কয়েক দিন আগে গণমাধ্যমে একটা খবর শুনেছিলাম এবং পড়েছিলাম। খবরটি হলো, ‘গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে—এই মর্মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগিরই এ সম্পর্কে একটি বিল জাতীয় সংসদে তোলা হবে।

বেশ কিছুদিন আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তিনি কেন এই কথা বলতে গেলেন, তা আজও আমার বোধের বাইরে। তিনি কি ভেবেছিলেন, শহীদদের সংখ্যা কম করে বললে তাঁর প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ঘায়েল হবে? শহীদেরা কি রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি? বিষয়টি স্পর্শকাতর এবং এ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি রাজনীতির মেঠো ঝগড়াটা আরও উসকে দিয়েছেন।

প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে আন্দাজনির্ভর অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। এই আইন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিক প্রেক্ষিতের ওপর দাঁড় করানো হবে, নাকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা হবে—এটাই হলো আলোচনার বিষয়।

আমি অনেক দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর আদি-অন্ত ঘাঁটাঘাঁটি করছি। আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি, ইতিহাসের কোনো সরল পাঠ নেই। তাহলে আমরা ইতিহাস জানব কেমন করে? গোলটেবিল আলোচনায় বা টক শোতে আমরা প্রায়ই বলতে শুনি—এর বিচার ইতিহাসের ওপর ছেড়ে দিলাম। মুশকিল হলো, ওই ‘ইতিহাস’ জিনিসটা কী? কে বা কারা কবে এটা লিখে গেছেন? ইতিহাস তো আসমানি কিতাব
নয় যে এটার পরিবর্তন করা যাবে না। যত দিন যাবে আমরা ততই নতুন নতুন তথ্যের খোঁজ পাব, নানা মাত্রার বিশ্লেষণ চোখে পড়বে। ফলে আমাদের জানার পরিধি কিংবা জ্ঞানের ভান্ডার আরও বিস্তৃত হবে।

ইতিহাসচর্চা একটি চলমান প্রক্রিয়া। যে কেউ তাঁর অনুসন্ধানী মন এবং বিচার-বুদ্ধি দিয়ে এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। সাহিত্যিক হওয়ার জন্য যেমন সাহিত্যের ছাত্র হওয়া আবশ্যিক শর্ত নয়, তেমনি ইতিহাসচর্চার অধিকার পাওয়ার জন্য ইতিহাসের ডিগ্রি থাকাও খুব জরুরি নয়। আমরা সচরাচর বলে থাকি, একজন কৃষক হলেন শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। তিনি জানেন এবং বোঝেন কখন কোন ফসলটা ফলাতে হবে। এক মৌসুমে বাজারে মার খেলে পরের মৌসুমে কৃষক ওই ফসল আর উৎপাদন করতে আগ্রহী হন না। এ জন্য তাঁকে অর্থশাস্ত্র বা হিসাববিজ্ঞান পড়ার দরকার হয় না। অভিজ্ঞতাই তাঁকে অর্থনীতিবিদ বানিয়ে দেয়। হাওরে এবার আগাম বন্যার কারণে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কোনো কোনো পণ্ডিতকে বলতে শুনেছি, ‘ক্রপিং প্যাটার্ন’ বদলাতে হবে। হাওরে যে পদ্ধতিতে এবং যে ক্রম অনুযায়ী চাষাবাদ হয়, তা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাজাত। চাইলেই তা বদলানো যায় না।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম স্বাভাবিকভাবে হয়নি। একটি রাষ্ট্র ভেঙে আরেকটি রাষ্ট্র, তা-ও আবার আপসে নয়, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এমন একটা উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিরল। বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চা তাই সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে না।

একাত্তরে এ দেশে যে প্রচণ্ড ওলটপালট হয়ে গেল, তা এ দেশের অধিকাংশ মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। এত রক্ত, এত মৃত্যু এর আগে আমরা দেখিনি। একাত্তরকে নিয়ে তাই আমরা গভীর কষ্ট ও আবেগ অনুভব করি। আবেগের চাদরটা গায়ে থাকলে অনেক সময় সহজ-সরল সত্যটা চোখে ধরা পড়ে না। সময় যত বয়ে যায়, আবেগ যত থিতিয়ে আসে, ততই আমরা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ফেলে আসা সময়টাকে বিচার করতে পারি, নির্মোহ হয়ে সত্য উদ্‌ঘাটন করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে চার দশক পরে এখন আমরা অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ হয়ে বিশ্লেষণ করার অবস্থায় এসেছি কি?

সম্প্রতি আমি লেখক-সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি পড়ছিলাম। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে একাত্তর সালের সরকার গঠন ও অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলেন। ঘটনাটি তিনি আত্মস্মৃতিতে
উল্লেখ করেছেন। জবাবে তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘আমি, আপনি এবং কামরুদ্দীন সাহেব একত্রে বসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে পারি।’ পরে বললেন, ‘এখন সত্য ইতিহাস লেখা যাবে না। লিখবেন না, লিখলে মেরে ফেলবে।’ বোঝা যায়, একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন ছিল। অনেক সত্যই চাপা পড়েছে বা চাপা দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসের সাক্ষী একেকজন ব্যক্তির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসেরও মৃত্যু হয়।

বলতে দ্বিধা নেই, অনেক কিছু লেখার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। ইতিহাসচর্চার অংশ হিসেবে আমাকে অনেকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। আমি তাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আলাপের একপর্যায়ে এসে তাঁরা কেউ কেউ বলেছেন, ‘রেকর্ডারটা বন্ধ করুন।’ অথবা বলেছেন, ‘এটা ক্ল্যাসিফায়েড, আমাকে কোট করবেন না।’ আমি তাঁদের শুধু বিব্রত বোধ করতেই দেখিনি, তাঁদের মধ্যে ভীতিও লক্ষ করেছি। পাঠকদের নিয়েও কিছু সমস্যা আছে। নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ গ্রহণ করার মতো পাঠকমন অনেক ক্ষেত্রে এখনো তৈরি হয়নি। এ জন্য আরও সময় দরকার। এ দেশে ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

একটা বাড়ি তৈরি করার আগে তার একটা নকশা তৈরি করতে হয়। আগে এটা যে কেউ করে দিতেন। বাড়ি তৈরির যে ‘ওস্তাগার’, তিনিও মালিককে নানা পরামর্শ দিতেন। এখন নকশা তৈরি করেন পেশাদার স্থপতি। প্রকৌশলীরা ‘এস্টিমেট’ তৈরি করেন। তারপর তৈরি হয় বাড়ি, মালিকের নিজের তত্ত্বাবধানে কিংবা ঠিকাদারের মাধ্যমে। এ দেশটা স্বাধীন করার জন্য আগে থেকেই কেউ একটা ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে রাখেননি। কোনো একটা ‘ক্রিয়ার’ প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। সব সিদ্ধান্ত এক জায়গা থেকে কিংবা একজনের মাথা থেকে আসেনি। সবকিছু গোছানো কিংবা ছকে বাঁধা ছিল না। সব ঘটনা সরলরেখায় চলেনি। জটিল এই সময়ের বহুমাত্রিকতা এক দিনে কিংবা একটি লেখায় বিধৃত করা সম্ভব নয়।

আমাদের দেশটা দলকানা বুদ্ধিজীবীতে ভরে গেছে। নানা মতলব থেকে তাঁরা ইতিহাস তৈরি করেন। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তার সার্টিফিকেট দেন। ইতিহাস ঠিকঠাকভাবে চর্চা করার সময় আমরা তাই সমস্যায় পড়ে যাই। একটা জুজু আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। সত্য কথা লিখতে গেলে কেউ যদি বলে বসে, ব্যাটা অমুকের দালাল? তাদের দৌরাত্ম্যে সত্য বলা বা লেখা রীতিমতো বিপজ্জনক।

‘দলদাসরা’ যখন ইতিহাস লেখেন, সেটা হয়ে যায় নেতৃবন্দনার পুঁথি। তাঁরা খেয়াল রাখেন, কাকে পূজা করলে কিংবা কাকে গালি দিলে তরক্কি হবে এবং প্রাপ্তিযোগ ঘটবে। সে জন্য ইতিহাসের নামে লেখা হচ্ছে অজস্র ‘গরু’ বিষয়ক রচনা।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে উঠে আসবে ‘গণহত্যা’ প্রসঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নয় মাসে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা এ দেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কতজন যে যুদ্ধ ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন, তার সঠিক হিসাব কোনো দিনই বের করা সম্ভব হবে না। মস্কো থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রাভদা পত্রিকায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি বলে উল্লেখ করেছিল। বার্তা সংস্থা ‘এনা’ পরিবেশিত এই সংবাদ দ্য বাংলাদেশ অবজারভারে ছাপা হয়েছিল ৫ জানুয়ারি ১৯৭২। পাকিস্তান অবশ্য সংখ্যাটি সব সময় কম দেখিয়ে নিজেদের অপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করেছে।

দরিদ্র সাধারণ মানুষেরাই নিহত হয়েছেন বেশি। শহীদদের মধ্যেও শ্রেণিবিভক্তি হয়েছে। কেউ কেউ তারকাখ্যাতি পেয়েছেন। অন্যরা অপাঙ্‌ক্তেয় রয়ে গেছেন। শহীদ এখন একটি সংখ্যাবাচক শব্দ। তাঁদের নামের কোনো পরিপূর্ণ তালিকা নেই। তবে সংখ্যা নিয়ে রুচিহীন
ঝগড়া, বাগাড়ম্বর এবং কাদা-ছোড়াছুড়ি আছে। শহীদদের প্রতি মমত্ববোধ কতটুকু আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি আছে বিস্তর, একাডেমিক আলোচনা কম। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনের একটা বড় ঘটনা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের ফসল। সুতরাং, এ নিয়ে আমরা গর্ব করব এবং একই সঙ্গে এর খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করব। খুব ভালো হয়, যদি রাজনীতিবিদেরা নিজেরা ইতিহাসচর্চা একটু কম করেন এবং বিষয়টা গবেষকদের হাতে ছেড়ে দেন।

গবেষকদের মধ্যেও অনেক বর্ণচোরা আছেন। তাঁরা বুঝে গেছেন কখন কোনটা বলতে হয়, কোন মৌসুমে কী কথা ছাড়তে হয়। তবে এ প্রবণতা বেশি দিন টিকবে না। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক বিচার-বিশ্লেষণে মিথ্যা বেশি দিন টেকানো যায় না। আবার আইন করে বা চোখ রাঙানি দিয়েও মানুষকে মনগড়া ইতিহাস গেলানো যাবে না।

সবাই সব বিষয়ে একমত হবেন, এটা আশা করা যায় না। তবে তথ্যের বিকৃতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের একটা সচেতন প্রয়াস থাকতে হবে, যেন বদমতলব থেকে এবং বাগাড়ম্বর দিয়ে ইতিহাসের সত্যটা চাপা দেওয়া না হয়। আমাদের মধ্যে গড়ে উঠুক বুদ্ধিবৃত্তিক সহনশীলতা, যুক্তিনির্ভর আলোচনার অভ্যাস এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছানোর চেষ্টা।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
mohi2005@gmail.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews