদের পাশে দাঁড়াই না। আমরা ইয়াজিদকে অভিশাপ দিই কিন্তু নিজের স্বার্থে ইয়াজিদের সাথে আপস করি। এ স্মরণ নয়- এ বিশ্বাসঘাতকতা।
কারবালাকে সত্যিকারে স্মরণ করতে হলে তার আদর্শ আমাদের জীবনে ধারণ করতে হবে। আমরা যেন অপ্রিয় হলেও সত্য বলি, নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াই- এমন কি যদি তাতে আমাদের কষ্ট হয়। কখনো আমাদের আত্মমর্যাদা বিক্রি না করি। হোসাইনের রক্ত কেবল অশ্রু আনবার জন্য ঝরেনি- তা ছিল আমাদের জাগরণের জন্য।
কারবালা অতীত নয়। এটি বর্তমান। এটি এখানেই, আমাদের ভেতরে।
আসুন, কেবল আনুষ্ঠানিকতায় নয়, সঙ্কল্পে কারবালাকে বাঁচিয়ে রাখি।
আসুন, শুধু হোসাইনকে স্মরণ নয়- হোসাইনের মতো হই।
উপসংহার
মহররমের বার্তাকে জীবনভর বয়ে নেয়া। ইমাম হোসাইনের জন্য যে অশ্রু ঝরে, তা নিঃসন্দেহে পবিত্র- কিন্তু তা হোক পরিবর্তনের বীজ বপনের অশ্রু।
আসুন, এমন সন্তান গড়ে তুলি যারা হোসাইনকে কেবল একজন শহীদ হিসেবে নয়, প্রতিরোধ, পবিত্রতা ও সাহসিকতার আদর্শ হিসেবে জানবে।
আসুন, এমন সমাজ গড়ে তুলি যেখানে ক্ষমতা নীতির কাছে মাথা নত করে এবং ঈমান ন্যায়বিচারের অনুপ্রেরণা দেয়। হোসাইনকে ভালোবাসা মানে- হোসাইনের মতো জীবনযাপন।
আমাদের মহররম যেন না হয় কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা-
বরং হোক আত্মজাগরণের এক বিপ্লব।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক