আমি সৌভাগ্যবান। পঞ্চাশ বছর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধ যখন প্রত্যক্ষ করেছি তখন আমি কুড়ি-একুশ বছরের যুবক। আবার পঞ্চাশ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের রমরমা অবস্থা এবং স্বাধীনতার সুফল প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করছি যখন, তখন আমি স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনাসম্পন্ন একজন মোটামুটি সম্পূর্ণ মানুষ। যার বোধ, চেতনা, সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস আজও টনটনে এবং স্বাভাবিক। মায়ের বদন-খানি মলিন দেখলে সত্যিই বেদনার্ত হই। আবার মায়ের মুখের বাণী সারাক্ষণ সুধার মতোই লাগে এবং লাগবেও।
দেখতে দেখতে পঞ্চাশ পার হয়ে গেল। মনে হয় এই তো সেদিন। পেছনে তাকালে বন্দর দেখতে পাই। স্বাধীনতার বন্দর। দেখতে পাই স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বকালীন প্রস্তুতির দিনগুলোকেও। পুরো ষাটের দশকের স্মৃতি আজও উজ্জ্বল। ষাটের দশকের উদ্দীপক ঘটনাবলি বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি নেতৃত্বে উজ্জীবিত সব ধর্মের বাঙালির জেগে ওঠা ইত্যাদি বিষয়গুলো এখনো মনে হয় আঙুলের ডগায় স্পর্শ করা যায়। উত্তাল মার্চের প্রথম দিন থেকে কালরাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত সেলুলয়েডের ফ্রেমে চলমান সাদাকালো ছবিমালা। কী ভীষণ উজ্জ্বল এবং সত্য।
তবে পার হয়ে আসা পঞ্চাশ কিন্তু ভীষণ টালমাটাল। ভীষণ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। কত ঘটন কত অঘটন। যে মহান নেতার নেতৃত্বে সাড়ে ৭ কোটি প্রাণ এক সুতোয় গাঁথা হলো, জীবন ত্যাগ করল ৩০ লাখ বাঙালি, লাঞ্ছিত হলো কয়েক লাখ নারী, মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বাদ পেল একটি ছোট্ট ভূখণ্ডের অতি পুরোনো এক জনপদ, সেই নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করল স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর যেতে না যেতে। তারপর বছরের পর বছর আমরা দেখলাম হত্যা, রক্তগঙ্গা আর নিষ্ঠুরতার নির্মমতা। দেখলাম কীভাবে ধ্বংস করা হলো মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। দেখলাম বিশ্বনন্দিত পবিত্র সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ।
জনপদের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি আর সভ্যতাকে ধ্বংস করে ইতিহাসবিমুখ করার সর্বাত্মক চেষ্টা তো পঞ্চাশের পথেই দেখলাম। বারবার পদদলিত হলো মানবতা, গণতন্ত্র এবং মুক্তিবাক্। পঞ্চাশ বছরের যাত্রায় কত বার যে পাল ছিঁড়ল, হাল ভাঙল। তবুও শত বন্ধের ভেতর গুমোট অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়েও প্রিয় বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে বারবার বলেছি, তুমি আছ। আমি আছি। জানি একা নই কোটি কোটি দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপন্থির দলে আমিও একজন। মনে মনে বিশ্বাস রেখেছি, এই জনপদের মানুষ কখনো পরাজিত হয়নি। আঁধার কেটে নতুন সূর্যের আলোয় উজ্জ্বলতর হবে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ভাবমূর্তি। পূরণ হবে স্বাধীনতা ও বিজয়ের মহামন্ত্রে মিশে থাকা অনেক প্রত্যাশা।
পঞ্চাশ পেরিয়ে আজ দেখছি বাংলাদেশ ফিরে পাচ্ছে তার লুণ্ঠিত গৌরব। উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটছি আমরা। নিজ অর্থে বিশাল পদ্মাকে বেঁধে ফেলার সক্ষমতার ভেতর মুক্তিযুদ্ধের সাহস আছে না কি? ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকারীদের সৃষ্ট জাহান্নামের আগুনের মধ্যে আজ বাংলাদেশ হাসছে পুষ্পের হাসি। উন্নয়নের খতিয়ান স্বল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে ঘোষিত হলো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে প্রবেশ করার ছাড়পত্র। জয় বাংলা।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও আহ্বায়ক, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
ইত্তেফাক/জেডএইচডি