বিশ্ববিভিষীকার নাম ‘নভেল করোনাভাইরাস’। এর দাপ্তরিক নামকরণ হয়েছে SARS-CoV2, পুরো নাম Severe Acute Respiratory Syndrome-Corona Virus 2 (সোজা বাংলায়, শ্বাসতন্ত্রের চরম গুরুতর সঙ্কট সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাস-২)। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে ICTV (International Committee on Taxonomy of Viruses) এই নাম দেবার আগে পর্যন্ত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখ চীনের রিপোর্ট করার পর থেকে এটি ‘নভেল করোনাভাইরাস’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাসজনিত রোগের নাম দিয়েছে Covid 19, ২০১৯ সালের করোনাভাইসাসজনিত রোগ। 'Novel' অর্থাৎ নতুন; তবে, করোনাভাইরাসের ইংরেজি সাইটে ঢুকে হুকুম দিলে গুগলের ‘দৈত্য’ ‘Novel Corona Viruse’ এর বাংলা এনে দিচ্ছে ‘উপন্যাস করোনাভাইরাস’। উপন্যাস হয়ত লেখা হবে, যেমন এককালের মহামারী প্লেগ নিয়ে কালজয়ী লেখা লিখে গেছেন আলবেয়ার কামু (Albert Camus)।

সার্স করোনা ভাইরাস-২ মানুষের যে চরম বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে তার মধ্যে উপন্যাসের, নাটকের, সিনেমার উপাদানের অভাব নেই। প্রবল পরাক্রমশালী, অদৃশ্যমান এক দানব যেন, মৃত্যুভয়কে মূর্তিমান করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবী। মানছে না কারো শাসন, আইন। মানছে না কোনো সীমানা। দাবানলের মতো এগিয়েই চলেছে। ২০৮টা দেশ আর অঞ্চল কাবু করেছে, বাকী নেই কোনো মহাদেশ। বিনাশী শক্তি ক্রমাগত নিজেই বাড়িয়ে নিয়ে (এ পর্যন্ত নাকি ৩৮০ বার সে তার জিনের গঠন বদলিয়ে খাসলত আরও খারাপ করেছে) প্রচন্ড থাবড়ে চলেছে। প্রতিদিন কাতারে কাতার, হাজারে হাজার মানুষ মেরে চলেছে। আক্রান্ত প্রায় সাড়ে ১২ লাখ, মারা গেছে প্রায় ৭০ হাজার, বাকিরা ধুঁকছে। এই লেখা যখন পড়া হবে তখন এ সংখ্যা কত বাড়বে জানি না। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাও মানোন্নত নয় এর কাছে। চিকিৎসকদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা এ ভাইরাসের কাছে পরাস্ত। চিকিৎসককেও রেহাই দিচ্ছে না। দুরাচারী, সদাচারী, আস্তিক, নাস্তিক, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি কোনো বাছ-বিচার নেই। পানশালা ধর্মশালা কোথাও সমবেত হওয়া যাচ্ছে না। অসৎসঙ্গ তো বটেই সাধুসঙ্গও চলবে না। সুরক্ষা শুধু আপন ঘরের দুর্গে। তার থাবড়ি খেয়ে বসে পড়েছে গোটা বিশ্ব। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মহাশক্তিধর প্রধানরা। তাদের অনেককেই একেবারে সত্যিই ঢুকিয়ে দিয়েছে ঘরে। রাণী, রাজপুত্র, রাজকন্যা, প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছাড়ছে না কাউকে। জীবনবিনাশী সব আণবিক-পারমাণবিক অস্ত্র বেকার হয়ে আছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই অণুজীবের কাছে। উন্নয়নের দম্ভকারীদের উন্নয়নের অন্তসারশূন্যতা উন্মোচন করাই যেন তার লক্ষ্য। আকাশমুখী উন্নয়নকে এখন নতজানু-করজোড়ে আকাশের কাছে সমাধান চাইতে নামিয়েছে। প্রচলিত উন্নয়নের সাথে তার বৈরিতা যেন, শিক্ষণীয় কিছু কি আছে?

করোনাভাইরাস নাকি আরও অনেক আগে থেকেই হানা দিয়ে আসছে। সার্স নামেই ২০০২ সালের নভেম্বরে চীনের গুয়াংডঙয়ের ফোসান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে ২৯টি দেশে মহামারী ঘটিয়ে প্রায় ৮০০০ মানুষকে আক্রান্ত করে প্রায় ১০% অর্থাৎ, প্রায় ৮০০ জনের প্রাণ নেয়। ২০১২ সালে সৌদি আরবের এক রোগীর থেকে ‘MERS-CoV’ নামে প্রকাশ পেয়ে বেশ কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৪০০ জনের মৃত্যু ঘটায়। আবার, ২০১৫ সালে মে-জুলাইতে দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘MERS-CoV’ এসে ৩৬ জনের প্রাণ নেয়। ২০১৮ সালে আবারও সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আসিরাতসহ দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ‘MERS-CoV’ দেখা দেয়, সৌদি আরবেই ১৪৫ জন আক্রান্তের মধ্যে ৪১ জন মারা যায়। এইসব করোনা ভাইরাসের পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব নাকি খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ বছর আগে থেকে, কারও কারও মতে তারও আগে থেকেই ছিল, যা বাদুড়ের সাথে সুদীর্ঘকালের সহবিবর্তনের মাধ্যমে চলে আসছে। গোড়ার দিকে কেবল স্তন্যপায়ী প্রাণি ও পাখিকে রোগাক্রান্ত করেছে। আক্রমণের লক্ষ্যস্থল বরাবরই শ্বাসতন্ত্র। মানুষকে লক্ষ্য করেছে নাকি গত শতকের ষাটের দশকের (১৯৬০) শেষের দিক থেকে। আর, রাষ্ট্রগুলো মানুষের জীবন নেবার অস্ত্রশস্ত্র তৈরিতে অর্থ ঢেলেছে পাল্লা দিয়ে। মানুষের জীবন রক্ষায় স্বাস্থ্য চিকিৎসার কাজে, অণুজীব মারার কাজে কৃপণতা করেছে পাল্লা দিয়ে। উন্নয়নের মহোৎসবে মেতে প্রকৃতি ধ্বংস করেছে। চীনের উহানে যখন এখনকার ‘সার্স-কভ২’ এর সংক্রমণ চলছে তখন মার্কিন প্রধান তার জনগণের শত্রুকে অন্যের দেশে একাই দেখতে পেয়েছে (স্বপ্নে!) বলে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণের বিচারের ধার না ধেরে একাই মৃত্যুদন্ডের গোপন আদেশ দিয়ে বোতাম টিপে সীমানা ছাড়িয়ে হাজার হাজার মাইল দূরের আরেক মহাদেশের আরেক দেশে মেরেছে। এই সময়ে ভারতে ‘এনআরসি’ ‘সিএএ’ নিয়ে রক্তারক্তি চলেছে। ‘সার্স-কভ২’ এর আগাম বার্তা কারও গোয়েন্দাই পায়নি! এখন সব রোগতত্ত্ববিদ আর গবেষককে লাগানো হয়েছে কার্যকর ওষুধ, প্রতিষেধক খুঁজতে।

উপায় না পেয়ে সামাজিক জীব মানুষকে এখন নিতে হচ্ছে ‘সামাজিক দূরত্বের’ তত্ত্ব-দাওয়াই। মানুষকে মানুষের থেকে দূরে ঠেলে বিশ্বকে তার হাতের মুঠোয় পুরার মায়াজাল দেয়া হয়েছে আগেই। পাশাপাশি বসা মানুষজন নিজেদের রেখে কথা বলে দূরবর্তী অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে, ভেসে বেড়ায় ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল জগতে। দূরত্ব দিয়ে তৈরি হবে কোন্ মানবিক সমাজ! ভবিষ্যতের মানুষ কি তবে বাস্তবের দেহ ছেড়ে শূন্যে বিচরণ করবে! বিষিত বাতাসে মানুষকে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। একি আর মানুষের মুখ! ‘টিকলো নাক’, ‘মুক্তোঝরা হাসি’ সব শেষ! নিজের হাত সেও শত্রু যেন, সেদুটোও গ্লাভসে ঢুকেছে। এই উড়ন্ত সময়ে ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে স্বঘোষিত অঘোষিত সব বিশেষজ্ঞ হাজির হচ্ছেন বিচিত্র সব তথ্য, তত্ত্ব আর দাওয়াই নিয়ে। কে যে বিশেষভাবে জ্ঞাত আর কে যে বিশেষভাবে অজ্ঞ চেনা দায়। উপশম, নিরাময়ের প্রকৃত ব্যবস্থা না থাকলে কেবল থানকুনিপাতা, কালোজিরা নয়, মানুষকে উষ্ট্রমূত্র, গোমূত্রও গেলাবে। বলা হচ্ছে, ওষুধ-টিকা পেতে নাকি আঠারো মাস লাগবে। কেন, আঠারো মাস কেন? এক মহাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের আরেক মহাদেশে মানুষ মারতে তো ১৮ মিনিটও লাগে না! বাংলায় আঠারো মাস লাগে কুঁড়েদের। এই আঠারো মাসের পর সে ওষুধ, টিকা নেবার দেবার মানুষ থাকবে তো? যদি থাকে তবে আর সব ভাইরাস কি বসে থাকবে? সেসব দমনের ব্যবস্থাটা কখন হবে?

মন যত উত্তপ্তই হোক, শীতল রাখতে হবে শরীর। শরীরে তাপ উঠলেই সমূহ বিপদ। চিকিৎসা মিলবে না সহজে। করোনা সন্দেহে ডাক্তার আসবে না কাছে। রোগতত্ত¡বিদের ঘোর সন্দেহ করোনা নয়, পরীক্ষা অপ্রয়োজনীয়। তাতে প্রতিবেশীদের সন্দেহ ঘুঁচবে না। আইনের শৃঙ্খল প্রয়োগকারীদের ডেকে এনে টাঙিয়ে দেবে লাল পতাকা। কবে হলো, কোথায় পাব এ লাল পতাকা আইন, প্রশ্ন করার সুযোগ মিলবে না। নিজ ঘরের লোক, এমনকি প্রতিবেশীরাও বন্দি হতে পারেন লাল পতাকায়। নিজ দেহের প্রতিরোধী শক্তি নিঃশেষে শেষ নিঃশ্বাস হলে পরিবারে নামবে আরেক দুর্ভোগ। করোনা সন্দেহভাজন এই লাশের কাছে মাছি ছাড়া (মাছিও আসে কিনা আমি নিশ্চিত নই) কাউকেই পাবে না তারা। পরীক্ষার আগে সৎকারের লোক পাওয়া যাবে না। দিন কয়েক পরে পরীক্ষায় করোনার প্রমাণ পাওয়া যায় নি বললেও বিশ্বাস করতে চাইবে না লোকে। গোরস্তান আর শ্মশানের লোকেরা সন্দেহে জায়গা দেবে না শেষকৃত্যের। চারিদিকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসে ভরে গেছে। ডাক্তার বিশ্বাস করে না রোগীকে, রোগীর সন্দেহ ডাক্তারকে। সরকার সন্দেহ করে জনগণকে, জনগণ বিশ্বাস করে না কোনো সরকারকে। এক রাষ্ট্র সন্দেহ করে আরেক রাষ্ট্রকে। এক জাতি বিশ্বাস করছে না আরেক জাতিকে। অবিশ্বাস আর সন্দেহ নিয়ে বেসামাল দুঃসহবস্থানে চলছে আজকের এই দুনিয়া। আস্থা আর বিশ্বাসের বাঁধন জোড়া লাগবে কবে?
কর্মক্ষম মানুষকে অক্ষম বসে থাকতে হচ্ছে। উৎপাদন, ব্যবসা, জীবনজীবিকার সাধারণ সব কাজকর্ম স্বাভাবিক গতি ফিরে পেতে পেতে আছে কত দুর্দশা। এর মধ্যে আবার শুরু হয়ে গেছে ফাঁদ পাতা, হাত পাতা। সাহায্যের হাত নিয়ে যাদের আসবার কথা তাদের অনেকেরই সাড়া নেই, উল্টো অনেকেই সরকারের কাছে হাত পাতছে নানান অজুহাতে। বিদ্যুৎ-লাইনের তারে আঁকশি দিয়ে মাঝপথ থেকে বিদ্যুৎ টেনে নেবার, জ্বালানি গ্যাস-লাইনের মাঝখান থেকে ফুটো করে লাইন লাগিয়ে গ্যাস টেনে নেবার লাইনঘাট চলে যেখানে, সেখানে সরকারি সাহায্য বিতরণের দীর্ঘ পথ, বিস্তর ঘাট পেরিয়ে শেষপ্রান্তের প্রকৃত হকদারের কাছে গিয়ে কতটুকু কতজনের কাছে পৌঁছাবে, কে জানে! ত্রাণের চালের বস্তা ঢুকে গেছে নেতার ঘরে। চিকিৎসকের সুরক্ষায় চলে গেছে নকল মাস্ক, মেয়াদোত্তীর্ণ সামগ্রী। দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজরা শুদ্ধ হবার নয়, হয়নি কোনো কালে। সমাজের এ ভাইরাসদের ধরে না কোনো ভাইরাসে। এই মহামারী থামলে তারা নামবে নতুন দুর্যোগ ঘটাতে। কার পাপে বারে বারে নামে দুর্যোগ, দুর্ভোগ? হয়তবা দেশে দেশে সাধারণ মানুষ এই আমাদেরই। নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রোগ-ব্যাধির ভাইরাসগুলো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিছু কিছু ভাইরাস বোধ হয় মানবাকৃতিতেই জন্মে যুগে যুগে। আমাদেরই অসতর্কতায়, অসচেনতায় আমাদেরই হাত দিয়ে তারা ঢুকে পড়ে দেশে দেশে সমাজের, রাষ্ট্রের নানা জায়গায়। এই করোনা ভাইরাসকালের শিক্ষাটা এই, নিজেদের সচেতনতা আর ভেতরের প্রতিরোধী শক্তিটা বাড়ান- শরীরের বালাই, দেশের বালাই, বিশ্বের বালাই নাশ করতে।
লেখক: সাবেক সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews