৯ আগস্ট তারিখ প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী International Day of the World’s Indigenous Peoples পালিত। বাংলাদেশেও প্রতিবছর এ দিন ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়, তবে সরকারিভাবে নয়। কেননা বাংলাদেশে এখনও আইনি কাঠামোয় “আদিবাসী” বলে কেউ নাই! কিন্তু বিশ্বব্যাপী পৃথিবীর প্রায় নব্বইটি দেশে প্রায় ৪০০ মিলিয়নের অধিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী এ দিবসকে উপলক্ষ করে নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি তাদের নানান দাবি-দাওয়া ও নির্যাতন-বঞ্চনার আলেখ্য তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামনে এবং বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। ফলে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস কেবল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ‘প্রদর্শনে’র একটি নিরীহ দিন নয়; বরং বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে নিজেদের বহুমাত্রিক বঞ্চনা, নানাবিধ নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় শোষণ এবং নিপীড়নের আলেখ্য তারা নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামনে এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে উপস্থাপন করার একটি বিশেষ দিন।
তাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস কেবল উৎসবের নয়, আদিবাসী একটিভিজমেরও একটি অন্যতম প্ল্যাটফর্ম।
প্রতিবছর বিশ্ব আদিবাসী দিবসে জাতিসংঘ একটি থিম নির্ধারণ করেন এবং তাকে কেন্দ্র করেই বিশ্বব্যাপী আদিবাসী দিবসের অনুষ্ঠানমালা, বক্তৃতামালা এবং দাবি-দাওয়ার কনটেন্ট নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২৫ এর থিম “Indigenous Peoples and AI: Defending Rights, Shaping Futures” যার বাংলা করা হয়েছে “আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বার্থক প্রয়োগ”।
প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি এবং অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বার্থক প্রয়োগের মাধ্যেম আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নির্মাণের এ চমৎকার থিমকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটা কতটা কার্যকর এবং বাস্তবসম্মত সেটা ক্রিটিক্যাল আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ তো দূরের কথা বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য এখনও ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করা সম্ভব হয়নি। এ সে কারণেই, দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ৪ মিলিয়নের কাছাকাছি আদিবাসী জনগোষ্ঠী শিক্ষা-দীক্ষায়, সংস্কৃতির বিকাশে, সামাজিক অগ্রগতিতে ও অর্থনৈতিকভাবে এতটা প্রান্তিক অবস্থানে বসবাস করছে যে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোক ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ কি জিনিস সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও রাখেন না। এ কারণেই যখন জাতিসংঘ ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের বিকাশের সম্ভাবনাকে ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য থিম নির্ধারণ করছে, তখন বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ এ থিমের অর্থ বোঝার সক্ষমতা ও অর্জন করতে পারে নাই।
তাছাড়া, এ থিমের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে একটা বিষয় প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী যখন সময়ের সাথে হাত মিলিয়ে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ও প্রযুক্তির বিকাশের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তখন বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কতটা পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বর্তমান কাটে নিত্য বঞ্চনার ভিতর দিয়ে, এবং প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠো অন্য সংস্থানের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সেখানে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’র ব্যবহার করে ভবিষ্যৎ নির্মাণের চিন্তা বাংলাদেশের আদিবাসী জন্য এখনো খানিকটা কল্পনার জগতের আলাদিনের চারাগির মতো দেখায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? সহজ উত্তর হচ্ছে এদেশের জন্ম থেকে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় যেভাবে এক রৈখিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র গঠন ও জাতি নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যা অদ্যাবধি বিদ্যমান এবং চলমান, এর মধ্য দিয়ে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষগুলো রাষ্ট্রের কাঠামোতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিকভাবে ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়ে।
ফলে, সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের বিকাশের সাথে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো তাল মিলাতে না পেরে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক হয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যা আমি অন্যত্র লিখেছিলাম, “দীর্ঘ আলোচনা, দীর্ঘ বিতর্ক এবং প্রায় দুই দশকের নানান কার্যক্রমের বিচার বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক সনদ তৈরি করা হয়েছে ২০০৭ সালে, যা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হয়। ১৯৮২ সালে জাতিসংঘে প্রথম ‘আদিবাসী’ বিষয়ক আলোচনা শুরু হয়। পাশাপাশি এর অস্তিত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করা হয়। প্রায় একদশক পরে দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবছর ৯ আগস্টকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ হিসাবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয় (রেজ্যুলেশন ৪৯/২১৪)। ৯ আগস্টকে তারিখ হিসাবে নির্ধারণ করার পেছনে প্রধান কারণ ছিল ১৯৮২ সালের এইদিনেই জাতিসংঘ সর্বপ্রথম ‘আদিবাসীদের’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়।
এরপরের বছর থেকে ১৯৯৫-২০০৪ ‘প্রথম আদিবাসী দশক’ এবং ২০০৫-২০১৪ ‘দ্বিতীয় আদিবাসী দশক’ ঘোষণা করা হয়। ‘প্রথম আদিবাসী দিবসে’র লক্ষ্য ছিল ‘আদিবাসীদের’ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, ভূমি, পরিবেশ, উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা দূরীকরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শক্তিশালী করণ। ‘দ্বিতীয় আদিবাসী দিবসে’র লক্ষ্য ছিল ‘আদিবাসী’দের জীবনের নানান রিসোর্সের কার্যকর প্রয়োগ ও সম্মানের জায়গা নিশ্চিতকরণের জন্য অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘আদিবাসী অধিকার সনদ’ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হয়। যেখানে চারটি দেশ (আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড) এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং ১১টি দেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি হচ্ছে, বাংলাদেশ সেই ১১টি দেশের মধ্যে একটি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের এ ঘোষণায় অনুস্বাক্ষর করেনি এবং এ ঘোষণাকে অনুসমর্থনও করেনি। অধিকন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, উপজাতি ও সম্প্রদায়’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে, বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠী এখনও সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ‘আদিবাসী’ হিসেবে তাদের জাতিগত স্বীকৃতি পায়নি।” ফলে যখন বিশ্বব্যাপী আজকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার স্বার্থক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা বলছি, তখন বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রান্তিকায়ন আরও গভীরভাবে স্পষ্ট হচ্ছে। এ গভীর প্রান্তিকায়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রাথমিক কাজ হবে, এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি।
তাছাড়াও, বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির সাথে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত ও সংযুক্ত করতে হলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অগ্রগণ্য যারা আছেন, তাদেরকে যেমন দায়িত্ব নিতে হবে, পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টিও সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে যাতে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলো তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।