বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারক মো: নিজামুল হক (নাসিম) ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তার মেয়াদকাল ছিল নানা বিতর্ক ও অসদাচরণের অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ট্রাইব্যুনাল বিভিন্ন অনিয়মের জন্য সমালোচিত হয়, যেগুলোর মধ্যে ছিল সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, আসামিপক্ষের কর্মী ও সাক্ষীদের অপহরণ এবং অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়ায় অযাচিত হস্তক্ষেপ।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি জনাব হক আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র (Formal Charge) পুনর্লিখন করে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগগুলো অন্তর্ভুক্ত করেন, যদিও প্রসিকিউশন ও তদন্ত দলের কাছে এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অনিবার্য হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর একটি কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগ করেন, ফলে ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে জনমনে গভীর সন্দেহের উদ্রেক হয়। এই নিবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিভাবে বিচারক মো: নিজামুল হকের কর্মকাণ্ড কেবল তার ব্যক্তিগত অবস্থানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি; বরং তিনি যে ট্রাইব্যুনালের নেতৃত্বে ছিলেন, তার ভাবমর্যাদায়ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
বিচারক মো: নিজামুল হক নাসিমকে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। শুরু থেকেই তার এই নিয়োগ বিতর্কিত ছিল। যদিও তাকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক এ টি এম ফজলে কবিরের সাথে একযোগে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল; কিন্তু বিচারক কবির ছিলেন নিজামুল হকের চেয়ে জ্যেষ্ঠ। প্রথা অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ বিচারককেই চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা উচিত ছিল; কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বেশি আস্থার কারণে বিচারক হককেই চেয়ারম্যান করে। তিনি আওয়ামী লীগের শাসনামলেই বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং তার আগে ‘তদন্তকারী’ হিসেবে কাজ করেছিলেন- যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই বিচারকার্য পরিচালনা করবেন, সেই একই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত তিনিই করেছিলেন। এটি তার নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে তার অপসারণের জন্য একটি আবেদন করা হলেও তিনি নির্লজ্জভাবে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন।
নিয়োগ পাওয়ার পরপরই বিচারক মো: নিজামুল হক ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিধিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মূল বিধিমালা অনুযায়ী, কেবল প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করার পরই কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আসামি’ হিসেবে গণ্য করা যেত; কিন্তু এই নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। ২০১০ সালের ২৬ জুলাই, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা ছাড়াই তাকে গ্রেফতারের জন্য পরোয়ানা জারি করা হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা সাথে সাথেই আপত্তি জানিয়ে ট্রাইব্যুনালে একটি আবেদন দাখিল করেন, যাতে অপরিণতভাবে জারিকৃত এই গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হয়। এরপর বিচারক হক শুনানি মুলতবি করেন এবং বিধিমালায় পরিবর্তন আনেন। নতুন বিধিমালায় বলা হয়, শুধু আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর নয়, কারো বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেই তাকে ‘আসামি’ হিসেবে গণ্য করা যাবে। এই পরিবর্তনের ফলে ট্রাইব্যুনাল আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দিয়ে কামারুজ্জামানকে জেল হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন।
বিচারক মো: নিজামুল হক আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় আসামিপক্ষের একজন প্রতিপক্ষ সাক্ষীর অপহরণে জড়িত একটি গুরুতর ঘটনার সাথেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যে দিন সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার কথা ছিল, সে দিন তিনি আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সাথে একটি মাইক্রোবাসে করে ট্রাইব্যুনালের দিকে যাচ্ছিলেন। ট্রাইব্যুনালের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই মাইক্রোবাসটি থামানো হয়, দরজা জোরপূর্বক খোলা হয় এবং পুলিশ কর্মকর্তারা আইনজীবীদের সামনেই বালিকে নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তাকে ভারতে পাওয়া যায় এবং তিনি নিশ্চিত করেন যে, পুলিশ তাকে জোরপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল। এতদসত্ত্বেও, প্রসিকিউশন এবং ট্রাইব্যুনালের বিচারকমণ্ডলী উভয়ই এই অপহরণ ঘটনা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। আরো ভয়াবহ বিষয় হলো, যখন প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে ঘটনাটি প্রমাণ করার জন্য ট্রাইব্যুনালের সিকিউরিটি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার অনুরোধ জানান, বিচারক নিজামুল হক ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
বিচারক মো: নিজামুল হক সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়ে আছেন ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারি’র সাথে জড়িত থাকার কারণে। বেলজিয়াম প্রবাসী একজন গবেষক আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সাথে তার গোপন স্কাইপ কথোপকথন জনসমক্ষে ফাঁস হয়ে যায়। এসব আলোচনায় প্রকাশ পায় যে, বিচারক নাসিম নিয়মিতভাবে সরকারপক্ষের মন্ত্রী ও প্রসিকিউশনের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতেন, কিভাবে বিচার পরিচালিত হবে সে বিষয়ে আলোচনা করতেন। জনমনে আরো বেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয় যখন দেখা যায়, তিনি ও আহমেদ জিয়াউদ্দিন মিলে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা করছেন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ আনার জন্য। তখনো প্রসিকিউশন এবং তদন্তকারী দল উভয়ই স্বীকার করেছিল যে, জনাব নিজামীর এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। তবুও বিচারক নাসিম ও জিয়াউদ্দিন নিজেরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র পুনর্লিখন করেন এবং প্রসিকিউশনকে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করতে নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিমালার প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। বিচারক হক একজন নিরপেক্ষ বিচারকের ভূমিকায় ছিলেন না; কিন্তু একই সাথে বিচারক, প্রসিকিউটর এবং তদন্তকারীর ভূমিকা তিনি পালন করছিলেন।
দৈনিক আমার দেশ ও দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা বিচারক মো: নিজামুল হকের স্কাইপ কথোপকথনের বিস্তারিত ফাঁস করে প্রকাশ করলে তার অসদাচরণের বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায়, প্রতিপক্ষ দল আইনি প্রক্রিয়া ন্যায়বিচারের প্রতি এক প্রহসনে পরিণত হয়েছে বলে তার সামনে হাজির হতে অস্বীকার করে। ক্রমবর্ধমান চাপ ও জনরোষের মুখে বিচারক হক শেষ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পদটিতে থাকার অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সরকার ও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেন তাকে বিচার বিভাগে বহাল রাখাকে যথাযথ বলে মনে করেন। বিচারক হককে নীরবে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে পুনর্বহাল করা হয় এবং ২০১৬ সালে তাকে আপিল বিভাগে পদোন্নতি পর্যন্ত দেয়া হয়। তবে তিনি বেঞ্চে একজন নিস্পৃহ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন, খুব কমই তিনি বিচারিক আলোচনা বা আইনি পর্যালোচনায় অংশ নিতেন। স্কাইপ কেলেঙ্কারি স্পষ্টতই তার কর্মজীবন ও জনমনে তার ভাবমূর্তির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। তবে যে বিচারকের সততা এত গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, সরকার ও প্রধান বিচারপতি কর্তৃক তাকে পদে বহাল রাখা ও পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা সম্পর্কে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিকেই নির্দেশ করে।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে বিচার বিভাগ থেকে অবসর নেয়ার পরও সমাজে বিচারক মো: নিজামুল হকের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। বিতর্কিত অতীত সত্ত্বেও তিনি ধীরে ধীরে প্রকাশ্য জীবনযাপনে ফিরে আসেন। অল্প দিনের মধ্যেই তাকে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (BLAST)-এর প্রধান আইন উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। এই সংস্থাটি তখনকার রাজনৈতিক বিরোধী দল, বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর সমালোচনামুখর অবস্থানের জন্য বেশ পরিচিত ছিল। ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করে। তার ভূমিকা ছিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পরীক্ষা করা। বিচারক নাসিম এই পদে কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের রাজনৈতিক উত্তাল পরিস্থিতির পর তার এই মেয়াদ শেষ হয়।
হাইকোর্ট বিভাগে তার প্রত্যাবর্তন, আপিল বিভাগে পদোন্নতি এবং পরবর্তী সময়ে BLAST ও প্রেস কাউন্সিলে নিয়োগ সত্ত্বেও বিচারক মো: নিজামুল হকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কীর্তিকলাপ চিরকাল একটি কলঙ্ক হয়ে থাকবে। ট্রাইব্যুনালে তার বিচারিক অসদাচরণের ইতিহাস আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিচার বিভাগের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র উন্মোচন করেছে। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টে তার ভূমিকা কিংবা জনজীবনে নিঃশব্দ প্রত্যাবর্তন এই ক্ষতির প্রতিকার হতে পারে না। তাকে একজন সম্মানিত বিচারক বা আইন সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা তার অসাধু কার্যকলাপের অকাট্য প্রমাণের মুখে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তার বিশেষত্বহীন বিচারিক কর্মজীবন এখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে স্কাইপ কেলেঙ্কারির জন্যই কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। এমনকি উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত জীবনীও তার আইনি অবদানের চেয়ে এই বিতর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করেছে। তার নাম এখন বিচারিক ক্ষমতার রাজনৈতিক অপব্যবহারের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিবন্ধিত কৌঁসুলি