একজন সাধারণ মানুষ মহৎ হয়ে ওঠেন তার কর্মগুণে। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা তাদের কর্ম, ধ্যান-জ্ঞান, অর্জন— সবকিছু উৎসর্গ করে গেছেন মানুষের কল্যাণে। নিঃস্বার্থভাবে করে গেছেন মানুষের উপকার। তাদের অনেকেই ইতিহাসে চির অমর। আবার অনেকেই নাম-পরিচয়হীন হয়ে স্মৃতির আড়ালে রয়েছেন। পৃথিবী ধন্য হয়েছে এসব মহান হৃদয়ের মানুষদের জন্য।

এমনই একজন হলেন বাংলাদেশের মহান চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, যিনি বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা।

হৃদয়বান এই চিকিৎসক ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। ভারতের মুর্শিদাবাদে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯১১ সালে। এমবিবিএিস সম্পন্ন করেন ১৯৩৮ সালে। এমআরসিপি ডিগ্রি নেন ১৯৪৯ সালে। লেখাপড়া, শৃঙ্খলা, মানবসেবা আর দেশপ্রেমে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ছিলেন মেডিসিন ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসক।

তিনি সব সময় বলতেন, ‘ডায়াবেটিস আছে, এমন দরিদ্র ব্যক্তিরাও যেন না খেয়ে, চাকরি ও চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়।’

ধনী-দরিদ্র, বিশেষত যারা অসহায়, তারা কেউ যেন ডায়াবেটিসের চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়। এ উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন। পরে ১৯৫৭ সালে সেগুনবাগিচায় প্রতিষ্ঠা করেন আউটডোরে রোগী দেখার ব্যবস্থা।

শাহবাগে ১৯৮০ সালে ডা. ইব্রাহিম স্থানান্তর করেন তার ‘বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামের সেন্টারটি। এই সেন্টারটিই বর্তমানের বারডেম হাসপাতাল।

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ডায়াবেটিক সেন্টারটি ১৯৮২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ডায়াবেটিস হাসপাতালে পরিণত হয় এবং আরো বড় ও ব্যাপক পরিসরে ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও প্রতিরোধ শুরুর জন্য কাজ করতে থাকে, যা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ছিল ডায়াবেটিসের জন্য প্রথম কোনো প্রতিষ্ঠান।

তিনি বিশ্বাস করতে যে, তার ডায়াবেটিসের হাসপাতাল উচ্চমানের ইট, পাথর আর যন্ত্রপাতিতে উন্নতির খাতায় নাম লেখাবে। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য চাই দক্ষ ও হৃদয়বান কর্মী, যারা নিবেদিত প্রাণ হয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করবেন। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন এমনই একজন মানুষ, যিনি তার সারাটি জীবন, ধ্যান-জ্ঞান উৎসর্গ করে গেছেন মানুষের কল্যাণে, দরিদ্র রোগীদের সেবা করার জন্য। রোগীদের জন্য ছিল তার অকল্পনীয় ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ। বিশেষত দরিদ্র, অসহায় রোগীদের জন্য ছিল তার অকল্পনীয় মায়া ও মমত্ববোধ।

ঢাকার সেগুনবাগিচায় গড়ে তোলা তার সেই ছোট্ট সেন্টারটিই আজ পৃথিবীর বিখ্যাত হাসপাতাল। বর্তমানে এখানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীসহ অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এটি প্রায় ৭০০ বেডের হাসপাতাল। এই হাসপাতালে একই সঙ্গে চিকিৎসা, অপারেশন ও গবেষণা হয়।

বারডেম- এর সম্পূর্ণ নাম হলো বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস।

অধ্যাপক ডা. ইব্রাহিম তার জীবনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন বিভিন্ন পদবিতে সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করে। তার মূল্যবান অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৮৪ সালে দেশের সকল চিকিৎসকদের মধ্যে প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করেন।

সেগুনবাগিচায় মাত্র ২৩ জন রোগী নিয়ে টিনের তৈরি ঘরে শুরু হয়েছিল দরিদ্র ডায়াবেটিক রোগীদের চিকিৎসা। তখন সেগুনবাগিচায় কোনো ইনডোর ছিল না। অর্থাৎ রোগীদের ভর্তি করে রাখা যেত না। ভর্তি করার জন্য রোগীদের অন্য কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হতো।

অধ্যাপক ডা. ইব্রাহিম সেগুনবাগিচার হাসপাতালে ডায়াবেটিসের রোগীদের প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা করতেন। ধনী রোগীদের কাছ থেকেও টাকা নিতেন না। কেউ স্বেচ্ছায় বিশেষত কোনো ধনী ব্যক্তি আর্থিক সহযোগিতা দিলে তিনি তার সেগুনবাগিচার হাসপাতালের জন্য গ্রহণ করতেন।

সমাজকর্মী, জনহিতৈষী কাজ ভালোবাসেন, এমন ব্যক্তি ও সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন বারডেমের মানোন্নয়নের জন্য, তার কাজে সহযোগিতার জন্য এবং তিনি তার হাসপাতালের জন্য সরকারি পর্যায় থেকেও সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

গবেষণা ও জরিপ করে দেখা গেছে, এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল যে একই সঙ্গে এবং এক ছাদের নিচে এত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হয়, যা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও নেই।

একজন অধ্যাপক ইব্রাহিম শুধু বাংলাদেশে নয়, পুরো পৃথিবীতে চিকিৎসক এবং এত বড় হাসপাতালের কর্ণধার হিসেবে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তিনি ১৯৭০ সালে ‘স্বাস্থ্য সচিবালয় ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের’ প্রধান দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সফল চিকিৎসক, শিক্ষক, সৎ ও আদর্শবান মানুষ। তিনি সময়কে যথেষ্ট মূল্য দিতেন।

বারডেমের চিকিৎসকদের দক্ষ করার জন্য চালু করেছিলেন স্নাতকোত্তর পর্যায়ের বিভিন্ন কোর্স; যা এখন পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে চলছে। তার নিয়মনীতি মেনে এখন পর্যন্ত পরিচালিত হচ্ছে বারডেম। তার স্বপ্ন পূরণের প্রয়াসে, দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা আরো বাড়ানোর জন্য ২০০২ সাল থেকে চালু হয়েছে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ।

বর্তমানে নার্সিং কালেজও সফলভাবে চলছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক গবেষক বারডেমে আসেন গবেষণা করার জন্য। ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণা করেন।

অধ্যাপক ডা. ইব্রাহিম মারা যান ঢাকাতে, ১৯৮৯ সালে। তার বারডেম হাসপাতালের স্ত্রী প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, শিশু বিভাগ এবং হরমোন ও ডায়াবেটিস বিভাগ বর্তমানে স্থানান্তরিত রয়েছে সেগুনবাগিচায়, শাহবাগে স্থান সংকুলানের অভাবে।

ডা. ফারহানা মোবিন: চিকিৎসক ও লেখক
farhanamobin31@yahoo.com

লেখকদের উন্মুক্ত প্লাটফর্ম হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে মুক্তকথা বিভাগটি। পরিবর্তনের সম্পাদকীয় নীতি এ লেখাগুলোতে সরাসরি প্রতিফলিত হয় না।





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews