আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন গণভোটকে ঘিরে দেশ জুড়ে যে আলোচনা-সমালোচনা, আগ্রহ ও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান: বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বুধবার ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে (এনডিসি) এক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করেই বলেছেন-এই নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা হবে ঐতিহাসিক এবং এই মুহূর্তটি জাতির জন্য হবে একধরনের গর্বের সময়। তার বক্তব্য শুধু একটি আনুষ্ঠানিক আহ্বান নয়; বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রশাসনিক কাঠামো ও আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনী শুধু সামরিক দায়িত্বেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তা, জাতীয় সংকটে প্রশাসনকে সহযোগিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়দায়িত্ব পালনে তারা ছিল আস্থার প্রতীক। কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি আরো জটিল, আরো সংবেদনশীল, এমন নির্বাচনি পরিবেশ বহুদিন দেশের সামনে আসেনি।
২০২৪-২৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দীর্ঘদিনের একচ্ছত্র শাসনের অবসান এবং সর্বশেষ পরিবর্তনসমূহের ধারাবাহিকতায় দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে ইতিমধ্যেই একধরনের শূন্যতা ও অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনের আগমুহূর্তে পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিভিল ব্যুরোক্রেসি পর্যন্ত একটি স্পষ্ট অস্থিতিশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা স্বাভাবিকভাবেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করি।
এমন বাস্তবতায় সশস্ত্র বাহিনীই হয়ে উঠেছে সরকারের প্রধান ভরসা। কারণ তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রলোভন ও উসকানি থেকে নিজেদের দূরে রেখেছে। সামরিক শাসনের পথে যেতে নানা ষড়যন্ত্র ও উসকানি দেওয়া হলেও, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার স্বার্থে সেই পথে না গিয়ে গণতান্ত্রিক শক্তিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে, যা একটি পেশাদার, নৈতিক ও দেশপ্রেমিক বাহিনীর বৈশিষ্ট্য।
নির্বাচন শুধু ভোটের দিন মাঠে নিরাপত্তা প্রদান নয়; তার আগে আরো বহু জটিল কাজ রয়েছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা-সবকিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ কথা বলতেই হবে যে, ২০২৬ সালের নির্বাচন শুধু দেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংঘাত, মানবাধিকার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক বিতর্ক, বিদেশি শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক আগ্রহ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাস্তবতা-সব মিলিয়ে এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সক্ষমতার একটি বড় পরীক্ষা। এ নির্বাচনকে 'বিশ্বমানের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসনিক দক্ষতার পাশাপাশি চাই নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তার অকাট্য নিশ্চয়তা। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীই এই নিশ্চয়তার প্রধান ভরসা বলে আমি মনে করি। কারণ, বাংলাদেশের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালে তাদের ভূমিকার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের ভূমিকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে খুবই উচ্চভাবে মূল্যায়ন করেছিল।
কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি আরো ভিন্ন। দেশ একটি দীর্ঘ স্বৈরাচারী শাসনের অবসান প্রত্যক্ষ করেছে, যার পর রাজনৈতিক উত্তাপ, জনমনে অনিশ্চয়তা এবং সাংবিধানিক পুনর্গঠন-সব মিলিয়ে দেশের প্রত্যাশা ও দায়িত্ব অনেক বেশি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ উত্তাপ, এসবই নির্বাচনি পরিবেশকে জটিল করে তোলে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাহিনী শুধু নিরাপত্তা নয়, জনমনে আস্থা পুনর্নির্মাণের কাজও করে সশস্ত্র থাকে। বর্তমান বিশ্বে 'ইনফরমেশন ওয়ারফেয়ার' যেমন বাস্তব হুমকি, তেমনি স্থলনিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধও গুরুত্বপূর্ণ। সূত্রমতে, সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই এসব ক্ষেত্রে নজরদারি জোরদার করেছে।
বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত সত্য হলো, যে দেশে সামরিক বাহিনী পেশাদার থাকে, সে দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্ত থাকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা ধরে রেখেছে। এ কারণেই এ দেশের মানুষ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখে, সংকটে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ও তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীল আচরণ করেছে, যা এই নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাষ্ট্রের জন্য প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
শেষ কথা হলো, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শুধু একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি নতুন সূচনা। এই নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে, সে দায়িত্বের বড় অংশই সশস্ত্র বাহিনীর কাঁধে। জাতি আশা করছে, সশস্ত্র বাহিনী ঐতিহ্যগতভাবেই পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা ও আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বলা যায়-আগামী নির্বাচনকে সফল করতে সশস্ত্র বাহিনীই এই মুহূর্তে জাতির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি এবং মূল ভরসা।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক