রাজধানীর মালিবাগের প্রধান সড়কের চিত্র। গত ২৫ অক্টোবর রিকশাটি সড়কের গর্তে উল্টে পড়ে

মধ্য কার্তিকের এই সময়টা বিকাল না গড়াতেই সন্ধ্যা নেমে আসে। তার উপর দুদিন ধরে কায়ান্তজনিত নিন্মচাপ। গতকাল বিকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি। শহরের একটা বড় অংশজুড়ে ড্রেন সংস্কারের দীর্ঘ দক্ষযজ্ঞের পরও দেখি রাস্তায় পানি জমেছে সেই আগের মতোই। অফিস ছুটির সময় হলেই রাস্তায় জ্যাম বাড়ে। বৃষ্টি হলেও জ্যাম বাড়ে। তো অফিস ছুটির সময় অকালের বৃষ্টি। রাস্তা জুড়ে জ্যামের রাজত্ব। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত। ফিরছিলাম, বাণিজ্য মেলার মাঠের পাশের রাস্তা হয়ে গণভবনের পাশ দিয়ে। এই রাস্তা বহুদিন যাবৎ খুব পছন্দের পথ এই শহরে। এক সময় মাঠের পাশে এক চিলতে কালো সাপের মতো আঁকাবাঁকা এ পথে গাড়ি-ঘোড়া চলত খুব কম। অনেকক্ষণ পর পর দুটো একটা রিকশা চলত টুং টাং। আর ছিল বিশাল বিশাল রেইন ট্রি গাছ। ছিল বলছি। কারণ সপ্তাহখানেক আগেও সেই গাছগুলো ছিল। এখন আর নেই। রাস্তা বড় হচ্ছে। করাতের তলে চলে গেছে তাই সময়ের সাক্ষী বোবা বৃক্ষগুলো। খুব নীরবে বৃক্ষ নিধন হয়ে গেল। আজ গাছ মরলে কাল মানুষ মরবে, আমরা ভুলে যাই। আজ গাছ মারি কাল তাই আমি মরি। অথবা মরার মতো বেঁচে থাকি। ঘোলা চোখে চেয়ে দেখি উন্নয়ন, ইট কাঠ পাথরের বিন্যাস। ভালো ফুটপাত ভেঙে নতুন করে ফুটপাত বানানো হয়। গণভবনের ঠিক পাশের পথটা, যেটা  সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দেয়াল পর্যন্ত গেছে। সেই রাস্তার ফুটপাতে কখনো কাওকে হাঁটতে দেখি না। অথচ কদিন আগেই সিমেন্টের টাইলস ফেলে দিয়ে নতুন করে মুড়ে দেওয়া হলো সিরামিক ইটে। তার আগে হলো ড্রেন সংস্কার। আরেক প্রস্থ দক্ষযজ্ঞ দেখলাম, চোখের সামনেই। কাজ শেষ হয়েছে, ড্রেন বানানো হয়েছে। কাল দেখি তবুও পানি জমেছে পথে।

এরই মধ্যে নতুন মেকআপ দেওয়া রাস্তায় তৈরি হয়েছে বিরাট এক গর্ত। যে গর্তে সামনের দুই চাকা ডুবিয়ে মুখ থুবরে পড়ে আছে একটা সাদা গাড়ি। কি ভোগান্তি! অথচ রাস্তাটা নতুন। এই রাস্তায় তো এমনটা হওয়ার কথা না! তারপরও হয়তো কর্তৃপক্ষ বলবেন, হতেই পারে। মানলাম, হতেই পারে। কিন্তু এরপর? সুশাসন বলে যদি কিছু একটা থাকত, নাগরিক অধিকার আদায়ের যদি কোনো উপায় থাকত। তাইলে নিশ্চয়ই সেই গাড়িওয়ালা অন্তত সেখানে যেতে পারতেন। বলতে পারতেন। যারা রাস্তা বানাল তারা একটা জবাবাদিহিতার মধ্যে পড়ত। অথচ জানি কিছুই হবে না। কিচ্ছু হয় না। শেষ পর্যন্ত দায় নিতে হয় যে ভোগে, তাকেই। অথচ এই রাস্তার জন্য আমরাই ট্যাক্স দেই। সরকার তো নাগরিককে দুর্ভোগহীন রাস্তা দিতে বাধ্য।  সেই সব অধিকারের তালিকা এখন কাজির গরু। 

এই হতাশা বা দুঃখবোধ নতুন নয়। প্রিয় দেশে, প্রিয় নগরে অনেক অপ্রাপ্তি নিয়ে দিন গুজরাই। খুব বেশি কিছু নয়, চেয়েছিলাম একটা জীবন। যে জীবনে একজন মানুষ সকালে বাড়ি থেকে বের হলে বলে দেওয়া যাবে, কতক্ষণে সে ফিরে আসবে। ফিরবে কিনা এই দুশ্চিন্তায় দিন কাটবে না। কেউ একটা গাড়িতে একা আর কেউ ঘাম ছোটা বেসরকারি মিনি বাসে ঠাসাঠাসি ভিড়ে একই জ্যামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করবে না। বরং একই পাবলিক বাহনে সবাই পাশাপাশি বসে যাবে নিশ্চিন্তে। মেট্রো রেল তো দুরস্ত। অন্তত বিআরটিসির বাসগুলো তো নাগরিকবান্ধব হতে পারত। নারীর ক্ষমতা, নারীর স্বাধীনতার সংজ্ঞা নিয়ে চারিদিকে শত আলাপ শুনি। আমি অত শত বুঝি না। শুধু বুঝি আয় আর ক্ষমতা সমার্থক। আর স্বাধীনভাবে বাঁচতে গেলে চলতে গেলে দরকার সার্বিক অবকাঠামো। শুধু গাছ কেটে রাস্তা চওড়া আর নতুন ফুটপাত ভেঙে আবার ফুটপাত বানানো মানেই অবকাঠামো নয়, উন্নয়ন নয়। যে সামগ্রিক অবকাঠামো মানুষকে নিরাপত্তা দেয়, নিশ্চয়তা দেয় সেটা আমাদের দেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। তা না হলে এক দেশ থেকে ভোর পাঁচটার ট্রেনে উঠে একা একা আরেক দেশে গিয়ে সকাল নয়টার অফিস যে ধরতে পারি। আর নিজের দেশে ঘর থেকে সাত কিলোমিটার দূরত্বের অফিস শেষ করে বিকাল পাঁচটায় একা ফেরার কথা ভাবলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অবকাঠামো বা নিরাপত্তার কাছে স্বাধীনতা শব্দটা তখন বড় আপেক্ষিক হয়ে ওঠে। 

এ শহরে আমার জীবনের, আমার সময়ের নিয়ন্ত্রক আমি নই। কি অবলীলায় সবাই এটা মেনে নেই। অভ্যস্থ হয়ে উঠি। একটা ফল খেতে গেলে ভয়ে ভয়ে খাই। অসুস্থ হলে ভয়ে ভয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। মানুষ ন্যায়-অন্যায়কে আর আলাদা করতে পারে না। অনেক ছোট ছোট অন্যায়কে প্রশয় দিতে দিতে এখন তারা ন্যায়ের তালিকায় ঢুকে গেছে। ক্রমাগত বলতে বলতে মিথ্যা যেমন এক দিন সত্যের মতো শোনা যায়, সেরকমভাবে। ট্রাফিক আইন ভাঙলে অন্যায়, ঘুষ খাওয়া অন্যায়, ভুল চিকিৎসা করা অন্যায়, খাবারে বিষ মেশানো অন্যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া অন্যায়, ব্যাংক ডাকাতি অন্যায়, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া অন্যায়, গাছ কাটা অন্যায় এসব আমরা ভুলে বসে আছি। অন্যায়ের ‘অ’ ধুয়ে-মুছে গেছে। 

সামনের ‘অ’ মুছে ন্যায়ের তালিকা বড় করতে করতে আমরা মাঝে মাঝে নড়েচড়ে বসি। কিছু অন্যায়কে এখনও অন্যায়ের তালিকায় রাখা গেছে বলেই হয়তো ইয়াসমিন, তনু বা পূর্ণিমা, পূজাদের মতো কিছু ঘটনায় মৌসুমী হাহাকার, হইচই করি। একটার পর আরেকটা এসে আগেরটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়। আমরা ক্লক ওয়াইজ ঘুরতে থাকি। ভুলে যাই ঘড়িতে ১২টা বেজে গেলে আবার একটা দুইটা থেকে শুরু হয়। 

বেঁচে থাকার ছোট ছোট নাগরিক চাহিদাগুলো মেটার আশায় বসে থেকে কবে তেত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। নাদের আলীরা আসে নাই। এখন  শুধু হাতড়ে বেড়াই উত্তর, কোথায় যাই, কার কাছে যাই?

[প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রিয়.কম লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে প্রিয়.কম-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews