সাদিয়া সুলতানা রিমি

রেশমি চুড়ি, যা একসময় বাঙালি নারীর সাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, তা আজ ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। এটি কেবল একটি গহনা নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আবেগ এবং নারীর জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ের এক নীরব সাক্ষী। এর বিলুপ্তি কেবল একটি অলংকারের হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং এটি একটি গভীর সাংস্কৃতিক সংকটকে নির্দেশ করে, যা আধুনিকতার দ্রুত প্রবাহে আমাদের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ এবং স্মৃতির বিলোপকে তুলে ধরে।

ঐতিহ্যের এক ঝলক : রেশমি চুড়ি ও তার আবেদন

রেশমি চুড়ি বাঙালি নারীর জীবনে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে আছে। এটি শুধু হাতের শোভা বর্ধন করত না, বরং এর সঙ্গে মিশে ছিল অসংখ্য গল্প, স্মৃতি আর অনুভূতি।

শুভ্রতা ও পবিত্রতা: নববধূর হাতে রেশমি চুড়ি ছিল শুভ্রতা ও পবিত্রতার প্রতীক। এটি ছিল নতুন জীবনের সূচনা, নতুন সম্পর্কের বন্ধন এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনার এক নিদর্শন।

উৎসব ও পার্বণ: ঈদ, দুর্গাপূজা, পহেলা বৈশাখ- যেকোনো উৎসবে বাঙালি নারীর হাতে শোভা পেত রেশমি চুড়ি। বিভিন্ন রঙের রেশমি চুড়ি উৎসবের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তুলত। এর রিনিঝিনি শব্দ যেন উৎসবের এক নিজস্ব সুর সৃষ্টি করত।

দৈনন্দিন জীবন ও সখ্যতা: শুধু বিশেষ দিনেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও রেশমি চুড়ি ছিল বাঙালি নারীর নিত্যসঙ্গী। দু’হাতে রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ যেন তাদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি চলাফেরার সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকত। এটি ছিল তাদের সখ্যতা, আনন্দ, দুঃখ, ভালোবাসার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মা-দাদীদের কাছ থেকে মেয়েরা রেশমি চুড়ি পেত, যা ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের ভালোবাসার এক নিবিড় বন্ধন।

আবেগ ও অনুভূতি: রেশমি চুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নারীর একান্ত আবেগ ও অনুভূতি। ভালোবাসার মানুষের দেওয়া এক সেট রেশমি চুড়ি হয়তো সারাজীবন যত্ন করে রাখত অনেকেই। এটি ছিল প্রেম, বিরহ, আনন্দ, বেদনার এক নীরব ভাষা।

বিলুপ্তির কারণ : আধুনিকতার স্রোতে আজ রেশমি চুড়ি বিলুপ্তির পথে? এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ, যা আধুনিক জীবনযাত্রা এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বর্তমান যুগে ফাস্ট ফ্যাশনের দৌরাত্ম্য রেশমি চুড়ির বাজারকে সংকুচিত করেছে। মেটাল, প্লাস্টিক, কাঁচ বা অন্যান্য কৃত্রিম উপাদানের তৈরি চুড়ি বাজারে সহজলভ্য এবং দামে সস্তা। বিভিন্ন ডিজাইন ও স্বল্প সময়ের মধ্যে নতুন নতুন ট্রেন্ডের আগমন ঐতিহ্যবাহী রেশমি চুড়িকে কোণঠাসা করে দিয়েছে।

আধুনিক পোশাকের সঙ্গে সঙ্গতিহীনতা: শাড়ি এবং সালোয়ার-কামিজের মতো ঐতিহ্যবাহী পোশাকের সঙ্গে রেশমি চুড়ি মানানসই হলেও, জিন্স, টপস বা অন্যান্য পাশ্চাত্য পোশাকের সঙ্গে এর ব্যবহার কমেছে। আধুনিক প্রজন্মের নারীরা আরামদায়ক এবং পাশ্চাত্য পোশাক বেশি পছন্দ করে, ফলে রেশমি চুড়ির ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই কমে গেছে।

যত্নের সমস্যা: রেশমি চুড়ি ভঙ্গুর এবং সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। এর যত্নে বাড়তি মনোযোগের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে, আধুনিক চুড়িগুলো টেকসই এবং সহজে নষ্ট হয় না। নারীর ব্যস্তজীবনে এ বাড়তি যত্ন নেওয়ার সময় বা আগ্রহের অভাব দেখা যায়।

দোকানের অভাব এবং কারিগরদের সঙ্কট: রেশমি চুড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ায় এর কারিগরদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক কারিগর এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। ফলস্বরূপ, রেশমি চুড়ি তৈরির দক্ষতা এবং ঐতিহ্য উভয়ই বিলুপ্ত হচ্ছে। বাজারেও রেশমি চুড়ির দোকান কমে আসছে, যা এর সহজলভ্যতাকে হ্রাস করেছে।

নৈপুণ্যের অবসান: রেশমি চুড়ি তৈরির কারিগরদের দক্ষতা এবং তাদের এ শিল্পও হারিয়ে যাচ্ছে, যা এক ধরনের নৈপুণ্যের বিলুপ্তি।

নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ: নতুন প্রজন্মের নারীরা ঐতিহ্যবাহী অলংকারের চেয়ে আধুনিক ও ট্রেন্ডি গহনার প্রতি বেশি আগ্রহী। রেশমি চুড়ির সঙ্গে তাদের আবেগিক সংযোগের অভাব রয়েছে, যা এর বিলুপ্তিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

বিলুপ্তির প্রভাব: সাংস্কৃতিক শূন্যতা।

রেশমি চুড়ির বিলুপ্তি কেবল একটি অলংকারের হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ঐতিহ্যের বিলোপ: রেশমি চুড়ি বাঙালি নারীর ঐতিহ্যের এক প্রতীক। এর বিলুপ্তি আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, সাজসজ্জা এবং জীবনযাত্রার একটি অংশকে মুছে ফেলছে।

আবেগিক সংযোগের অবসান: রেশমি চুড়ির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বাঙালি নারীর গভীর আবেগ ও স্মৃতি। এটি হারিয়ে গেলে সে আবেগিক সংযোগেরও অবসান ঘটবে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করত।

সাংস্কৃতিক পরিচয় সংকট: প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় থাকে, যা তাদের ঐতিহ্য, পোশাক, ভাষা এবং অলংকারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। রেশমি চুড়ির বিলুপ্তি বাঙালি নারীর সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি অংশকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

বিলুপ্তি রোধে করণীয় : রেশমি চুড়ির বিলুপ্তি রোধে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

রেশমি চুড়ির ঐতিহ্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর প্রচার বাড়ানো যেতে পারে।

রেশমি চুড়িকে আধুনিক ফ্যাশনের সঙ্গে মানানসই করে তোলার জন্য নতুন ডিজাইন এবং উন্নত মানের উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পাশ্চাত্য পোশাকের সঙ্গেও যেন পরা যায়, এমন নকশার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

সরকারি উদ্যোগ: সরকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হিসেবে রেশমি চুড়ি তৈরির কারিগরদের আর্থিক সহায়তা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।

ঐতিহ্যবাহী রেশমি চুড়ির মেলা এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানো যেতে পারে।

আমরা প্রত্যেকেই রেশমি চুড়ি কিনে এবং ব্যবহার করে এর চাহিদা বাড়াতে পারি। উপহার হিসেবে রেশমি চুড়ি দেওয়া যেতে পারে।

রেশমি চুড়ি শুধু একটি গহনা নয়, এটি বাঙালি নারীর আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর বিলুপ্তি আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের জন্য এক অশনি সংকেত। আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা যেন আমাদের শিকড় ভুলে না যাই। রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি ধ্বনি আবার শোনা যাক বাঙালি নারীর হাতে, যা আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর ভালোবাসার প্রতীক হয়ে থাকুক চিরকাল। এটি কেবল একটি অলংকার নয়, এটি আমাদের আবেগ, স্মৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এ ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদেরই দায়িত্ব।

লেখিকা : শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews