যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করার পর থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই ভারত নিয়ে মুখ খুলছেন।
তিনি নিয়মিত ভারত ও পাকিস্তান নিয়ে, ভারতের বাণিজ্য শুল্ক কম করা নিয়ে, অ্যাপলকে ভারতে আইফোন না বানানোর পরামর্শ দিয়ে যা বলছেন, তাতে কি নরেন্দ্র মোদি সরকার বিপাকে পড়ছে? প্রতিদিনই বিরোধীরা ট্রাম্পের বক্তব্য নিয়ে সরকারকে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
ট্রাম্প যা বলেছেন
ভারত ও পাকিস্তান যে সংঘাত থামিয়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে, সেই ঘোষণাটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বা দুই দেশের প্রতিরক্ষা বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা সেনার তরফ থেকে আসেনি।
নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এই ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপর থেকে নিয়মিত এই যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব ট্রাম্প নিজেকে দিচ্ছেন এবং একাধিক মন্তব্য করেছেন।
ট্রাম্প প্রথমে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া এক রাতের আলোচনার পর আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত ও পাকিস্তান অবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বাস্তববোধ ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েছে বলে দুই দেশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
ট্রাম্পের এই বার্তার পর ভারত, পাকিস্তান এবং গোটা বিশ্ব জানতে পারে, যুদ্ধবিরতি হয়েছে। তার পরের দিনই যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘আমি খুবই গর্বিত যে যুক্তরাষ্ট্র এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পেরেছে। আমি দুই দেশের সঙ্গেই কাজ করব। দেখতে চাই, হাজার বছর পরে কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান হয় কিনা।’
কাশ্মীর সমস্যা হাজার বছর ধরে চলছে, এমন তথ্য ট্রাম্প কোথা থেকে পেয়েছেন, তা জানাননি। তবে এরপর ট্রাম্প জানান, বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে তিনি দুই দেশকে সংঘাত থামাতে বাধ্য করেন।
এরপরেও ট্রাম্প থামেননি। তিনি বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা ভয়াবহ হচ্ছিল। রোজ নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দেখা যাচ্ছিল। আমরা তা মিটিয়েছি। আমরা বলছি, এস বাণিজ্য করা যাক।’
তারপর বৃহস্পতিবার ট্রাম্প দাবি করেছেন, প্রায় সব পণ্যে শুল্ক কমাতে ভারত রাজি হয়েছে। তারপর তিনি বলেছেন, অ্যাপল ভারতে যে আইফোন তৈরির কারখানা করছে, সে ব্যাপারে তার আপত্তি আছে। ভারত চড়া হারে শুল্ক বসায়। ফলে ব্যবসা করতে অসুবিধা হবে।
কংগ্রেস ও বিরোধীদের দাবি
লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে দাবি করেছেন, সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হোক। সেখানে পেহেলগাম, অপারেশন সিঁদুর এবং যুদ্ধবিরতি যা প্রথমে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তা নিয়ে আলোচনা হবে। সব বিরোধী দল এটাই চাইছে।
সব বিরোধী দল পেহেলগামের পর সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল, অপারেশন সিঁদুর সমর্থন করেছিল। যুদ্ধবিরতির পর তারা এবার প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
রাজ্যসভার নেতা এবং কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেও একই দাবি করেছেন। গত ১৪ মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত যে প্রত্যাঘাত করছিল, তা হঠাৎ থামিয়ে দেওয়ায় আমরা বিস্মিত। এটা স্পষ্ট হচ্ছে না। ফলে গুজব ছড়াচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সবচেয়ে আগে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, তিনিই দুই দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপন করেছেন। তিনি বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে ভারতকে চাপ দিয়েছিলেন। ভারত সরকার পুরো চুপ করে আছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। অতীতে ভারতের সব সরকার দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে, কাশ্মীর হলো ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা। তৃতীয় কোনো দেশের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। ট্রাম্পের দাবি ভারত খণ্ডন করেনি। আমরা মনে করি, আমাদের জাতীয় অবস্থান ও সম্মানের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়েছে।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল শুল্ক-বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে ওয়াশিংটন গেছেন। ট্রাম্প দোহা থেকে দাবি করছেন। সরকার চুপ করে আছে।
বিপাকে ফেলে দিয়েছেন ট্রাম্প?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ট্রাম্প এই মন্তব্য করে ভারতকে ধরাশায়ী করে দিয়েছেন। ভারত আঞ্চলিক প্লেয়ার থেকে আন্তর্জাতিক প্লেয়ার হতে চাইছিল, জি২০তে গুরুত্ব পাচ্ছিল, বিশ্বগুরু নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেই ভারতকে বিশাল ধাক্কা দিয়েছেন ট্রাম্প।
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ইন্দিরা গান্ধীকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, ১৯৭১-এ যুদ্ধ বন্ধ করতে। ইন্দিরা শোনেননি। আমেরিকা সেভেন ফ্লিট পাঠায়। তাও ইন্দিরা পিছু হটেননি। আর এবার বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের হুমকিতেই যুদ্ধবিরতি হয়ে গেলো!
বিশ্বনাথ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভূরাজনৈতিক কারণে ভারতকে প্রধান পার্টনার করেছিল। ভারতকে সঙ্গে নিয়ে কোয়াড তৈরি হয়। ট্রাম্প পুরো বদলে দিলেন। তিনি পুরনো বন্ধু হিসাবে পাকিস্তানকে রিভাইভ করলেন। ক্লিন্টনের সময় থেকে ভারত যে প্রাধান্য পাচ্ছিল, সেখান থেকে সরে এলেন ট্রাম্প। আজ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদি অ্যাপলকে ভারতে বিনিয়োগ করতে মানা করেন, তারপরে তারা কি তাকে অমান্য করে এই বিনিয়োগ করতে পারে?