রাজনীতিতে ‘ঐক্য’ শব্দটা নানা কারণেই আলোচিত হয়। বিশেষ করে দেশ ও জাতি বড় কোনো সংকটে পড়লে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নটি সামনে আসে।

বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই সব রাজনৈতিক দলের অবস্থান অভিন্ন নয়। রাজনৈতিক মতভেদ ও মতপার্থক্য থাকলেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যের যে প্রত্যাশা করা হয়, সেটিও অনেক সময় ব্যর্থ হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষের মানসকাঠামোই এমন যে, এখানে তিনজন মিলে একটি দল বা সংগঠন করলে কিছুদিন পরে সেটি অন্তত চারটি উপদলে ভাগ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ খুব বেশিদিন লোকেরা একসঙ্গে থাকতে পারে না বা ঐক্য স্থিতিশীল হয় না।

রাজনীতিতে এই অনৈক্যের সুর সবচেয়ে বেশি। বরং যখনই দেশ বড় কোনো সংকটে পড়ে এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে, তখন বলা হয়, কার সঙ্গে কার ঐক্য? অর্থাৎ মত ও আদর্শের পার্থক্য নিয়েও যে দেশের প্রশ্নে কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়া যায় বা হওয়া উচিত—ওই জায়গাটিতেও বিরাট শূন্যতা রয়ে গেছে।

গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নটি অনেক বেশি সামনে এসেছে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশনের বাইরেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করেছে—যার সভাপতি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তবে সহ-সভাপতি হিসেবে মূল দায়িত্ব পালন করছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ। মূলত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর মতামত গ্রহণ এবং মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাই এই কমিশনের লক্ষ্য।

প্রশ্ন হলো-

১. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদৌ ঐক্য স্থাপিত হচ্ছে কি না বা হবে কি না?

২. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আসলেই কি ঐক্য হওয়া সম্ভব? বিশেষ করে সংবিধানের ভাষা, মূলনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্ম, সংসদ, নির্বাচনি ব্যবস্থা ও পদ্ধতি ইস্যুতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের যেখানে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, সেখানে এরকম বিষয়ে ঐক্য হওয়া সম্ভব কি না বা এইসব ইস্যুতে সব দলের ঐক্য আসলে কতটা জরুরি?

৩. ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা তথা মতভিন্নতাই যেখানে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, সেখানে সকল রাজনৈতিক দল কিছু বিষয়ে একমত হবে বা তাদেরকে একমত হতে হবে, এই চিন্তাটিও গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না?

৪. কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে আদর্শিক পার্থক্য এত বেশি যে, তাদেরকে এক টেবিলে বসিয়ে কোনো বিষয়ে একমত হতে বলা বা তাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টাই একটি ব্যর্থচেষ্টা কি না?

বিএনপির সঙ্গে বাকিদের ঐক্য সম্ভব?

ধরা যাক বিএনপি ও জামায়াত। বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক প্রশ্নে এই দুটি দলের মধ্যে ঐক্য স্থাপন কি আদৌ সম্ভব? যদি না হয় তাহলে তাদের মধ্যে সংবিধান ও অন্যান্য বিষয়ে ঐকমত্য হবে কী করে?

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর উত্তম। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার পক্ষে দেওয়া তার ঘোষণাটি ওই সময় সেনাবাহিনী তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও উদ্দীপ্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছে।

পক্ষান্তরে জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থেকেছে। তার মানে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্মের ইস্যুতেই জামায়াতের সঙ্গে অন্য দলগুলোর মৌলিক পার্থক্য স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও ভোটের রাজনীতিতে একসময় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের যেমন সখ্য তৈরি হয়েছে, তেমনি বিএনপির সঙ্গেও জামায়াতের নির্বাচনি জোট হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনি জোট হলেই কি রাষ্ট্রের মৌলিক ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলগুলোর আদর্শিক ও নীতিগত ঐক্য সম্ভব? সুতরাং, জাতীয় ঐক্যের জন্য ঐকমত্য কমিশন যে প্রায় ৩০টি দলকে এক টেবিলে নিয়ে আলোচনা করছে, সেখানে অন্তত জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ঐক্য সম্ভব কি না—সেটি বিরাট প্রশ্ন।

জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-(এনসিপি) ১৯৭১ ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে যে ধরনের বয়ান দেয় বা এই ইস্যুতে তাদের যে অবস্থান, সেটি কি বিএনপির সঙ্গে পুরোপুরি মিলবে?

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মূলত আওয়ামী লীগের ছায়াতলেই ছিল এতদিন। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের আগে থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শিথিল হতে থাকে। তাদের দলের শীর্ষ নেতা এখন বলছেন, তারা ক্ষমতায় গেলে দেশে শরিয়া আইন চালু করবেন। এমনকি তারা তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানকে ‘মডেল’ বা আদর্শ মনে করেন। এরকম চিন্তা ও আদর্শের একটি দলের সঙ্গে বাকি দলগুলোর ঐক্য হবে কী করে? তাছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের পরে জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের সম্পর্ক ভালো হলেও বা দেশের সবগুলো ইসলামপন্থি দল আগামী নির্বাচনে একই পতাকাতলে থাকার কথা শোনা গেলেও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন মধ্যে তরিকাগত যে পার্থক্য রয়েছে, শেষমেষ ঐক্য হবে কি না—তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে।

কোথায় ঐক্য?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পরের বছরেই গণপরিষদে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের মধ্য দিয়ে যে সংবিধান প্রণীত হলো, ওই সংবিধানের প্রস্তাবনা ও মূলনীতি, তার ভাষা, ক্ষমতা কাঠামোর বিন্যাস ইত্যাদি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কি ঐক্য সম্ভব? তাছাড়া একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেশের গণপরিষদ সদস্যরা যে সংবিধানটি রচনা করলেন, তার মূলনীতি ও অন্যান্য মৌলিক বিষয় পরিবর্তনের যদি প্রয়োজন হয়, সেখানে আদর্শিকভাবে বিপরীত অবস্থানে থাকা দলগুলোর মধ্যে কি ঐক্য সম্ভব?

একেকটি দল তাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের আলোকে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। তারা একেকভাবে সংসদের কাঠামো চিন্তা করে। সুতরাং, সংসদ এক কক্ষবিশিষ্ট থাকবে নাকি দ্বিকক্ষ হবে, সেই বিষয়েও রাজনৈতিক ঐকমত্য স্থাপন কঠিন। বরং এসব প্রশ্নের সুরাহা করার একমাত্র স্থান হচ্ছে জাতীয় সংসদ। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি একমত হন তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা যদি কোনো এক বা একাধিক পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দেন, তাহলেই সংবিধানে বড় কোনো পরিবর্তন আসতে পারে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু রাজনৈতিক দলকে চায়ের টেবিলে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের প্রশ্নে ঐকমত্য প্রত্যাশা করবে—সেটি কতটা যুক্তিসঙ্গত ও গণতান্ত্রিক, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বলা হতে পারে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অতীতের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নয়। কেননা তারা অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী দলগুলোর সমর্থনে গঠিত হয়েছে। অতএব রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে উদ্যোগ নেওয়ার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু দলগুলো যদি অধিকাংশ বিষয়ে বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় একমত না হয়, তখন কী হবে?

ঐকমত্যের ধারণাটিই কি গণতান্ত্রিক?

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ গত ১৫ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ১৪তম দিনের সংলাপের সূচনা বক্তব্যে বলেছেন, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ব্যর্থ হলে তা হবে সম্মিলিত ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার দায় রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিতে হবে।”

প্রশ্ন হলো, কমিশনের সফলতা ও ব্যর্থতার মানদণ্ড কী? কমিশন কি মনে করে যে, সব বিষয়ে বা অধিকাংশ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে? রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হলেও কমিশন ব্যর্থ হয়ে যাবে কেন? বরং কমিশন যে প্রায় তিরিশটি দলকে এক টেবিলে বসাতে পেরেছে, এটিও কম সাফল্য নয়। প্রশ্ন হলো, কমিশন কেন এটা প্রত্যাশা করছে যে, তাদের সংস্কার প্রস্তাবের ওপর সবাইকে একমত হতে হবে? বরং একমত না হওয়াটাও গণতন্ত্র। যদি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হতে পারে, সেটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু একমত না হলেই কমিশন ব্যর্থ হয়ে যাবে বলার অর্থ হলো কমিশন তাদের চিন্তা ও পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। এটিই বরং অগণতান্ত্রিক।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মূলত ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সনদ প্রণয়নের দিকে এগিয়ে যেতে চায়—যে বিষয়ে সরকারের ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ দিচ্ছে এনসিপি। সরকার বা ঐকমত্য কমিশন কি এনসিপি যেভাবে চায়, সেভাবে জুলাই সনদ তৈরি করতে চায়? বাকি দলগুলো বা অধিকাংশ দল যদি সেটি মেনে না নেয় তাহলে কী হবে?

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, সংসদের উচ্চকক্ষ, সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা একশ এবং সরাসরি নির্বাচন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতেই ঐকমত্য হয়নি। কমিশন এক্ষেত্রে কী করবে? আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে অধিকাংশ যে বিষয়ে একমত সেটি গৃহীত বলে সিদ্ধান্ত দেবে? ধরা যাক, আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ২৮টি দলের মধ্যে ২০টি দল কোনো একটি বিষয়ে একমত হলো, কিন্তু বিএনপিসহ বাকি দলগুলো একমত হল না, তখন কী হবে? যেমন সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায় জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এনসিপিসহ আরও কিছু দল। বিশেষ করে যাদের বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থায় ২০টির বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা কম বা বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেসব দলের অনেক প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে দল প্রাপ্ত মোট ভোটের যত শতাংশ পাবে, ওই অনুযায়ী সংসদে আসন পাবে। যেমন জামায়াত যদি ১০ শতাংশ ভোট পায় তাহলে সংসদে তারা ৩০টি আসন পাবে। যদিও বিএনপি এই পদ্ধতিতে রাজি নয়। তারা বিদ্যমান পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে। জামায়াত এরইমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে, যদি বিএনপি একা না চায়, তাহলে কি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে না?

গণতন্ত্রের মৌলিক রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে নেয়ার কথা। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল বৈঠক করছে, তাদের মধ্যে বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলেরই এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই। অর্থাৎ জনগণ বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলকে দেশ পরিচালনার এখতিয়ার দেয়নি। আলোচনায় অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে কেবল জামায়াত সরকারের অংশ ছিল, তাও বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকার কারণে। সুতরাং বিএনপির একার যে অবস্থান এবং তার কথার যে গুরুত্ব, বাকি সব দল মিলেও সেটি হওয়ার কথা নয়। এমনকি ঐকমত্য কমিশনের এই আলোচনায় এমনও এক দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যাদের এখনও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনই হয়নি। এমনকি নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক যাচাইতেও তারা বাদ পড়েছে। সুতরাং এরকম একটি দল যা বলবে, যেভাবে বলবে, সরকার বা ঐকমত্য কমিশন সেটি মেনে নেবে কি না, এ প্রশ্নও আছে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews