তীব্র দাবানলের মতো ছিল তার জীবনের গতিপথ। তবুও সময় পেলেই খুব সহজিয়া এক জীবন কাটাতেন তিনি। কুসুম কোমল হৃদয় নিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির মহীরূহ। আচার-আচরণে ছিলেন একদম মাটির মানুষ।
এ কে ফজলুল হককে যদি শেরে বাংলা বা বাংলার বাঘ বলা হয়, তাহলে বঙ্গবন্ধু নিঃসন্দেহে আমাদের সিংহপুরুষ। পুরুষোত্তম শেখ মুজিবুর রহমান। একটি দেশের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার পরেও তিনি চিরাচরিত লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে বাড়ির কর্মীদের সঙ্গে দুপুর খাবার খেতে পারতেন, আবার খুব সহজেই চুলটা একটু ব্যাকব্রাশ করেই যেতে পারতেন কোনো অগ্নগর্ভ সময় মোকাবিলায়। সহজিয়া বাঙালি তিনি, বাংলার কালপুরুষ। তার এই জীবনের চিত্রই ফুটে উঠেছে পুরুষোত্তম কবিতায়--
''চেক লুঙ্গি, সফেদ পাঞ্জাবি— আর ব্যাকব্রাশ করা কেশ
কালো পাইপ থেকে সাদা মেঘে ওড়ে এরিনমোরের রেশ''
বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গভীরতায় ডুবে গিয়েছিল এই বাংলার মানুষ। তাই তিনি যখন তর্জনী তুলে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়লো আপামর জনতা। কারণ বাংলার মানুষ বিশ্বাস করতো তাকে। তিনি বাংলাদেশের প্রতিধ্বনিতে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ, তার অর্ধ শতাব্দী আগে এই বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তার, তখন কে ভেবেছিল- এই শিশুর হাত ধরেই হাজার বছরের দাসত্ব ঘোচাবে বাঙালি?
ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানটি কেমন ছিল? জানতে ইচ্ছে করে। নদীবিধৌত একটি গ্রাম সেটি। আড়িয়াল খার একটি শাখা ভাঙ্গা-টেকের হাট ও রাজৈর হয়ে বাইগ্যার বিলের মধ্যে পতিত হয়েছে। পশ্চিমে মধুমতি আর পূর্বে ঘাঘোর নদী। মাঝ বরাবর জলাভূমি। টঙ্গ থেকে টুঙ্গি। জনবসতি গড়ে ওঠার পর হয় টুঙ্গিপাড়া। ঢাকা শহর থেকে মাত্র ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্গত টুঙ্গিপাড়া গ্রামটি। এই গাঁয়েরই এক বনেদি পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারে জন্মেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন পিতা মাতার তৃতীয় সন্তান।
জন্মের পর তার নানা শেখ আবদুল মজিদ তার নাম রাখেন 'মুজিব' অর্থাৎ সঠিক উত্তরদাতা। মা-বাবা তাকে ডাকতেন 'খোকা’ বলে। পরবর্তীতে অনেকে তাকে ডেকেছেন মুজিব ভাই বলে। আরো পরে তিনি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা। এই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপুরুষ তিনি। তিনিই পুরুষোত্তম।
জন্ম ও বংশ-পরিচয়
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার ঘাঘোর ও মধুমতি বিধৌত টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এক বনেদি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জের আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেন। মাতার নাম সায়েরা খাতুন। শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব-পুরুষরা ছিলেন ইরাক থেকে আগত দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর। বাগদাদের হাসানপুর নামক স্থানে শেখ আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'র শুরুতে শেখ বোরহান উদ্দিনের কথা বলেছেন। শেখ বোরহান উদ্দিনের ছিল তিন পুত্র সন্তান। তারা হলেন- শেখ একরাম উল্লা, শেখ তাজ মোহাম্মদ ও শেখ কুদরত উল্লা। শেখ একরামের দুই ছেলে-শেখ জাকির ও শেখ ওয়াসিম উদ্দিন। বঙ্গবন্ধুর দাদার নাম শেখ আব্দুল হামিদ। তিনি ছিলেন শেখ জাকিরের সন্তান এবং দরবেশ শেখ আউয়ালের কয়েক জন্মের উত্তরাধিকারী। শেখ জাকিরের তিন ছেলে-শেখ আব্দুল মজিদ, শেখ আব্দুল রশিদ ও শেখ আব্দুল হামিদ। শেখ আবদুল হামিদের তিন ছেলে- শেখ লুৎফর রহমান, শেখ শফিউর রহমান ও শেখ হাবিবুর রহমান। আর এই শেখ লুৎফর রহমানের ছেলেই হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ বোরহান উদ্দিনের পিতা ছিলেন তেকড়ী শেখ। তিনি সোনারগাঁও-এ অনেক কাল বসবাস করেন। তেকড়ী শেখের পিতা ছিলেন শেখ জহির উদ্দিন। তিনি তার পিতার আদর্শকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সংযোগ
শেখ জহির উদ্দিনের পিতা ছিলেন শেখ আউয়াল। যিনি এলাকায় দরবেশ আউয়াল নামে সুপরিচিত ছিলেন। তাকে বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) স্নেহ করতেন। বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) সম্ভবত ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। তখন মুসলমানরা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের দখলে তখন অনেক এলাকা। এই বঙ্গ চিরকালই সুজলা-সুফলা। ইরাকের এই ইসলাম প্রচারক বঙ্গের প্রকৃতি, স্থানীয় জনপদ ও মানুষজনের সহজ-সরল আচরণের কথা শুনে খাইবার গিরিপথ হয়ে প্রথমে দিল্লি, পরে এই বঙ্গে আগমন করেন। অনেকের ধারণা, তিনি জাহাজে চড়ে এসেছিলেন বলে চট্টগ্রামে আস্তানা গেড়েছিলেন। বায়েজিদ বোস্তামি ছিলেন সুফি সাধক। মানুষকে তিনি ধর্মের শান্তি ও কল্যাণের কথা শোনাতেন। মানুষ তার কথা শুনতো মুগ্ধচিত্তে। এই বঙ্গে তিনি একা আসেননি। তার ছিল বেশ কজন সঙ্গী-সাথী। তারাও ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তাদের মধ্যে শেখ আউয়াল দরবেশও ছিলেন। বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) একদিন শেখ আউয়ালকে নির্দেশ দিয়েছিলেন-মেঘনা পাড়ের এলাকায় যাওয়ার। শেখ আউয়াল গুরুর আদেশ মেনে চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও-এ। তার পুত্রের নাম জহির উদ্দিন এবং নাতির নাম তেকড়ী শেখ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
দাদা ও বাবার পর, সোনারগাঁও-এ তেকড়ী শেখ অনেককাল বসবাস করলেও, একসময় ব্যবসার উদ্দেশ্যে খুলনায় পাড়ি জমান। দাদার আস্তানাটির দায়িত্ব দিয়ে যান বিশ্বস্ত লোকদের। তেকড়ী শেখের উত্তরাধিকারী–পুত্র শেখ বোরহান উদ্দিন মধুমতি ও ঘাঘোর নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামটির কথা শোনের তার বন্ধুর কাছে। রূপসা নদী পাড়ি দিয়ে একদিন তিনি বন্ধুর সাথে চলে আসেন টুঙ্গিপাড়ায়। বিয়ে করেন কাজী পরিবারে, ঘর বাধেন। এভাবেই টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন ঘটে।
উল্লেখ্য, শেখ আবদুল মজিদের বংশধর বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন এবং শেখ ওয়াসিম উদ্দীনের বংশধর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা। শেখ ফজিলাতুননেছার পিতার নাম মো. জহুরুল হক (দুদু মিয়া) ও দাদার নাম শেখ মো. আবুল কাশেম। সবাই শেখ শেখ বোরহান উদ্দিনের বংশধর।
বংশের পূর্বাপর
শেখ মুজিবুর রহমানের বংশ বিস্তার লাভ করে দরবেশ শেখ আউয়ালের মাধ্যমে। তিনি তার গুরু বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) আদেশ মেনে মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁওয়ে-এ বসবাস শুরু করেন। তৎকালীন শাসনকর্তাদের কোঠাবাড়ি ছিল এখানে। বড় বড় পালতোলা নৌকা আসে এখানটায়। মেঘনা আর সবুজ-শ্যামলিমায় আচ্ছাদিত সোনারগাঁওয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন কাড়ে দরবেশ শেখ আউয়ালের। এক সময় তার সুনামও ছড়িয়ে যায় চারদিকে। তিনি মানুষকে সত্যপথে চলার উপদেশ দেন, ধর্মের বাণী শোনার। অনেকেই তার অনুসারী হন। বিয়ে করেন স্থানীয় এক বাঙালি কন্যাকে। একদিন তার ঘর উজ্জ্বল করে পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হল। আদরের এ সন্তানের নাম রাখলেন শেখ জহির উদ্দিন।
শেখ জহির উদ্দিন বড় হচ্ছেন। বাবার নির্দেশ মতো লেখাপড়া করছেন। বাবার আস্তানায় হাজারো মানুষের আনাগোনা। বাবাকে শ্রদ্ধা করেন। শেখ জহির উদ্দিনের এসব ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালো লাগা বেশিদিন টেকেনি। কথা নেই, বার্তা নেই, নেই কোনো আয়োজন। একান্ত আপনজনদের জানিয়ে দরবেশ শেখ আউয়াল একদিন পাড়ি জমালেন মক্কায়- উদ্দেশ্য হজব্রত পালন। দেখতে দেখতে হজ মৌসুম শেষ হলো। বছরের পর বছর গেলো কিন্তু দরবেশ শেখ আউয়াল আর ফিরে আসেননি।

ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু। ছবি: সংগৃহীত
এদিকে, সুফি মতবাদে বিশ্বাসী এবং উদার হৃদয় আর মুক্তবুদ্ধির শেখ বোরহান উদ্দিন মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করলেন এদেশের ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও লোকাচারকে। স্থানীয় গণমানুষের সঙ্গে সৃষ্টি করলেন একাত্মবোধ। শেখ মুজিবুর রহমান হলেন সুফি দরবেশ শেখ আউয়ালের সপ্তম এবং শেখ বোরহান উদ্দিনের চতুর্থ বংশধর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'শেখ মুজিব আমার পিতা' নিবন্ধে বলেছেন, 'আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন। যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালের যে দুটো দালান বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে-দুটোই জ্বালিয়ে দেয়। এই দালান কোঠায় বসবাস শুরু হবার পর ধীরে ধীরে বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই দালানেই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমান এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন।'
ইত্তেফাক/এএএম