পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে খরচ বেশি। অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) কিনে পরিশোধন করলে খরচ কমে। খরচের হিসাবটা সব পক্ষের জানা থাকলেও দেশে তেল পরিশোধনের সক্ষমতা নেই। চাহিদার এক-তৃতীংয়াংশ জ্বালানি তেল দেশে পরিশোধন করা যায়। কারণ একমাত্র পরিশোধন কারখানা ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) সক্ষমতা বছরে মাত্র ১৫ লাখ টন। যেখানে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টন। সংশ্নিষ্টদের তথ্যমতে, চাহিদার পুরো ডিজেল যদি দেশে পরিশোধন করা যেত, তাহলে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো।

দেশের পরিশোধন সক্ষমতা বাড়াতে এক যুগেরও বেশি আগে ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এতে পরিশোধন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াত ৪৫ লাখ টন। তবে এখনও ঠিকাদার নিয়োগই চূড়ান্ত হয়নি। শুধু প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন, ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা আর খরচ বাড়ানোর মধ্যেই কার্যক্রম আটকে আছে।

খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জ্বালানি তেল আমদানি খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমানো যেত। বছরে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো, যা এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ধরে রাখতে বড় ভূমিকা রাখত। তাঁদের মতে, তেল পরিশোধনের চেয়ে আমদানিতেই ঝোঁক বেশি বিপিসির। এতে রাষ্ট্রের টাকা গচ্চা গেলেও এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর পকেট ভারী হয়। এজন্য ইচ্ছা করেই এ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

১২ বছরেও শুরু হয়নি নির্মাণকাজ, বাড়ছে খরচ: ২০০২ সালে জাপানের নিচিম্যান করপোরেশন এবং ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল ইআরএলের আধুনিকায়নের জন্য একটি সমীক্ষা চালায়। পরে ২০০৮ সালে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আরেকটি সমীক্ষা চালায়। ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহী হলেও পরে সরে যায়। ২০১০ সালে বিপিসি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়। ২০১৪ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় দরপত্র ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ইআরএলের মূল নির্মাতা ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপের সঙ্গে দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে সমঝোতা স্মারক সই হয়। সে বছরের ডিসেম্বরে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয় কোম্পানিটি। খসড়া ডিপিপিতে ইআরএল-২ নির্মাণের খরচ ধরা হয় ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। টেকনিপ প্রাথমিকভাবে ৬০ কোটি ডলার (প্রায় ৪ হাজার ৭১০ কোটি টাকা) বাংলাদেশকে ঋণ হিসেবে দিতে সম্মত হয়। বাকি টাকা ঋণ হিসেবে সংগ্রহ করে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। তবে ২০১৬ সালের মার্চে আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব থেকে সরে গিয়ে টেকনিপ শুধু ঠিকাদার (প্রকৌশল, প্রকিউরমেন্ট ও নির্মাণ) হিসেবে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ওই বছরের এপ্রিলে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডকে (ইআইএল) পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০১৬ সালের নভেম্বরে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বিপিসি। এ পর্যন্ত ১১ দফা ডিপিপি সংশোধন হয়েছে। প্রকল্পটির প্রস্তাবিত খরচ ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকায় ঠেকেছে। গত মে মাসে প্রকল্পটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে টেকনিপ। ফলে এক যুগ ঝুলে থাকা প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

যে কারণে ঝুলেছে: প্রকল্পের ধীরগতির নেপথ্যে সমকাল পেয়েছে তিনটি কারণ- দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বেসরকারি খাতের রিফাইনারি মালিকদের স্বার্থরক্ষা।

সূত্র জানিয়েছে, সময়মতো বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল আমদানি করে- বেসরকারি খাতের এমন কিছু কোম্পানি জড়িত। বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম পণ্য ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী একটি কোম্পানির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে সূত্র জানিয়েছে। কারণ, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বারবার তাগদা দেওয়ার পরও বিপিসি ও ইআরএলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরে চলো নীতি নেয়। ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এক ভার্চুয়াল সভায় ইআরএলের দ্বিতীয় প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। প্রকল্প পরিচালকদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতায় প্রকল্প খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। এর পরই ইআরএলের ব্যবস্থাপনায় বদল আসে।

সূত্রগুলো জানায়, নিজেদের প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বেসরকারি রিফাইনারির ব্যবসায় সহযোগিতার দিকে ঝোঁক বেশি। কারণ, ইআরএলের সক্ষমতা বাড়লে বেসরকারি রিফাইনারিগুলোর ব্যবসায় প্রতিযোগিতা বাড়বে। বেসরকারি পেট্রোলিয়াম ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার করছে- এমন একটি বড় কোম্পানির কারণে প্রকল্পটি বেশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে সূত্রের দাবি। পাশাপাশি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের মধ্যে যারা নিজেরা জ্বালানি তেল আমদানি করে, তাদেরও অনেকে চাইছে না ইআরএলের সক্ষমতা বাড়ূক। কারণ, তেল আমদানির বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সরকার ব্যারেলপ্রতি ৯ শতাংশ প্রণোদনা দেয়।

যদিও বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলছেন অন্য কথা। এত দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি জানান, দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনে প্রথমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জমি ও অর্থের সংকট। প্রয়োজন ছিল ১২৫ একর জমি; কিন্তু ইআরএলের ছিল মাত্র ৬৪ একর। পরে অবশ্য জমির ব্যবস্থা হয়েছে।

জানতে চাইলে ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান সমকালকে বলেন, টেকনিপের ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এসেছে। শুনেছি পরিচালনায় যাঁরা নতুন এসেছেন, তাঁরা ইআরএল প্রকল্পে আগ্রহী নন। তাই সরে গেছেন। এখন প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন সহযোগী খোঁজা হচ্ছে। ডিপিপি পাস হলে আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হবে।

কুয়েতের সহযোগিতা চাইছে: প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার এখন কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (কেপিসি) সহযোগিতা চেয়েছে। গত ২৬ জুন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উপসচিব লাইলাতুন ফেরদৌস স্বাক্ষরিত এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি বাংলাদেশে নিযুক্ত কুয়েতের রাষ্ট্রদূতকে পাঠানো হয়। চিঠিতে তেল পরিশোধনাগার নির্মাণে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কেপিসির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা ও চিঠি চালাচালির তথ্য তুলে ধরা হয়।

অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ: প্রকল্পটি সময়মতো বাস্তবায়িত হলে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির পরিমাণ কমত। এতে বছরে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। চাহিদার অতিরিক্ত পরিশোধিত তেল নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে রপ্তানি করা যেত। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপে রপ্তানি কমে যাওয়ায় রাশিয়া এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ক্রুড অয়েল কম দামে বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছে। ভারত ও চীন এ সুযোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার প্রস্তাব পেলেও তাতে রাজি হতে পারেনি। কারণ, ইআরএলে হালকা ক্রুড অয়েল পরিশোধন করা যায়। রাশিয়ার ক্রুড অয়েল ভারী, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তা পরিশোধন করা যায় না। ইআরএল-২ প্রকল্পে সেই সক্ষমতা রাখা হয়েছে। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো বাংলাদেশ। এ ছাড়া প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতায় পরামর্শক খাতে খরচ বাড়ছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়ার তিন বছর মেয়াদি চুক্তির মেয়াদ আরও চার বছর বাড়ানো হয়। পরামর্শকের পেছনে ১১০ কোটি টাকা খরচ বেড়ে ২৫৬ কোটি টাকা হয়েছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews