ব্রিটেনের দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব টিউলিপ সিদ্দিক এবং রুশানারা আলীর পরপর পদত্যাগে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটি। দেশটির মন্ত্রিসভায় প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হিসেবে স্থান পাওয়া এই দুই অগ্রগামী নেত্রীর সংক্ষিপ্ত মন্ত্রিত্বকাল শেষ হয়েছে পৃথক দুটি বিতর্কের মধ্য দিয়ে। এতে কমিউনিটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনকে সাংবাদিক সাইদুল ইসলাম বলেন, টিউলিপ এবং রুশানারাকে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজনৈতিক প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে তাদের দ্রুত পদত্যাগ গভীর হতাশা ও লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উভয় পদত্যাগের পেছনেই আর্থিক অসঙ্গতির অভিযোগ জড়িত ছিল।
গত ১৪ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন নগর ও দুর্নীতিদমন বিষয়ক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন টিউলিপ। বিতর্কের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়, যখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার টিউলিপের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি দখলের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। যদিও তদন্তকারী ব্রিটিশ উপদেষ্টা প্রাথমিকভাবে আচরণবিধির কোনও লঙ্ঘন খুঁজে পাননি, তবুও টিউলিপ তার পদত্যাগপত্রে বলেছিলেন যে এই পদে থাকলে সরকারের কাজে ‘ব্যাঘাত’ ঘটবে।
এদিকে, গৃহহীনতা বিষয়ক মন্ত্রী রুশানারা আলী ১৩ মাস দায়িত্ব পালনের পর বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) পদত্যাগ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে লেখা পদত্যাগপত্রে রুশানারা বলেন, তিনি সকল আইনি নিয়ম মেনে চললেও, পদে থাকাটা একটি ‘বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি করবে।
তার পদত্যাগের কারণ ছিল একটি বিতর্কিত ঘটনা, যেখানে তিনি তার ইস্ট লন্ডনের সম্পত্তি থেকে ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করে মাসিক ভাড়া ৭০০ পাউন্ড বৃদ্ধি করেছিলেন। সমালোচকরা এই ঘটনাকে ‘ভণ্ডামির চরম দৃষ্টান্ত’ বলে আখ্যায়িত করেন।
এটি রুশানারার বিরুদ্ধে প্রথম বিতর্ক না। গত বছর অক্টোবরে তিনি গ্রেনফেল টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলোর সমালোচনার মুখে তার বিল্ডিং সেফটি বিষয়ক দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। সেই সময় তিনি গ্রেনফেল তদন্তে সমালোচিত একটি প্রতিষ্ঠান, সেন্ট-গোবেইনের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত একটি সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন।
এই পদত্যাগে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। লন্ডনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের একটি বড় জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও, ব্রিটিশ-ভারতীয় এবং ব্রিটিশ-পাকিস্তানিদের মতো অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেছে। উদাহরণ হিসেবে প্রায়শই একজন সাবেক ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এবং একজন ব্রিটিশ-পাকিস্তানি লন্ডনের মেয়রের কথা উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে, টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুৎফুর রহমানের নামের আগে 'বিতর্কিত' শব্দটি সব খবরের বিশেষণে পরিণত হয়েছে।
সমালোচকরা মনে করেন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্যের অভাব, ব্যক্তিগত লাভের দিকে মনোযোগ এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি বড় বাধা। এই বছর নিউ ইয়ার অনার্স তালিকায় কোনও ব্রিটিশ-বাংলাদেশির নাম না থাকাও উদ্বেগজনক বলে মনে করা হচ্ছে। এসব ঘটনা এবং অতীতে অন্যান্য ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কাউন্সিলরদের সঙ্গে জড়িত বিতর্কগুলো একটি নেতিবাচক ধারা তৈরি করছে, যা কমিউনিটির সুনাম ক্ষুণ্ন করার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
তুলনামূলকভাবে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতিতে অনেক পিছিয়ে। এর একটি বড় কারণ হলো, সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য, বিতর্কহীন এবং অপেক্ষাকৃত 'পরিচ্ছন্ন' আদর্শ কোনও নেতা নেই।
ব্যারিষ্টার সালাহ উদ্দীন সুমন বলেন, এই ব্যর্থতাগুলো আমাদের (ব্রিটিশ বাংলাদেশি) রাজনীতিবিদদের জন্য একটি কঠোর বার্তা এবং এগুলো নতুন প্রজন্মকে মূলধারার রাজনীতিতে উৎসাহিত করার পরিবর্তে নিরুৎসাহিত করছে।