[জাতিসঙ্ঘ এবারই সর্বপ্রথম বৃহত্তর কাশ্মিরে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর রিপোর্ট প্রণয়ন ও প্রকাশ করেছে। কাশ্মির ইস্যু ১৯৪৭ সাল থেকে, অর্থাৎ ৭১ বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায়ই শুধু নয়, বিশ্বের অশান্তির একটি বড় কারণ হয়ে রয়েছে। বিশ্বসংস্থা কাশ্মিরে তাদের তত্ত্বাবধানে নিরপেক্ষ গণভোটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৬৮ বছর আগে। এর বাস্তবায়ন করা জাতিসঙ্ঘেরই দায়িত্ব। কিন্তু তারা এ জন্য খবরদারি তো দূরের কথা, ঠিকমতো নজরদারিও করেনি পরিস্থিতির ব্যাপারে। যা হোক, এত দিনে কিছুটা বোধোদয়ের কারণে জাতিসঙ্ঘ কাশ্মিরে মানবাধিকারের বর্তমান চালচিত্র তুলে ধরেছে।

এটা শুধু ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মির নয়, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ‘আজাদ’ কাশ্মির ও গিলগিট-বাল্টিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপরও আলোকপাত করেছে। তবে নয়াদিল্লি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জাতিসঙ্ঘের রিপোর্টটি প্রত্যাখ্যান করেছে সাথে সাথেই। প্রসঙ্গত অনেকে স্মরণ করবেন, ১৯৪৯ সালে কাশ্মির ইস্যুকে জাতিসঙ্ঘের ফোরামে ভারতই নিয়ে গিয়েছিল। তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুই কাশ্মিরবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। স্থির হয়েছিল, জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গণভোট হবে কাশ্মিরে এবং এর ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, কাশ্মির ভারত না পাকিস্তানের সাথে শামিল হবে; নাকি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু ভারত প্রথমে নানা কূটকৌশলে এবং পরে যুগ যুগ ধরে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কায়েম রেখে সে গণভোট হতে দেয়নি। তদুপরি, কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা রদ করে এ অঞ্চলকে ভারতের একটি প্রদেশের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। সেই সাথে চলছে কাশ্মিরের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম বৈশিষ্ট্য কমানোর অব্যাহত প্রয়াস।

এই প্রেক্ষাপটে এবার জাতিসঙ্ঘ রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ায় ভারতের শাসক মহল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে। অপর দিকে, কাশ্মিরের বিখ্যাত সাংবাদিক সুজাত বুখারির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড, সেখানে পিডিপির সাথে বিজেপির জোট সরকারের অবসান ও ‘রাষ্ট্রপতির শাসন’ নামে কেন্দ্রের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, রমজান মাসে যুদ্ধবিরতির যবনিকা টেনে বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরিদের দমনে সর্বাত্মক অভিযান প্রভৃতি মিলে কাশ্মিরে সামগ্রিক পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত জটিল ও সঙ্কটাপন্ন।
ভারতের বহির্বিষয়ক (পররাষ্ট্র) মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে সি সিং লিখেছেন বক্ষ্যমাণ নিবন্ধটি। এর ভাষান্তর করেছেন মীযানুল করীম। এই লেখায় একজন ঝানু ভারতীয় আমলার গৎবাঁধা মনোভাবের পাশাপাশি কিছু সত্যও উঠে এসেছে।]

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনার অফিসের কাশ্মির বিষয়ক প্রথম রিপোর্ট এবার ভারতকে অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। জম্মু ও কাশ্মির, আজাদ কাশ্মির এবং গিলগিট ও বাল্টিস্তানের বিষয়ে প্রকাশিত ৪৯ পৃষ্ঠার রিপোর্টটির ব্যাপারে নয়াদিল্লি চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে।
৭০ বছর আগে বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদ প্রকাশের বার্ষিকীর সাথে মিল রেখে গত ১৮ জুন জেনেভায় জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশন শুরু হয়েছিল। ৪৭ সদস্যের এই পরিষদ বৈঠক করেছে তিন সপ্তাহ ধরে। এ সময় জম্মু ও কাশ্মিরের পরিস্থিতির ওপর এমন রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে, যার বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে এবং এটা দুঃসংবাদ। ভারত মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নয়। পাকিস্তান ২০২০ সাল পর্যন্ত এর সদস্য। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জায়েদ রা’দ আল হুসাইন জর্দানের শাসক পরিবারের লোক। তিনি বলেছেন, ‘কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সম্পর্কে সামগ্রিক, স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক তদন্তের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন গঠনের জন্য তিনি জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতি আহ্বান জানাবেন।’ এটা ভারতের জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ।

জাতিসঙ্ঘের আলোচ্য রিপোর্টটিতে অনেক ভুল তথ্য রয়েছে। মিডিয়া ও অন্যান্য একপেশে রিপোর্টের ওপর এতে নির্ভর করা হয়েছে। তদুপরি, লস্কর-ই তাইয়েবা/জামায়াত উদ-দাওয়া অথবা হিজবুল মুজাহিদিন জাতিসঙ্ঘের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন। এদের ‘যোদ্ধা’ বলা হয়েছে ওই রিপোর্টে। তাই এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে ভারত ঠিকই করেছে। কিন্তু ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর থেকে ভারত যে কৌশল নিয়েছে, এর দায় ভারত এড়াতে পারে না। এমনকি, ভারতীয় ভাষ্যকার ও বিশ্লেষকরাও এই কৌশলের তীব্র সমালোচনা করেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, নিরাপত্তা বাহিনীর যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়াই কিংবা ‘পেলেট’ গানের নিরাপদ রেঞ্জ নির্দিষ্ট না করেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বিশেষ করে তারা আঘাত পেয়েছে যারা ছুড়েছিল পাথর। এটা তাদের আচরণের তুলনায় শাস্তি হিসেবে বেশি। ভারত এর ফলে কাশ্মির উপত্যকায় বিষাদপূর্ণ শান্ত অবস্থা অর্জন করেছে; কিন্তু জঙ্গিদের নিহত হওয়া কিংবা ধরা পড়ার সাম্প্রতিক সংবাদগুলো ইঙ্গিত দেয়, নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর আচরণের কারণেই জঙ্গি বাহিনীতে যোগ দেয়ার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে।

রমজান মাসে সাধারণ মানুষকে ত্রাণ দেয়া এবং ঈদ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ফলে যে শুভেচ্ছার বার্তা প্রকাশ পাচ্ছিল, তা নস্যাৎ হয়ে গেছে সুপরিচিত ও মধ্যপন্থী কাশ্মিরি সাংবাদিক সুজাত বুখারি এবং আওরঙ্গজেব নামে কাশ্মিরি সেনার হত্যাকাণ্ডে। এ দিকে রমজান মাস শেষ হলে ভারত সরকার যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহার করে নেয়। যারা পাকিস্তানি জঙ্গিদের পরিচালনা করে তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু করা, যাতে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকের সময় কঠোর পদক্ষেপ নেয়। এখন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের আহ্বান মোতাবেক যাতে (কাশ্মিরের ব্যাপারে) কোনো তদন্ত করা না হয়, সে জন্য ভারতকে জোরালো কূটনৈতিক প্রয়াস চালাতে হবে। ভারত এটা বলতে পারে যে, এ ধরনের তদন্ত না করা উচিত মানবাধিকার কাউন্সিলের গাইডলাইন অনুসারে। নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগগুলোর সুরাহা সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে করা যেতে পারে। ভারতে মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, তা চার বছর পর পর আন্তর্জাতিকভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এটা শেষবারের মতো করা হলো গত বছর। সেখানে কাশ্মির ও অন্যত্র মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে, ভারত এখন তা পরীক্ষা করে দেখছে।

মানবাধিকার সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রতিবেদনটি কাশ্মির নিয়ে। জুলাই ২০১৬ থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত সময় এর আওতাভুক্ত। এতে জাতিসঙ্ঘ হাইকমিশনারের ক্ষোভের কারণ হতে পারে, ভারত গত দুই বছর জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধিদলকে জম্মু-কাশ্মির সফর করতে দেয়নি। ভারত বরাবর বলে আসছে, ‘জম্মু ও কাশ্মির ইস্যু ভারতের ঘরোয়া ব্যাপার এবং এটা জাতিসঙ্ঘের আওতার বাইরে।’ এমনকি, জাতিসঙ্ঘের সামরিক পর্যবেক্ষক গ্রুপকেও ভারত কাশ্মিরে যেতে অনুমতি দেয়নি এবং এ ব্যাপারে ভারতের বক্তব্য হলোÑ শিমলা চুক্তি মোতাবেক দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো নির্ধারিত রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত রিপোর্টটি দৃশ্যত ভারসাম্যপূর্ণ। এতে পাকিস্তানের সমালোচনাও করা হয়েছে তার অধিকৃত কাশ্মিরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে। তবে রিপোর্টের মূল টার্গেট হলো ভারত। এতে ভারতের সশস্ত্রবাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইনের (এএফএসপিএ) তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর গত ২৮ বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সশস্ত্রবাহিনীর লোকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলারও অনুমতি দেয়নি।’ কাশ্মিরে ভারতীয় মেজর গগৈ ‘মানবঢাল’ ব্যবহার করার ঘটনাকে অপকৌশল দ্বারা নিরাপত্তা বাহিনীর ফায়দা তোলা হিসেবে জাতিসঙ্ঘ বর্ণনা করেছে। গগৈর সেই ঘটনার তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই ভারতীয় সেনাপ্রধান তাকে পদক দিয়েছেন, যা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। অজিত দোভাল আর নরেন্দ্র মোদি মিলে সন্ত্রাসের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’-এর যে ডকট্রিন দিয়েছেন, সহিংস স্বরূপের কারণে তা আন্তর্জাতিক দেয়ালে ধাক্কা খেয়েছে।

মানবাধিকার কাউন্সিল যাতে কাশ্মিরের ব্যাপারে কোনো ধরনের তদন্ত চালাতে না পারে, সে জন্য ভারতের সব উদ্যোগ নেয়া উচিত। কাউন্সিলের সদস্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকবে না। এ দ্ইু দেশের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে এবং তারা পাকিস্তানি সন্ত্রাস নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ফ্রান্স ও রাশিয়া মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নয়। এমনকি, পাকিস্তানের মিত্র চীন এর সদস্য হলেও তার জিনজিয়াং অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভারতের চেয়ে ঢের খারাপ। সেখানে নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে কৃত্রিম গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে। যেহেতু জাতিসঙ্ঘ কাশ্মির নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করেছে। তাই পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুন খোয়ার পরিস্থিতি উঠে আসেনি। এ রিপোর্টের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী আর পাকিস্তান পরিচালিত জঙ্গিদের সমান দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে।

মোদি সরকার একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে। কারণ, এখন আর হৃদয় ও মনের সংযোগবিহীন, লৌহকঠিন পদক্ষেপ নেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না। কেননা, তার কর্মকাণ্ড জেনেভা থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন সাবেক পরিচালককে জম্মু-কাশ্মির ইস্যুতে সংলাপের দায়িত্ব দিয়ে কেবল আংশিক সাফল্য পাওয়া গেছে। জনগণ চায়, আরো অনেক উচ্চপর্যায়ের পদক্ষেপ। ভারতকে অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমনকি সিনিয়র রাষ্ট্রনায়ক যশবন্ত সিনহার সাথেও কথা বলেননি। যশবন্ত গত এপ্রিল মাসে বিজেপি থেকে পদত্যাগের আগে কাশ্মিরিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews