সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আজ সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর আসার কথা। তিনি সেখানে যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজা দেবেন। রাজা বিক্রমাদিত্য প্রতিষ্ঠিত যশোর রাজ্য আজ আর নেই। তার পুত্র রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের সেই চিহ্নও নেই। তবে তাদের স্মৃতিবিজড়িত কিছু চিহ্ন আজও রয়েছে। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধূমঘাটের এখন কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। সেখানে ছিল সেনাদুর্গ।

রাজা প্রতাপের সেই রাজধানী ধূমঘাট এখন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুরের কাছাকাছি একটি গ্রাম। রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাদুর্গও ছিল এখানে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা তথ্য থেকে জানা যায়, যশোর রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পূর্বে মধুমতী নদী, পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে বর্তমান যশোর জেলা এবং দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর।

কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা বলেছেন, এর বিস্তৃতি ছিল বর্তমান কালীগঞ্জের বসন্তপুর থেকে ধূমঘাট পর্যন্ত। একে বলা হতো পঞ্চক্রোসী। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের সাত গ্রামের একটি ধূমঘাট। অন্যগুলো হচ্ছে-ঈশ্বরীপুর, খাগড়াঘাট, গুমনতলি, শ্রীফলকাঠি, বংশীপুর ও গুটলেকাটি। এ ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।

যমুনা ও ইছামতী নদী এ ইউনিয়নের বংশীপুরে এসে পৃথক হয়ে গেছে। এ এলাকাকেই প্রাচীন যশোর রাজ্যের রাজধানী হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এখানে রয়েছে যশোরেশ্বরী কালীমন্দির, হাম্মামখানা (স্নানাগার), বংশীপুরের টেঙ্গা মসজিদ ও গির্জা। রয়েছে দুটি দিঘি। এছাড়া বারোদুয়ারি নামের প্রাচীন স্থাপনার ভগ্নাবশেষ।

জানা যায়, বংশীপুরের মসজিদের কাছে অনেক কবর রয়েছে। এখানে শায়িত রয়েছেন রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীর নিহত সেনা সদস্যরা। তার সেনাবাহিনীর মুসলমান সদস্যরা নামাজ আদায় করতেন বংশীপুর শাহী মসজিদে, হিন্দু সদস্যরা পূজা দিতেন যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে এবং খ্রিষ্টান সদস্যরা উপাসনা করতেন গির্জায়।

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, শ্রীহরি নামের এক ব্যক্তির ওপর ছিল দাউদ কররানির সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। মোগলদের বাংলা আক্রমণকালে দাউদ কররানি পরাজিত ও নিহত হন। এ সময় শ্রীহরি রাজকোষের সমুদয় ধনরত্ন নিয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি নিজের নাম বিক্রমাদিত্য রায় ঘোষণা করে দুর্গ, রাজবাড়ি ও মন্দির স্থাপন করে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা দেন। ১৫৮৩ সালে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু হয় এবং ১৫৮৪ সালে তার পুত্র রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক ঘটে। ১৫৮৭ সালে ধূমঘাটে দুর্গ স্থাপিত হয় এবং যশোরেশ্বরীর আবির্ভাব ঘটে।

১৫৯১ সালে রাজা প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিছুকাল পর মানসিংহ কালিন্দী নদী পার হয়ে বসন্তপুরে সেনাছাউনি স্থাপন করেন। তার লক্ষ্য ছিল প্রতাপাদিত্যের রাজ্য আক্রমণ করা। এ খবর পেয়ে যশোর রাজ্যের প্রজারা মৃত্যুভয়ে পালিয়ে ধূমঘাটের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ সময় দুপক্ষে যুদ্ধ বেধে যায়। মানসিংহ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন। তার সঙ্গে ছিল বিশাল অশ্ববাহিনী। অপরদিকে রাজা প্রতাপাদিত্যের তুর্কি সেনাসহ অন্যান্য সেনা মিলে ৫২ হাজার সেনা ছিল।

এর মধ্যে ছিল বিপুলসংখ্যক ধানুকি, ১৩শ’ হস্তি ও ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যও ছিল। একই সঙ্গে তার ছিল সড়কিধারী বিপুলসংখ্যক অনিয়মিত সৈন্য। বেশ কয়েকদিনের যুদ্ধে রাজা প্রতাপাদিত্য মানসিংহের কাছে পরাজিত হন। অথচ যুদ্ধে জয়লাভ করেও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে মানসিংহ তার সঙ্গে সন্ধি করেন।

সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’, আবদুল জলিলের ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’সহ বিভিন্ন ইতিহাসে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। জানা যায়, ১৫৬০ থেকে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হন ঈশ্বরীপুর এলাকায় একটি মন্দির নির্মাণ করার। মন্দিরটি নির্মাণের পর সেটি বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে ওঠে। সেসময় শ্যামনগরের ধূমঘাট ছিল বাংলার বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী।

রাজা প্রতাপাদিত্য ও তার সেনাপতি খাজা কামালউদ্দিন এ সময় দেখতে পান ওই জঙ্গল থেকে এক ধরনের ধোঁয়া ও আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসছে। তিনি তখন মন্দিরটি খোলার নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে মন্দিরটি খুললে সেখানে দেখা মেলে চণ্ডভৈরবের আবক্ষ ঘনকৃষ্ণবর্ণ শিলামূর্তির। তখন থেকে সেখানে পূজা-অর্চনা শুরু হয়ে যায়।

তিনি মন্দিরটি সংস্কার করে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। অপরাপর ইতিহাসবিদ বলেন, আনারি নামের একজন ব্রাহ্মণ এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ১০০টি দরজা ছিল। এখান থেকেই আলোর রেখা জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত। মানুষের হাতের তালুর আকারের এ আলোকরেখা রাজা প্রতাপাদিত্য দেখতে পান।

ইতিহাস ও পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী আরও জানা যায়, দক্ষ রাজার কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল সতীবালা। তিনি মহাদেবের পূজারিনি ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি স্বেচ্ছায় মহাদেবকে বিয়ে করেন। এতে দক্ষ রাজার ঘোর আপত্তি ছিল। তার জামাতা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে, মাথায় জটা থাকবে, গণ্ডদেশে সাপ থাকবে, হাতে ত্রিশূল থাকবে এবং তিনি পশুর চামড়া পরিধান করবেন-এমনটি হতে পারে না। এ কারণে জামাতাকে মেনে নেননি দক্ষ রাজা। আরও জানা যায়, শিবের এক অনুষ্ঠানে দক্ষ রাজার নিমন্ত্রণ না হওয়ায় রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে দক্ষযজ্ঞ শুরু করেন। এ দক্ষযজ্ঞকে কেন্দ্র করে দক্ষ রাজা ও মেয়ে সতীবালার মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়।

অপমানিত হয়ে একপর্যায়ে সতীবালা ব্রহ্মার কাছে নিবেদন করেন, আমার মৃত্যু দাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই সতীবালা দেহত্যাগ করেন। এ খবর পেয়ে কৈলাস থেকে দ্রুতবেগে নেমে আসেন মহাদেব। তিনি দক্ষ রাজার মুণ্ডু কর্তন করে বলির জন্য নিয়ে আসা ছাগ মুণ্ডু কেটে সেখানে বসিয়ে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ লন্ডভন্ড করে দেন। পরে তিনি মৃত স্ত্রী সতীবালাকে কাঁধে নিয়ে কৈলাস পাহাড়ে গিয়ে রাগে-ক্ষোভে ও দুঃখে ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

এ খবর পেয়ে ব্রহ্ম ও বিষ্ণু সিদ্ধান্ত নিলেন মহাদেবকে ঠান্ডা করতে হলে তার কাছ থেকে সতীবালার মৃতদেহ সরিয়ে নিতে হবে। সে অনুযায়ী সুদর্শন ত্রিশূলে সতীবালাকে ঘোরানো হয়। ঘূর্ণনের ফলে সতীবালার দেহ ৫১ খণ্ডে খণ্ডিত হয়। এর এক খণ্ড পতিত হয় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় যশোরেশ্বরী কালীমন্দির। অপর খণ্ডগুলো পশ্চিমবঙ্গের কালীঘাট, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বয়োবৃদ্ধরা জানান, তারা তাদের পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছেন, ঈশ্বরীপুর এলাকায় যশ নামের একজন খেয়ামাঝি ছিলেন। তাকে ঈশ্বর বলেও ডাকত কেউ কেউ। এক রাতে এক নারীমূর্তি খেয়ামাঝিকে বলেন, তাকে নদী পার করিয়ে দিতে হবে। তিনি পার করার সময় অন্ধকারে দেখতে পান ওই নারীমূর্তিকে কেন্দ্র করে পুরো নৌকা ও নদীতে আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি তাকে প্রণাম করেন এবং তার কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। পরে ঈশ্বরীপুরে যে মন্দিরটি স্থাপিত হয়, তার নাম দেওয়া হয় ‘যশোরেশ্বরী’ কালীমন্দির। সেখানেই রয়েছে ঘনকৃষ্ণ আবক্ষ মূর্তি শক্তিপীঠ।

ইতিহাসপ্রাচীন ও পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ এ ঈশ্বরীপুর গ্রামে রয়েছে চণ্ডভৈরবের ত্রিকোণ মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। রয়েছে পদ্মপুকুর এবং রাজা প্রতাপাদিত্যের দরবার বলে পরিচিত বারোদুয়ারি অট্টালিকা। বলা হয়, এ দরবারের দরজা ছিল ১২টি। সেখান থেকে এর নাম হয় বারোদুয়ারি।

কথিত আছে, রাজা প্রতাপাদিত্য যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন-এ খবর শুনে তার স্ত্রী শরৎ কুমারী তাকে বহনকারী বজরা ডুবিয়ে আত্মহনন করেন। প্রতাপাদিত্যের দুর্গের কাছেই ছিল কুচকাওয়াজের জায়গা। যশোর রাজ্যের অন্যতম নিদর্শন একটি গির্জা। খ্রিষ্টান নৌসেনাদের উপাসনার জন্য স্থাপিত হয় এটি।

যশোরেশ্বরী মন্দিরের কাছেই রয়েছে একটি ভগ্নস্তূপ। একে বলা হয় হাম্মামখানা। রাজা প্রতাপাদিত্যের পারিবারিক রাজকীয় স্নানাগার ছিল এটি। এর ভেতরে গভীর চৌবাচ্চার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে জল আসা-যাওয়ার সুড়ঙ্গ ছিল। হাম্মামখানায় রয়েছে গম্বুজ। বড় গম্বুজের চারপাশে ছিল আরও কয়েকটি গম্বুজ। সূর্যের রশ্মির মাধ্যমে এ স্নানাগারে আলো আনা হতো। ঈশ্বরীপুরের মন্দির ও হাম্মামখানার কাছাকাছি এলাকায় বংশীপুর গ্রামে রয়েছে ঐতিহাসিক পাঁচ গম্বুজ মসজিদ।

এর নাম টেঙ্গা মসজিদ। বিশাল আয়তনের পুরু দেওয়াল বিশিষ্ট এ মসজিদে কয়েকটি প্রবেশপথ রয়েছে। এ মসজিদে হাজার হাজার মুসল্লি নামাজ পড়ে থাকেন। মসজিদের পাশে এক গম্বুজের একটি ইমারত ছিল। এটি ছিল মহিলাদের নামাজঘর।

জানা যায়, রাজা প্রতাপাদিত্য ১৫৯১ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে ১৬০৮ সালে সন্ধি হয় বঙ্গের সুবেদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে। ১৬০৯ সালে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় ঢাকায়। ১৫০৯-১৫১০ সালে ধূমঘাটে নৌযুদ্ধে পরাজিত হন রাজা প্রতাপাদিত্য। তাকে পাঠানো হয় ঢাকায়।

বন্দি অবস্থায় কিছুদিন পর তিনি খাঁচাবন্দি হয়ে আগ্রায় প্রেরিত হন। পথিমধ্যে বারানসিতে ৫০ বছর বয়সে মারা যান রাজা প্রতাপাদিত্য। রাজার স্মৃতিবিজড়িত বহু পূরাকীর্তিসমৃদ্ধ সেই ঈশ্বরীপুর জৌলুস হারিয়েছে বহু আগেই। এখন রয়েছে শুধু ভগ্নাবশেষ।

১৯ বর্গকিলোমিটারের যশোর রাজ্যের রাজধানী শহর ঈশ্বরীপুরে এখন দৃশ্যমান ১১টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে শিক্ষার হার ৭৬ শতাংশ, প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২১টি, হাইস্কুল ৪টি ও মাদ্রাসা ১২টি। স্থানীয় বাসিন্দাদের ৭৬ শতাংশ মুসলমান, ২১ শতাংশ হিন্দু এবং অন্যান্য ৩ শতাংশ। তারা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেন বলে জানান ঈশ্বরীপুর ইউপি চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শোকর আলি।

সুভাষ চৌধুরী : সাতক্ষীরা প্রতিনিধি, যুগান্তর



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews