নয়া দিগন্ত ডেস্ক

  • ৯৪ শতাংশ হাসপাতাল ধ্বংস
  • নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫৩,৯০১

ভয়ঙ্কর ক্ষুধা যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায়। তীব্র সমালোচনার মুখে সম্প্রতি সেখানে ত্রাণ পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে দখলদার ইসরাইল। ত্রাণবোঝাই ট্রাক লুটের আশঙ্কায় মোতায়েন করা হয়েছে গাজার স্বশাসিত নিরাপত্তারক্ষীদের। তাদের ওপরেই এবার হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের সেনারা। এতে নিহত হয়েছেন ছয়জন, আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। এরা সবাই স্থানীয় নাগরিক বলে জানা গেছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিøউএফপি) জানায়, মানুষের মধ্যে ক্ষুধা, হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা এতটাই বেড়েছে যে, কিছু সাহায্যবাহী ট্রাক পথে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। তারা সতর্ক করেছে, যদি অবিলম্বে নিরাপদ ও টেকসই সহায়তাপ্রবাহ নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে সঙ্কট আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা-ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, ‘গাজায় যা চলছে তা একটি মানবিক বিপর্যয়। এখন যে পরিমাণ সহায়তা ঢুকছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ভুসির গাদায় সুচ খেঁাঁজার মতো।’ তিনি আরো বলেন, ‘সহায়তা ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না, কোনোটা রাস্তায় লুট হচ্ছে, আবার কোনোটা নিরাপত্তাহীনতার কারণে আটকে আছে।’

এ দিকে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘ইসরাইল গাজায় যে পরিমাণ মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে, তা ‘এক চা চামচের সমান’। তিনি অভিযোগ করেন, ‘ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ পৌঁছাতে বিলম্ব করছে।’ গত শুক্রবার নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের সাখে আলাপকালে গুতেরেস বলেন, গাজার পুরো জনসংখ্যা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। কেরেম শালোম ক্রসিং দিয়ে ৪০০ লরি প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলেও মাত্র ১১৫টি লরি থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা গেছে।

ক্ষুধার রাজ্যে পরিণত গাজা : দুই বছর বয়সী মেয়ার, হাসপাতালে একটি বেডে শুয়ে আছে। তার পাঁজরের হাড় বেরিয়ে এসেছে, পেট ফোলা। মেয়ের দুর্বল হাত ধরে শার্ট পরিয়ে দিচ্ছিলেন মা আসমা আল-আর্জা। বেডে শুয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। এই প্রথম নয়, আগেও অপুষ্টির কারণে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে গাজা উপত্যকার এই নিষ্পাপ শিশুটিকে। তবে এবারই টানা ১৭ দিন ধরে শিশুটি হাসপাতালে রয়েছে বলে জানান তার মা।

মেয়ারের সিলিয়াক ডিজিজ নামের একটি বিশেষ রোগ রয়েছে। এ কারণে গ্লুটেনজাত খাবার খেতে পারে না সে, তার জন্য বিশেষ খাবারের দরকার হয়; কিন্তু ১৯ মাসের যুদ্ধ আর ইসরাইলের কঠোর অবরোধের কারণে গাজায় এই খাবার এখন আর নেই। সাধারণ খাবারও সে হজম করতে পারে না। মেয়ারের মা বলেন, ‘ডায়াপারের পাশাপাশি ওর সয়ামিল্ক আর বিশেষ খাবারের দরকার; কিন্তু সীমান্ত বন্ধ থাকায় এগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও অনেক দাম, আমি কিনতে পারি না।’

জাতিসঙ্ঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গাজায় ৯ হাজারের বেশি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। আগামী বছর এই সংখ্যা আরো অনেক বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইসরাইল যদি সামরিক অভিযান বন্ধ না করে এবং গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর আরোপিত অবরোধ পুরোপুরি না তুলে নেয়, তাহলে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে বারবার সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে গাজায় অনেক মানুষ খাবার পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

৯৪% হাসপাতাল ধ্বংস : অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় অন্তত ৯৪ শতাংশ হাসপাতাল আংশিক বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, যার অর্ধেক বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে অচল। তুরস্কের আনাদোলু সংস্থা জাতিসঙ্ঘের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানায়। জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র ফারহান হক নিউ ইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সহিংসতা আরো তীব্র হওয়ায় গাজার ইতোমধ্যে দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন চূড়ান্ত ভাঙনের মুখে পড়েছে।’

তিনি জানান, গত এক সপ্তাহে গাজার চারটি প্রধান হাসপাতাল আক্রমণ বা জোরপূর্বক স্থানান্তরের নির্দেশনার কারণে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে হক জানান, ‘২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৭০০ হামলার মধ্যে মাত্র গত এক সপ্তাহেই ৪ শতাংশ ঘটেছে।’ তিনি বলেন, ‘মাত্র সাত দিনেই ২৮টি হামলা হয়েছে, যা প্রতিদিনের গড় হামলার তুলনায় চারগুণ বেশি।’

নিহত বেড়ে ৫৩,৯০১ : কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে গতকাল শনিবার জানিয়েছে, উপত্যকাটিতে ইসরাইলি হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৭৯ জন নিহত এবং আরো ২১১ জন আহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এই সংখ্যা উত্তর গাজায় অবস্থিত হাসপাতালগুলোর তথ্য ছাড়া করা হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে ৫৩ হাজার ৯০১ জনে পৌঁছেছে, আর আহতের সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজার ৫৯৩ জনে দাঁড়িয়েছে।

যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন নেতানিয়াহু : অন্য দিকে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক স্বার্থে গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর করা এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত শুক্রবার ইসরাইলে সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১২-তে সম্প্রচারিত একটি নতুন জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ইসরাইলি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধে জয়লাভ বা জিম্মিদের মুক্ত করার চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে বেশি আগ্রহী।

নেতানিয়াহুর প্রধান লক্ষ্য কী বলে মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ৫৫ শতাংশ ইসরাইলি বলেছেন ক্ষমতায় থাকা, ৩৬ শতাংশ বলেছেন বন্দীদের ফেরত নেয়া আর ৯ শতাংশ বলেছেন তারা নিশ্চিত নন। হামাসের কাছে আটক বাকি বন্দীদের ফেরত আনতে আরেকটি চুক্তি কেন হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা এটাকে রাজনৈতিক কারণ বলেছেন, ৩৮ শতাংশ বলেছেন যৌক্তিক কারণেই এটা হয়নি। আর ৯ শতাংশ বলেছেন কেন চুক্তি হলো না তারা বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত নন।

চলতি সপ্তাহে নেতানিয়াহু তার সংবাদ সম্মেলনে জনগণকে গাজা যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন কি না জানতে চাওয়া হলে, ৬২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন তিনি তা করতে পারেননি, ৩৪ শতাংশ বলেছেন নেতানিয়াহু বোঝাতে পেরেছেন। আর ৪ শতাংশ বলেছেন তারা নিশ্চিত নন।

ডাক্তারের ৯ সন্তান নিহত : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার খান ইউনুসের নাসের হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজার একজন ডাক্তার আলা আল-নাজ্জারের বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। এ ঘটনায় তার ১০ সন্তানের মধ্যে ৯ জনই নিহত হয়েছে। গতকাল শনিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলায় আল-নাজ্জারের স্বামী ও বেঁচে যাওয়া ১১ বছর বয়সী এক ছেলে গুরুতর আহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় সময় শুক্রবার খান ইউনুসে আল-নাজ্জার পরিবারের বাড়িতে ইসরাইলি বিমান হামলা চালানো হয়।

নিহত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টির বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ডাক্তার আল-নাজ্জারের স্বামী হামদি (যিনি নিজেও একজন চিকিৎসক) মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। তাদের ১১ বছর বয়সী ছেলেকে জরুরি অস্ত্রোপচার করেছেন ব্রিটিশ সার্জন গ্রেম গ্রুম। হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর মুনির আল-বুরশ শুক্রবার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। এতে দেখা যায়, ধ্বংসস্তূপ থেকে পুড়ে যাওয়া শিশুদের লাশ উদ্ধার করা হচ্ছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews