ঢাকা শহরের মানুষকে এখন সকালে বাইরে বের হওয়ার আগে খোঁজ নিতে হয় কোন কোন সড়কে আন্দোলন হচ্ছে। কোন কোন সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। সেই অবরোধের ফলে শহরে যানজটের অবস্থা কেমন।
দিন কয়েক আগেই একজন পরিচিত রসিকতা করে বলছিলেন, এখন সংবাদমাধ্যমের উচিত ট্রাফিক অ্যালার্টের মতো ঢাকা শহরের কোন সড়কে কখন কী আন্দোলন হবে— সেটি আগেভাগে নাগরিকদের জানিয়ে দেওয়া। তাহলে তারা সেভাবে কাজের পরিকল্পনা নিতে পারবেন।
সত্যি সত্যিই সেইটা কাজটি হলো। বৃহস্পতিবার (২২ মে) একটি জাতীয় দৈনিক তাদের অনলাইন ভার্সনে ‘আজ ঢাকায় কোথায় কী’ শিরোনামে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করেছে, যেখানে গ্রাফিক্যাল প্রেজেন্টেশন দিয়ে লেখা হয়েছে: আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে নগর ভবন (ডিএসসিসি), হাইকোর্ট এলাকা, মৎস্য ভবন ও কাকরাইলে ইশরাক সমর্থকদের সড়ক অবরোধ। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড় ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে সাম্য হত্যা মামলার তদন্তে গাফিলতির প্রতিবাদে ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি। বিকেল ৪.৩০ যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির বিক্ষোভ মিছিল।’
গত বুধবার (২১ মে) সকালে ঢাকার একটি বড় হাসপাতালের একজন চিকিৎসক ফেইসবুকে লিখেছিলেন: ‘ঢাকা শহরে আজকে চারটা আন্দোলন চলছে চার জায়গায়। কেউ খুব প্রয়োজন ছাড়া বের হবেন না।’ তার ওই পোস্টের নিচে অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতা জানিয়ে কমেন্ট করেন। কয়েকটা এরকম:
১. শাহবাগ থেকে রওনা হয়েছিলাম। জ্যামে বসে থাকতে থাকতে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
২. রাস্তায় বের হয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. বের হয়ে ফেঁসে গেছি!
৪. দুপুরে বের হয়ে ধরা খাইছি, গাড়ি ছেড়ে হেঁটে যাইতে যাইতে শুনি পাবলিক ধুমসে গাইল্যাইতাছে।
৫. এদের জন্য কোনো কাজ করতে পারছি না। প্রতিদিনই নাটক। রবিবার থেকে আজকে পুরা উইক শেষ। আজকেও যেতে পারবো না।
৬. ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলাম, আজকে আর খুলছি না।
৭. এ এক শান্তিময় মগের মুল্লুক।
৮. একটা অ্যাপস দরকার কোথায় কখন কার আন্দোলন চলছে তার নিউজ থাকবে তাতে। সে নোটিফিকেশন পাঠাবে সময়মতো।
মিছিলের নগরী
একসময় বলা হতো, ঢাকা হচ্ছে মসজিদের শহর। তারপর বলা হতো ঢাকা রিকশার শহর। কখনো বলা হয়, ঢাকায় টাকা ওড়ে। অতএব ঢাকা টাকার শহর। এরকম নানাভাবে ঢাকাকে বর্ণনা করা হয়। অনেকে চারশো বছরের পুরোনো এই শহরকে তিলোত্তমাও বলে থাকেন। যদিও কোন অর্থে ঢাকা তিলোত্তমা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এইসব ছাপিয়ে ঢাকা একসময় হয়ে উঠলো দূষিত বাতাসের শহর। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা বরাবরই শীর্ষে থাকে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনেও বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা শীর্ষে রয়েছে বলে জানানো হয়। ওই প্রতিবেদনে ঢাকার স্কোর ৫৪১। অর্থাৎ এখানকার বাতাসের মান নাগরিকদের জন্য ‘খুবই ঝুঁকিপূর্ণ’। পাশাপাশি তালিকায় ২৭১ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভারতের কলকাতা। এছাড়া ২৬১ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে ভারতের রাজধানী দিল্লী।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকায় বায়ুমান নিয়ে কাজ করেন অনেক বছর ধরে। তার সঙ্গে যখন ব্যক্তিগত আলাপচারিতা হয় এবং তিনি ঢাকার বাতাস সম্পর্কে যেসব কথা বলেন, তা শোনার পরে নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখি যে, আদৌ বেঁচে আছি কিনা। কারণ এরকম একটি শহরে বছরের পর বছর ধরে বসবাস করার পরেও আসলে বেঁচে আছি কী করে— সেটাই আশ্চর্যের।
ঢাকা আসলে যে কীসের শহর, তা এক কথায় বলা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে গণঅভ্যুত্থানের মু্খে গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ঢাকা মূলত পরিণত হয়েছে মিছিলের শহরে। দাবি আদায়ের শহরে।আন্দোলনের শহরে। দুর্জনের ভাষায়, ‘আন্দোলন নাটক নাটক খেলার শহরে।’
৯ মাসে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন!
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, গত ৯ মাসে ঢাকা শহরে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে। আর এই মুহূর্তে ঢাকায় পাঁচটির বেশি পক্ষ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে আছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। সে হিসেবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়ে পাঁচ শতাধিক আন্দোলন হয়েছে ঢাকার বুকে।
গত বছরের ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে ঢাকা শহরে অটোরিকশার চালুর দাবি; শিক্ষার্থীদের অটোপাস; আনসারদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো; চাকরিচ্যুত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের পুনর্বহাল; বিডিআর বিদ্রোহে কারাবন্দি সদস্যদের মুক্তি, ক্ষতিপূরণ ও চাকরিতে পুনর্বহাল; নিয়োগ বঞ্চিত বিসিএস ক্যাডারদের নিয়োগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজ পৃথকীকরণ এবং স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠন; এবতেদায়ী শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি; সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে। এছাড়া পলিটেকনিক্যালের শিক্ষার্থীদের অবরোধ, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ভাতা বৃদ্ধির আন্দোলন, রেলের কর্মচারীদের আন্দোলনও হয়েছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারি থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নামেন। তাদের প্রধান অসন্তোষের কারণ, পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়া, চাকরি স্থায়ী না করা। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে মাঠে নামেন।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আয়োজনে আন্দোলন শেষ না হতেই ডিপ্লোমা ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্সকে স্নাতক সমমানের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে মাঠে নামেন নার্সিংয়ের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে রাজধানীর কাকরাইল মোড় অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। যমুনার দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয় পুলিশের। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। ওই কর্মসূচিকে ঘিরে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। আন্দোলন রূপ নিয়ে ভিন্ন দিক। অবশেষে শুক্রবার তাদের দাবি মেনে নেওয়ায় গণঅনশন ভেঙে ক্লাসে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা। এর মাঝে ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে ‘মার্চ টু গাজা’ কর্মসূচিতেও মানুষের ঢল নামে।
সবশেষ গত ১৮ মে একদিনে রাজধানী ঢাকায় আটটি বড় বড় আন্দোলন কর্মসূচি হয়, যাতে নাগরিকদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। এদিন চাকরিচ্যুত সেনাসদস্যরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে সেনাসদর থেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে এলেও তারা দাবি পূরণ না হওয়ার অজুহাতে তাদের গাড়ির নিচে শুয়ে পড়েন। পরে লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়।
একই দিনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা করাতে চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ করেন তার অনুসারীরা। সচিবালয়ের সামনে থেকে নগর ভবন এবং আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। পরদিন একই দাবিতে পালন করা হয় ব্লকেড কর্মসূচি। বৃহস্পতিবার ইশরাককে শপথ পড়াতে বাধা নেই বলে হাইকোর্টের রায় আসা পর্যন্ত কাকরাইল ও মৎস্য ভবন এলাকায় বিক্ষোভ করেন ইশরাকের সমর্থকরা। উপরন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়ায় কার্যত অচল হয়ে পড়ে নগর ভবন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের নাগরিক সেবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলালয়ের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা সাম্য হত্যার বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘেরাও, শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
একই দিন বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের ঘোষণা না দিলে দেশ অচলের ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন করেন শ্রমিকরা। অপরদিকে শেয়ারবাজারের অব্যাহত পতনের প্রতিবাদে কাফনের কাপড় নিয়ে মিছিল করেন বিনিয়োগকারীরা। হাইকোর্টের মাজার গেটের সামনে একই দিনে বিক্ষোভ করেন পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষার্থীরা।
কেন এই পরিস্থিতি?
কয়েকটি কারণে ঢাকা শহর আন্দোলন বা মিছিল অথবা দাবি আদায়ের শহরে পরিণত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। যেমন:
১. সবাই হয়তো মনে করছে, যেহেতু একটি বড় অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি বিরাট শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, অতএব তাদের দাবি আদায়ের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। যেহেতু এখন কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় নেই বা যারা ক্ষমতায় আছে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বা পক্ষপাত নেই, ফলে দাবি নিয়ে রাজপথে নামলে সরকার তাদের দাবি পূরণে সচেষ্ট হবে।
২. বিগত সরকারের আমলেও দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ রাজপথে নেমেছে। কিন্তু সরকারের সমর্থন নেই— এমন আন্দোলনগুলো সাধারণত সরকার কঠোর হাতে দমন করেছে। সেই পক্ষগুলোই হয়তো এখন ভাবছে যে, অতীতের সরকারের মতো তারা দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে নামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মার খাবে না। শুরুর দিকে এই ধারণাটি ঠিক ছিল। পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর সেভাবে চড়াও হয়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল যে, পুলিশ ঠিকই আগের স্টাইলেই আন্দোলন দমন করছে।
৩. শিক্ষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন পক্ষের অনেক যৌক্তিক চাওয়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। অনেকেই মনে করেন তারা বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার। সেসব যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে তারা সংগঠিত হয়েছেন।
৪. রাজনৈতিক কারণে যারা মাঠ দখলে রাখতে চায়, তারাও বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে রাস্তায় থাকতে পারে বা বিভিন্ন বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীকে তারা আন্দোলনে নামার জন্য উৎসাহিত করতে পারে।
৫. সরকার সমর্থিত অনেক গ্রুপও আন্দোলনের নামে মাঠে থাকতে পারে, যাতে সরকারবিরোধী শক্তিসমূহ নির্বাচন বা অন্য কোনো ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলে মোকাবিলা করা যায়।
৬. অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রতি সংবেদনশীল কোনো পক্ষ বা আওয়ামী লীগের পরোক্ষ সমর্থনেও কোনো কোনো গ্রুপ মাঠে নামতে পারে— যাতে তারা দেশে ও দেশের বাইরে এটা বলতে পারে যে, সরকার ৯ মাসেও দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
এর বাইরে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে কারণ যাই হোক, সরকার কীভাবে এসব আন্দোলন মোকাবিলা করছে; কোন পক্ষের সঙ্গে কী আচরণ করছে— সেটি দিয়ে যেমন সরকারের সক্ষমতা বোঝা যায়, তেমনি বিশেষ কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের পক্ষপাত আছে কি না, সেটিও বোঝা যায়।
আন্দোলনের প্রভাব
১. আন্দোলন মানেই মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ। বিশেষ করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো সড়কে বা মোড় অবরোধ করা হলে তার ফলে ওই এলাকায় যে তীব্র যানজট তৈরি হয়, তার প্রভাব পড়ে আশপাশের সকল সড়কে, অলি-গলিতে এবং ধীরে ধীরে সেই ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে। কেননা, সবাই তখন বিকল্প পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়।
২. যানজটের কারণে মানুষের প্রচুর কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। তিরিশ মিনিটের পথ যেতে অনেক সময় দুই ঘণ্টা বা তারও বেশি লেগে যায়। মানুষ সঠিক সময়ে কর্মস্থলে বা কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে পারে না।
৩. শাহবাগ মোড়ে দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বারডেম হাসপাতাল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। অসংখ্য রোগীর আত্মীয়-স্বজনরা যান। ফলে শাহবাগ মোড়ে যখন অবরোধ হয়, তার প্রধান ভিকটিম হন এই মানুষগুলো। অনেক সময় চিকিৎসক ও হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীরাও সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না। তাতে রোগীদের সেবা ব্যাহত হয়।
৪. মিছিল, সমাবেশ ও অবরোধের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়— যা তার মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মানুষ অল্পতেই মেজাজ হারায়। মানুষের শরীর ও মনে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে।
৫. গত ৯ মাসে ঢাকা শহরে যত আন্দোলন হয়েছে বা এখনও হচ্ছে, সেগুলো আন্দোলনকারীদের অবস্থানে বসে দেখলে যৌক্তিক মনে হবে। যারা বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত— তাদের আন্দোলনগুলোর একটা মানবিক দিকও আছে। কিন্তু এইসব আন্দোলন কর্মসূচি যখন নাগরিক দুর্ভোগ তৈরি করে, তখন মানুষ এর সমালোচনা করে এবং সেই যৌক্তিক আন্দোলনও প্রশ্নের মুখে পড়ে।
৬. কিছু কিছু দাবি অযৌক্তিক। যেমন অটোপাস। সবশেষ এই দাবিতে হামলার শিকার হয়েছেন স্বয়ং জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয়ের উপাচার্য। এগুলোকে দাবি না বলে মামা বাড়ির আবদার বলা ভালো। রাষ্ট্র বা সরকার এইসব দাবি কেন মেনে নেবে? সুতরাং এই ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে যারা মাঠে নামেন এবং জনদুর্ভোগ তৈরি করেন, তার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারীদের ইনটেনশন বা উদ্দেশ্য নিয়েও জনমেন প্রশ্ন তৈরি হয়।
৪. আন্দোলন মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চুপ থাকলে মানুষ বিরক্ত হয়। আবার হার্ডলাইনে গেলেও তার সমালোচনা করে। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের পরে পুলিশের মনোবল যেভাবে ভেঙে গেছে এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই বাহিনী যেভাবে দুর্বল হয়েছে, তাতে তাদের পক্ষে যেকোনো আন্দোলন মোকাবিলা করা কঠিন। ফলে সাম্প্রতিক আন্দোলনে পুলিশের সক্ষমতার প্রশ্নটিও সামনে এসেছে।
৫. একটার পর একটা দাবি নিয়ে বিভিন্ন দল, সংগঠন ও গোষ্ঠী যখন রাস্তায় নামে, তখন সরকারের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়। মানুষ মনে করে, সরকার দুর্বল। কেননা তারা আন্দোলন মোকাবিলা করতে পারছে না। সরকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে ব্যর্থ।
৬. সব দাবি দাওয়া পূরণের এখতিয়ার যে অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বা সব দাবি যে তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ করা যায় না, সেটি অনেক সময় আন্দোলনকারীরা বুঝতে চান না। তার ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। তার দৈনন্দিন কাজ যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি তার জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিও বাধাগ্রস্ত হয়।
সমাধান কী
দাবি আদায়ে মিছিল সমাবেশ নাগরিক অধিকার। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
তার মানে যেকোনো ইস্যুতে নাগরিকরা জনসভা বা মিছিল করতে পারবেন। কিন্তু তাকে কিছু শর্ত মানতে হবে। যেমন তাকে শৃঙ্খলা মানতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় রাখতে হবে। যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ মানতে হবে। সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিতে হবে নিরস্ত্র অবস্থায়।
প্রশ্ন হলো, যে শাহবাগ মোড়ে দেশের অন্যতম প্রধান দুটি হাসপাতাল, সেখানে ব্লকেড বা অবরোধ করার ফলে জনস্বাস্থ্যের জন্য যে হুমকি তৈরি করা হয়, সেটি কি সংবিধানের লঙ্ঘন নয়? আরেকটি শর্ত হলো, যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ। এই যুক্তিটা ঠিক করে আসলে রাষ্ট্র। যেমন পুলিশ কোনো নোটিশ দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় মিছিল, সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। গত মার্চে যখন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস ঢাকায় এলেন তখন সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও পাশের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মোড় ও মিন্টো রোডে সব ধরনের সভা-সমাবেশ গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ডিএমপি। কিন্তু এই দেখা গেলো এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন আন্দোলন চালিয়ে গেছে। সবশেষ আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়। তার মানে কোনো দল বা সংগঠন যখন রাষ্ট্রের যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ উপেক্ষা করে মিছিল বা সমাবেশ করে, সেটিও কি একঅর্থে সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন নয়?
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী একাধিকবার অনুরোধ করেছেন শাহবাগ মোড় অবরোধ না করে কাছেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে যাতে লোকেরা সমাবেশ করে। কিন্তু তার এই কথা কেউ গায়ে মাখে না। কারণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে মিছিল সমাবেশ করলে তাতে জনভোগান্তি তৈরি হবে না। যতক্ষণ না ভোগান্তি হয়, ভাঙচুর ও সংঘাত হয়— রাষ্ট্র ততক্ষণ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে না। যাদের মিছিলের আওয়াজ যত বড়, যাদের ভাঙচুর ও ভোগান্তি সৃষ্টির ক্ষমতা যত বেশি, রাষ্ট্র তাদের তত বেশি ‘ভয়’ পায়। ফলে দাবি আদায়ে এই ভয় দেখানো তথা জনভোগান্তি তৈরির কৌশল যতদিন থাকবে, ততদিন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ধারণাটি কাগজে-কলমেই থাকবে।
যদি দাবি-দাওয়া পেশের জন্য ঢাকা শহরে একটি স্থান (যেমন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নির্ধারণ করে দিয়ে সরকার এর বাইরে অন্য কোথাও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেয় এবং যৌক্তিক দাবি হলে, সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় ও তাদের শক্তি যত কমই হোক না কেন, সরকার তা মেনে নেবে— এমন একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়, তাহলে আন্দোলন ও মিছিল সমাবেশের নামে জনভোগান্তির হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব।