রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। ইউক্রেনে ব্যাপক পরিসরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত রাশিয়া—জাতিসংঘের তদন্ত দলের এমন অভিযোগের ঠিক এক দিন বাদেই এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি জানিয়ে আইসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলো থেকে শিশুদের বেআইনিভাবে রাশিয়ায় সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে পুতিন জড়িত রয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতেই মূলত গ্রেফতারি পরোয়ানা। পুতিন ছাড়াও রুশ প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিশনার মারিয়া আলেক্সিয়েভনা এলভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আইসিসি। তার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়েছে। আইসিসির এই গ্রেফতারি পরোয়ানাকে অবশ্য আমলে নিতে চাইছে না রাশিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভাকে বলতে শোনা গেছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এই সিদ্ধান্তের কোনো অর্থ আমাদের কাছে নেই। আইনগত দিক দিয়েও এর কোনো অর্থ নেই।’ এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম চুক্তির অংশ নয় রাশিয়া। আর এর অধীনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই।’
উল্লেখ করার বিষয়, পুতিনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কথাবার্তা চলে আসছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে রাশিয়া প্রথম বারের মতো নিজের ভূখণ্ড দাবি করে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের দাবি ওঠে। এর প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সার্বভৌম ইউক্রেনে পুতিন বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ চালালে জোরালো আকার ধারণ করে যুদ্ধাপরাধের তদন্তের দাবি। শেষ পর্যন্ত আইসিসির তরফ থেকে প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা এলো। তবে এক্ষেত্রে গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়টি রাশিয়া যেহেতু স্বভাবতই সহজে মেনে নেয়নি বা নেবে না, সেক্ষেত্রে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা একটু ‘জটিল’ বইকি! তবে এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান। তার মতে, ‘রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত পুতিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে কয়েদ করাটা মুশকিল। তাকে গরাদের ভেতর দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’ যা হোক, এই প্রবন্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে পুতিনের বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানার পটভূমিতে ‘যুদ্ধাপরাধের’ খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোকপাত করা।
গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, আগ্রাসন চালানোর অপরাধ প্রভৃতির বিষয়ে সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। আইসিসির প্রকাশিত গাইডলাইনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। বিশেষ করে বেসামরিক জনসংখ্যাকে টার্গেট করা, জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করা, নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর লোকদের টার্গেট করা এবং আরো বেশ কিছু বিষয়ে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বিষয়ে বক্তব্য লিপিবদ্ধ আছে আইসিসি গাইডবুকে।
রোম চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সৃষ্টি করা হয়। এই আদালত অবস্থিত নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে। আইসিসির বর্তমান সদস্য দেশ ১২৩। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ এই আদালতের অন্তর্ভুক্ত। তবে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয়। সদস্য নয় যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনও।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও বিচারে অভিযুক্ত যে কোনো অপরাধীর বিচার করতে পারে আইসিসি, যার মধ্যে আইসিসির সদস্য দেশগুলোও অন্তর্ভুক্ত। এই আদালত বিশেষ করে ব্যক্তির বিচার করে থাকে, দেশ নয়। কোনো একটি অপরাধের ক্ষেত্রে যেসব নেতা বা কর্মকর্তা সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধ থাকেন, তাদের বিচার নিশ্চিতে বেশি জোর দেয় আইসিসি। আরেকটি বিষয়, অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে বিচার পরিচালনা করে না আইসিসি। অর্থাৎ, অভিযুক্ত পুতিনের বিচার নিশ্চিত করতে চাইলে তাকে আইসিসির যে কোনোভাবে গ্রেফতার করতে হবে আগে। এদিক থেকে দেখলে পুতিন যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন আইসিসির বিচারকাজ সম্পন্ন করা অনেকটা অসম্ভব বলেই ধরে নেওয়া যায়।
আইসিসি ১৮ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত, যাদের কাজের মেয়াদ ৯ বছর। বিচারকেরা চার ধরনের অপরাধের বিচার করে থাকেন। এগুলো হলো—গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, অযাচিত আগ্রাসন চালানোর অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ। লক্ষণীয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সব অভিযোগই দাঁড় করানো যায়। অর্থাৎ পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা বেশ ভারীই!
সাধারণত আইসিসির তদন্ত বেশ ধীরগতির। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের কথা মাথায় রেখে বিচার কার্যক্রম চলে ধীরে ধীরে। এ কারণে তদন্তে লেগে যায় বছরের পর বছর। যেমন—ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রথম আগ্রাসন চালানোর প্রাথমিক তদন্ত ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছিল—এপ্রিল ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত। কিন্তু পরবর্তীকালে কোভিড-১৯ মহামারি ও আদালতে সংস্থানের অভাবের মতো আরো কিছু কারণে তা ঝিমিয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, আইসিসির এই ধীরগতি সম্পন্ন, অকার্যকর বিচার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠতে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক আইন ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর খান বলেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আইসিসির এই ধীরগতি দুঃখজনক। তবে ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটা আদালতের জন্য একটা পরীক্ষা। আমার জন্যও এটা বড় পরীক্ষা। পরীক্ষা অফিসের জন্যও।’
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ও অনলাইন ফোরাম ‘জাস্ট সিকিউরিটি’র সহসম্পাদক-ইন-চিফ রায়ান গুডম্যান মনে করেন, যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহল অনেকটা এককাট্টা। প্রতিবাদ বেশ ব্যাপক এবং তা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে প্রবল। ফলে এক্ষেত্রে আদালত ভিন্ন ধারায় কাজ করার ক্ষমতা লাভ করতে পারে। ২০২২ সালে আদালত প্রাথমিকভাবে তদন্ত শুরু করার পর গুডম্যান বলেছিলেন, ‘আইসিরি প্রচলিত ধারার ভিত্তিতে রাশিয়ার বিচার করা কঠিন হবে।’ সুতরাং, আইসিসির আইনে কোনো পরিবর্তন এলেও আসতে পারে।
প্রসিকিউটর খান মনে করেন, এক্ষেত্রে একটি জাতীয় সরকার বা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে অধিকতর তদন্তের জন্য মামলা হস্তান্তর করতে পারে আইসিসি। সেক্ষেত্রেও অবশ্য জটিলতা আছে এক জায়গায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় কাউন্সিলের কর্মকাণ্ডের ওপর রাশিয়ার ‘ভেটো ক্ষমতা’ রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ইউরোপের ৩৯টির মতো জাতীয় সরকারের আহ্বানে এই তদন্তের সূত্রপাত ঘটে। অর্থাৎ, পুতিন খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি। শুধু ইউক্রেনীয় পক্ষ নয়, রাশিয়ান ফেডারেশন, রাষ্ট্রীয় দল এমনকি অরাষ্ট্রীয় দলগুলোর সঙ্গেও কথা বলতে চাই আমি। আমি বিশ্বাস করি, আইসিসি কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়।’
আইসিসির মামলা বা তদন্ত কূটনৈতিক অঙ্গনকে প্রভাবিত করতে পারে বা করে। অভিযুক্ত ব্যক্তির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে যায় বহুগুণে। যেমনটি বলেছেন গুডম্যান—পুতিন কিংবা অভিযুক্ত অন্য ব্যক্তিবর্গ দেশের বাইরে ভ্রমণ করলে গ্রেফতারের ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন বিধায় তারা তা করতে চাইবেন না। এক্ষেত্রে অভিযুক্তরা নিজ দেশেই দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। গুডম্যান যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘রাশিয়ানরা এমন ধারণাও করে বসতে পারেন, পুতিন আর আগের মতো দেশের সেবা করতে পারবেন না!’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়েই আইসিসি গঠনের রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। এর অর্থ, এ দুই দেশের নেতারা এতে স্বাক্ষর করেছেন। তবে দেশ দুটির কেউই আইসিসির সদস্য নয়। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের বিষয়ে আইসিসির একটি রায়কে ‘জঘন্য’ হিসেবে অভিহিত করে আইসিসি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় রাশিয়া। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ২০০০ সালে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তার সময়ে কিংবা পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের আমলে বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে উদ্যোগ আর গড়ায়নি সামনের দিকে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে আইসিসির তদন্ত ও বিচারকে স্বাগত জানিয়ে আসছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আইসিসির মামলা যুদ্ধবাজ পুতিনের বিরুদ্ধে খুব শক্তিশালী পয়েন্ট তৈরি করেছে। আমি মনে করি, আইসিসি ন্যায়সংগত ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’ হোয়াইট হাউস সম্প্রতি একটি বিবৃতি জারি করেছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের জবাবদিহির আওতায় আনতে আইসিসির প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানানো হয়।
যা হোক, ইউক্রেনের মাটিতে যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে বড় পরিসরে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে, ঠিক সেই সময়ে পুতিনের বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেফতারি পরোয়ানার কথা শোনা গেল। এই যখন অবস্থা, তখন পুতিনকে গ্রেফতার কিংবা শাস্তি নিশ্চিতে আইসিসি বাস্তবে কতটা সফলতা দেখাতে পারে, তা-ই দেখার বিষয়।
লেখক : রাজনীতিবিষয়ক লেখক
সিএনএন থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন