ট্রাম্প প্রশাসন জ্ঞানের উপর একটি পরিকল্পিত এবং নির্মম আক্রমণ শুরু করেছে, যা শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের মূল ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস করছে। এই ইচ্ছাকৃত ধ্বংস আমেরিকার অগ্রগতির মূল কাঠামো ভেঙে ফেলছে, যা দেশকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে যে অন্ধকার যুগ এসেছিল, তার মতো একটি আধুনিক অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে পারে। রোমের পতন, ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন, ইতিহাসের একটি জটিল ঘটনা ছিল। যা কোনো একক আক্রমণের ফল নয়। বরং একাধিক হামলা, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং বাহ্যিক চাপের সম্মিলিত ফলাফল। ঐতিহাসিকভাবে ‘রোম ধ্বংসকারী যোদ্ধা’ বলতে বিভিন্ন বর্বর জনগোষ্ঠীকে বোঝান, যারা রোমান সাম্রাজ্যের সীমানায় আক্রমণ চালিয়েছিল।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ভিসিগথ, ৪১০ খ্রিস্টাব্দে ভিসিগথ নেতা অ্যালারিক রোম শহর লুণ্ঠন করেন। এটি ছিল রোম শহরের প্রথম বড় ধরনের ধ্বংস। ভিসিগথরা জার্মানিক উপজাতি ছিল, যারা সাম্রাজ্যের সীমানায় বসতি স্থাপন করেছিল। রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তারা শহরে হামলা চালায়, যা সাম্রাজ্যের দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছিল। ভ্যান্ডাল, ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভ্যান্ডালরা, আরেকটি জার্মানিক গোষ্ঠী, রোম শহর লুণ্ঠন করে। তাদের নেতা গাইসেরিক উত্তর আফ্রিকা থেকে এসে শহরে আক্রমণ চালায়। এই ঘটনা থেকেই ‘ভ্যান্ডালিজম’ শব্দটির উৎপত্তি, যা ধ্বংসাত্মক আচরণকে বোঝায়। ভ্যান্ডালদের আক্রমণ রোমের সম্পদ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। অস্ট্রোগথ, ৫ম শতাব্দীতে অস্ট্রোগথরা, থিওডোরিকের নেতৃত্বে, ইতালিতে ক্ষমতা দখল করে। যদিও তারা রোম শহরকে সরাসরি ধ্বংস করেনি, তাদের আগমন রোমান শাসনের দুর্বলতাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছিল। অস্ট্রোগথরা রোমান প্রশাসনের কাঠামো ব্যবহার করলেও সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। হান, হানরা, অ্যাটিলার নেতৃত্বে, ৫ম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক হামলা চালায়। ৪৫২ খ্রিস্টাব্দে তারা ইতালি আক্রমণ করে, যদিও রোম শহর সরাসরি লুণ্ঠন করেনি। তাদের আক্রমণ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ক্ষয় করেছিল। এ ক্ষয় পরোক্ষভাবে পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল। হারুলি, ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে হারুলি নেতা ওডোয়াকার শেষ পশ্চিম রোমান সম্রাট রোমুলাস অগাস্টুলাসকে ক্ষমতাচ্যুত করে রোম দখল করে। এই ঘটনাকে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন হিসেবে গণ্য করা হয়। ওডোয়াকারের শাসন রোমান শাসনের শেষ চিহ্ন মুছে দিয়েছিল।
এছাড়া রোম পতনের অভ্যন্তরীণ কারণও ছিল। রোমের পতন কেবল বাহ্যিক আক্রমণের ফল ছিল না। অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামরিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সাম্রাজ্যকে ভঙ্গুর করে তুলেছিল। অর্থনৈতিক সঙ্কট, উচ্চ কর এবং ক্রমাগত গৃহযুদ্ধ রোমের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছিল। সাম্রাজ্যের সীমানায় বসতি স্থাপনকারী বর্বর গোষ্ঠীগুলো এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিল। রোমের গ্রন্থাগার, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ধ্বংস ইউরোপকে অন্ধকার যুগে নিক্ষেপ করেছিল। গোটা মহাদেশে জ্ঞান উৎপাদন এবং সংরক্ষণের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
দ্যা আটলান্টিকে এ নিয়ে আরো লিখেছেন সাময়িকীটির স্টাফ রাইটার অ্যাডাম সারওয়ার। রোমের এই পতনের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের আক্রমণের তুলনা করেছেন তিনি। রোমের ধ্বংসকারীরা অজান্তেই জ্ঞানের ক্ষতি করেছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এই আক্রমণ ইচ্ছাকৃত। আক্রমণের উদ্দেশ্য তথ্য নিয়ন্ত্রণ করা। ট্রাম্পের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন সত্যকে দমন করা। এই পদক্ষেপ আমেরিকার জ্ঞান সৃষ্টি বা উৎপাদনের ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের এ পদক্ষেপ মার্কিন অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন উদাহরণ সামনে আসছে। প্রশাসন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ফেডারেল তহবিল বন্ধের হুমকি দিচ্ছে। এমনকি প্রশাসনের দাবি মেনে নিলেও তহবিল বন্ধের হুমকি রয়েই যাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রধান প্রধান কেন্দ্র, যেমন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পড়ছে। ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান যেমন স্মিথসোনিয়ান এবং শৈল্পিক প্রতিষ্ঠান যেমন কেনেডি সেন্টারকে ঐতিহাসিক সত্যের পরিবর্তে কথিত ম্যাগা বা মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন মতাদর্শের আস্তানায় রূপান্তরিত করা হচ্ছে। গ্রন্থাগারগুলো তহবিল হারাচ্ছে। সরকারি বিজ্ঞানীরা চাকরি হারাচ্ছেন। শিক্ষকরা নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আর গবেষকদের নিষিদ্ধ বিষয়ে কথা না বলতে হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে সংগৃহীত জনস্বাস্থ্য তথ্যের ডেটাবেস বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। ট্রাম্পবাদের বিরোধী যেকোনো তথ্যকে ‘ধর্মবিরোধী’ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের জ্ঞানের উপর আক্রমণের সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষ্যবস্তু হলো আমেরিকার উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা। ঐতিহাসিকভাবে উদ্ভাবন, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সামাজিক গতিশীলতার কেন্দ্র মার্কিন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অভূতপূর্ব হুমকির মুখে। প্রশাসন বিলিয়ন ডলার ফেডারেল তহবিল কেটে দিয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ কোটি ডলারের বেশি, প্রিন্সটন ২১ কোটি ডলার এবং চিকিৎসা গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ৮০ কোটি ডলার গ্রান্ট হারিয়েছে। এই কাটছাঁটের ফলে গবেষণা বন্ধ। চাকরি হ্রাস এবং গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য প্রকল্প বাতিল হচ্ছে। উদাহারণ, বাল্টিমোরে মা-শিশু স্বাস্থ্য সহায়তা এবং মোজাম্বিকে মশারি বিতরণ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো নির্দিষ্ট দাবি ছাড়াই তহবিল বন্ধ করেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলেছে।
অর্থনৈতিক চাপের পাশাপাশি, ট্রাম্পের প্রশাসন মতাদর্শিক ভাবধারা চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রম, নিয়োগ নীতি এবং গবেষণার অগ্রাধিকার ট্রাম্পের মতাদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করতে বাধ্য করা হচ্ছে। নইলে আরো শাস্তির মুখে পড়তে হবে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মামলা করছে। এর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, কোনো সরকার—দল যাই হোক না কেন—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী শেখাবে, কাকে ভর্তি বা নিয়োগ করবে এবং কোন গবেষণার ক্ষেত্র অনুসরণ করবে, তার নির্দেশ দিতে পারে না। এদিকে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ৪০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল ধরে রাখার লোভে ট্রাম্পের দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এরপরো নতুন, আরো হস্তক্ষেপমূলক শর্তের মুখোমুখি হয়েছে মার্কিন সরকারের নিয়ন্ত্রণকে দীর্ঘায়িত করতে পারে প্রশাসন আদালতের মাধ্যমে জোরপূর্বক এমন একটি ডিক্রি আরোপ করার কথাও বিবেচনা করছে।
ওয়েস্ট পয়েন্ট মিলিটারি একাডেমিতে প্রশাসনের শিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সেখানকার নেতৃত্ব জাতি, লিঙ্গ বা আমেরিকার ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় নিয়ে যেকোনো পাঠ্য উপকরণ সরিয়ে ফেলার জন্য প্রতিষ্ঠানব্যাপী উদ্যোগ নিয়েছে। গণহত্যার উপর একটি কোর্স পরিচালনাকারী একজন অধ্যাপককে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন ভূমিসন্তান আমেরিকানদের ওপর চালানো অত্যাচারের কথা উল্লেখ না করা হয়। ইংরেজি বিভাগ টনি মরিসন, জেমস বাল্ডউইন এবং তা-নেহিসি কোটসের মতো বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের সাহিত্যকর্ম সরিয়ে ফেলেছে। এটি শিক্ষার পরিশোধন নয়। বরং ইতিহাস এবং সত্যকে মুছে ফেলে ট্রাম্পের মতাদর্শ প্রচার করার প্রচেষ্টা। এই পদক্ষেপগুলো ফুটিয়ে তুলেছ যে মার্কিন প্রশাসন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চায়, যা তাদের রাজনৈতিক আখ্যানকে সমর্থন করে এবং তাদের জন্য অস্বস্তিকর সত্যকে দমন করে।
বিজ্ঞানের উপর আক্রমণও চলছে। এই আক্রমণ শিক্ষাক্ষেত্রে বাইরেও বিস্তৃত। আক্রমণ চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্য করে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (এনআইএইচ) এবং ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (এনএসএফ) এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে এনআইএইচ ২০০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল এবং ১৩০০ কর্মী হারিয়েছে। এর ফলে শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসা, ডিমেনশিয়া এবং স্ট্রোক নিয়ে গবেষণা থমকে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। এনএসএফ-এর কর্মী এবং বাজেট ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি কমানোর পরিকল্পনা চলছে। বিশেষ করে প্রান্তিক গোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করে সে সব ক্ষেত্রে অনুদানগুলোকে কমানোর পায়চারি চলছে। প্রশাসন এই গবেষণাগুলোকে ‘ডিইআই’ (বৈচিত্র্য, সমতা, অন্তর্ভুক্তি) বলে খারিজ করছে। শত শত এনএসএফ অনুদান এরই মধ্যে বাতিল করা হয়েছে। নাসা, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি), এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) এবং ডিপার্টমেন্ট অফ এনার্জির মতো সংস্থাগুলোও উল্লেখযোগ্য তহবিল হ্রাসের ভয়াবহ ভাটায় মুখে।
সরকারি বিজ্ঞানীদের মুখবন্ধ করা হচ্ছে বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করে সিডিসিতে এমন হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) খাদ্য ও ওষুধে দূষণ পরীক্ষাকারী বিজ্ঞানী এবং ওষুধের বিজ্ঞাপনে মিথ্যা দাবি পর্যবেক্ষণকারী গবেষকদের হারিয়েছে। ইপিএ-র পুরো গবেষণা শাখা বিলুপ্ত করা হচ্ছে। কৃষি বিভাগের ফরেস্ট সার্ভিস গবেষণা দল, যারা আগুনের ঝুঁকি, বাজার, বন পুনরুদ্ধার এবং পানি ব্যবস্থাপনার আদল বা মডেল তৈরি করে, তাদেরকে ছাঁটাইয়ের মুখে ফেলা হয়েছে। ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হারিয়েছে। অঙ্গরাজ্যগুলোর দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষমতা এবং সাধারণ মানুষের আবহাওয়া রিপোর্টের উপর প্রভাব ফেলছে এ সব তৎপরতা।
দশকের পর দশক ধরে সংগৃহীত জনস্বাস্থ্য তথ্য মুছে ফেলা হচ্ছে। প্রশাসন লিঙ্গ, বৈচিত্র্য, সমতা, অন্তর্ভুক্তি এবং পরিবেশগত ন্যায় নিয়ে গবেষণা, প্রকাশিত এবং চলমান উভয়ই, অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে। এনআইএইচ কর্মীদের কিছু গবেষণার প্রকল্প সনাক্ত করে সম্ভাব্যভাবে বাতিল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগে সেক্রেটারি রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র এক ডজনেরও বেশি ডেটা-সংগ্রহ প্রোগ্রাম বন্ধ করেছেন। ফলে মৃত্যু এবং রোগের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বিস্তার কিভাবে ঘটে তা জানা কঠিন হয়ে যাবে। একজন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পেশাদার ব্যক্তিত্ব, প্রতিশোধের ভয়ে নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, কোনো সমস্যা অধ্যয়ন না করতে পারা মানে সমস্যাটি নেই তা নয়। এর মানে আমরা জানি না এটি আছে কিনা, কারণ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত নেই।
ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধ্বংসের কাজে মাতোয়ারা হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই প্রশাসনের আক্রমণ থেকে ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও রক্ষা পায়নি। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন আমেরিকার জাতিগত নিপীড়নের ইতিহাস স্বীকার করার জন্য সমালোচিত হয়েছে। বোস্টনের একটি কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস জাদুঘর, যেখানে দাসত্ববিরোধী নেতা ফ্রেডরিক ডগলাস এবং উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার ফেডারেল অনুদান বন্ধ করা হয়েছে। ‘হোয়াইট হাউসের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’ বলেই তা বন্ধ করা হয়। ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ট ফর দ্য হিউম্যানিটিস এবং ইনস্টিটিউট অফ মিউজিয়াম অ্যান্ড লাইব্রেরি সার্ভিসেসের বাজেট কমানো হচ্ছে। এতে গোটা মার্কিন মুল্লকের গ্রন্থাগার এবং জাদুঘরগুলোকে হুমকির মুখে পড়েছে। লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রধান কার্লা হেইডেনকে বরখাস্ত করেছেন ট্রাম্প।
প্রশাসনের নির্বাহী আদেশগুলো ইতিহাসকে বিকৃত করছে। একটি আদেশ কে-১২ পাবলিক স্কুলগুলোকে আমেরিকার ইতিহাসের দাসত্ব এবং জিম ক্রোর মতো অন্ধকার অধ্যায় বাদ দেয়া বা হালকা করে তুলে ধরা একটি শোধিত সংস্করণ শেখাতে বাধ্য করছে। মার্কিন শিক্ষামন্ত্রী লিন্ডা ম্যাকমাহন তার শুনানিতে কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস শেখানো বৈধ কিনা তা স্পষ্ট করতে অস্বীকার করেছেন। আরেকটি আদেশ স্মিথসোনিয়ানকে আক্রমণ করেছে, কারণ তারা বলেছে যে জাতি একটি জৈবিক বাস্তবতা নয়, বরং একটি সামাজিক গঠন। এটি জেনেটিক বিজ্ঞানের দ্বারা সমর্থিত একটি সত্য, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের বিশ্বাসের বিরোধী বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
মার্কিন অর্থনৈতিক তথ্যের নানা হেরফের হচ্ছে। ট্রাম্পের নীতির ক্ষতিকর প্রভাব লুকানো মার্কিন বর্তমান প্রশাসন অর্থনৈতিক তথ্য রদবদল করার পরিকল্পনা করছে। জিডিপি হিসাব থেকে সরকারি ব্যয় আলাদা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ট্রাম্প অতীতে, ডেমোক্রেটিক প্রশাসনের সময়, প্রমাণ ছাড়াই ফেডারেল সংস্থাগুলোকে অর্থনৈতিক তথ্য জাল করার অভিযোগ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এই ধরনের হস্তক্ষেপ সম্ভাব্য মন্দা লুকাতে পারে, জনগণকে অন্ধকারে রাখতে এবং প্রশাসনকে জবাবদিহিতা এড়াতে সক্ষম করবে।
এদিকে মার্কিন প্রশাসনে জবাবদিহিতার ধ্বংস করা হচ্ছে। জবাবদিহিতা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকারি দুর্নীতি এবং অপব্যবহার তদন্ত করে যে সব ইন্সপেক্টর জেনারেল তাদের অবৈধভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ফেডারেল আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার, মামলা বা দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ডেটাবেস মুছে ফেলা হয়েছে। ফলে অপরাধে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের নতুন চাকরি পাওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল আর্কাইভের প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক নথিপত্র রদবদল বা ধ্বংস করা হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কনজিউমার ফাইনান্সিয়াল প্রোটেকশন ব্যুরো এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো স্বাধীনতা হারাচ্ছে। এসইসি ১০০টিরও বেশি চলমান তদন্ত বন্ধ করেছে। ফলে শিল্পের তদারকি এবং করপোরেট অপকর্মের রেকর্ড তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করছে।
জন কিউ ব্যারেট, সেন্ট জনস ইউনিভার্সিটির একজন আইন অধ্যাপক এবং ১৯৯০-এর দশকে বিচার বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কার্যালয়ে কর্মরত, এই ধরনের তদন্তের উদাহরণ দিয়েছেন। একটি ক্ষেত্রে, এফবিআই ক্রাইম ল্যাবে বছরের পর বছর ধরে ফরেনসিক প্রমাণের ভুল ব্যবহার, ভুল বিশ্লেষণ এবং ত্রুটিপূর্ণ অনুশীলন উন্মোচিত হয়েছিল। আরেকটি তদন্তে ব্যুরো অফ প্রিজনের কর্মকর্তারা মাদক পাচার এবং সংগঠিত অপরাধে সহায়তার জন্য ঘুষ নেয়ার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছিল। এই ধরনের তদন্ত ছাড়া, ব্যারেট সতর্ক করেছেন, ‘ক্ষুদ্র দুর্নীতি বৃদ্ধি পাবে।’ ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ এই ধরনের দুর্নীতিকে সহজতর করছে।
দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ট্রাম্প প্রশাসনের জ্ঞানের উপর এই আক্রমণের দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি গভীর। আমেরিকার বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আধুনিক কৃষি, চিকিৎসা, ইন্টারনেট, জিপিএস, টাচ স্ক্রিন ফেডারেল তহবিলের উপর নির্ভর করেছিল। এই সমর্থন কমে গেলে উদ্ভাবন স্থবির হবে। বেসরকারি খাত, যা মুনাফার উপর নির্ভরশীল, এই শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ, এক্সন মবিল কয়েক দশক আগে জলবায়ু পরিবর্তনের সত্যতা জানতো। কিন্তু সঠিক তথ্যের বিপরীতে তারা সন্দেহ ছড়িয়ে দিয়েছিল।
সামাজিক সমস্যা, যেমন জাতিগত এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য, অধ্যয়ন ছাড়া সমাধান করা কঠিন। এই গবেষণাগুলোকে ‘ছি ছি’ বলে খারিজ করা হচ্ছে, যদিও এগুলো জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিলিপ অ্যাটিবা সলোমন বলেছেন, এই আক্রমণ প্রশাসনের সত্যের প্রতি মতাদর্শিক অস্বস্তির ফল। জনগণ, সঠিক তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মিথ্যা তথ্যের শিকার হবে, যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমে হামের প্রাদুর্ভাব কড-লিভার তেল দিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ।
প্রশাসন উচ্চশিক্ষিত কর্মীদের, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের, সংখ্যা কমাতে চায়, যাতে ডেমোক্রেটিক ভোটার ঘাটি হ্রাস পায়। সরকারি কাজ বেসরকারিকরণ এবং অপরীক্ষিত এআই দিয়ে কর্মী প্রতিস্থাপন এলন মাস্কের মতো ধনী বিনিয়োগকারীদের সমৃদ্ধ করবে ঠিকই। কিন্তু মার্কিন সরকারি সেবার মান হ্রাস করবে। জ্ঞান সৃষ্টি ও উৎপাদনের প্রক্রিয়া ধ্বংস করে মার্কিন প্রশাসন নিশ্চিত করছে যে তাদের দুর্নীতি, অপব্যবহার এবং লুটপাটের কোনও জবাবদিহিতা থাকবে না।
ট্রাম্প প্রশাসনের জ্ঞানের উপর এই আক্রমণ কেবল শিক্ষিত বা অভিজাত শ্রেণীকে শাস্তি দেয়া নয়, এটি আমেরিকার ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পথ। এটি একটি নতুন অন্ধকার যুগের সূচনা করতে পারে, যেখানে সত্যের জায়গায় প্রচারণা, সমাধানের জায়গায় সমস্যা এবং অগ্রগতির জায়গায় পশ্চাদপসরণ থাকবে। এর বিরুদ্ধে যদি প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়, এই ক্ষতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমেরিকাকে পীড়ন করবে।
অ্যাডাম সারওয়ারের লেখায় ট্রাম্প প্রশাসনের জ্ঞানের উপর আক্রমণকে রোমের পতনের পর অন্ধকার যুগের সাথে তুলনা করেছেন। রোমের পতনের পর জ্ঞানের ধ্বংস ইউরোপকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করলেও, আরব মুসলমান পণ্ডিতরা সেই জ্ঞান সংরক্ষণ করে পরবর্তী পুনর্জাগরণের পথ প্রশস্ত করেছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি যেমন শিক্ষা, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের উপর আক্রমণ একইভাবে জ্ঞান সৃষ্টি ও উৎপাদন এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে। তবে রোমের ক্ষেত্রে যেখানে আরব মুসলমানরা জ্ঞান রক্ষার ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের আক্রমণের এই ধ্বংস থেকে জ্ঞানকে রক্ষা করতে পারে এখনো এমন কোনো শক্তির আভাস ইতিহাসের দিগন্তে স্পষ্ট নয়। ফলে আমেরিকা একটি নতুন অন্ধকার যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, যেখানে সত্যের পরিবর্তে প্রচারণা এবং অগ্রগতির পরিবর্তে পশ্চাদপসরণ প্রাধান্য পাবে।
আরব মুসলমান পণ্ডিতদের অনুবাদ আন্দোলন গ্রিকো-রোমান জ্ঞানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে এবং তা সমৃদ্ধ করে বিশ্ব সভ্যতার জন্য একটি অমূল্য অবদান রেখেছিল। এই জ্ঞান ইউরোপে ফিরে এসে রেনেসাঁস এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের জন্ম দেয়। পরে এই বিপ্লব আধুনিক দুনিয়ার ভিত্তি তৈরি করে। ট্রাম্প প্রশাসনের জ্ঞানের উপর আক্রমণের প্রেক্ষাপটে এই ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জ্ঞান সংরক্ষণ এবং প্রসারের গুরুত্ব অপরিসীম। যদি এই আক্রমণ অব্যাহত থাকে, তবে আমেরিকার জ্ঞানভিত্তিক সমাজের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। এর থেকে উত্তরণের জন্য আরব মুসলমান পণ্ডিতদের মতো দূরদর্শী উদ্যোগের প্রয়োজন হবে।