জনগণের পারসেপশন কিংবা এন্টিসিপেশন এক বিষয়। আর গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে তা আরেক বিষয়। সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ীই গণমাধ্যম কোনো বিষয়ে বিমূর্ত কল্পনা বা পূর্বানুমান ধরে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে না। করলেও তাতে সংশয়চিহ্ন বা প্রশ্নচিহ্ন রাখতে হয়। সাংবাদিকদের মতাদর্শ দূরে রেখে ঘটনাকে ‘অ্যাজ ইট ইজ’ বর্ণনা করতে হয়। সেটাই হলো বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা। বস্তুনিষ্ঠতার পেছনে না ছুটলে ‘বায়াসড’ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং সেই বিচ্যুতির কারণে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র প্রভাব সচল হয়ে ওঠে।
এই লেখার শেষ পর্বে আমরা চলমান বিতর্কে গণমাধ্যমের দায় ও ভূমিকার ব্যাপারে অনুসন্ধান করব। একই সঙ্গে, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মতামত তুলে ধরে চলমান অমীমাংসা থেকে একটা মীমাংসার খোঁজ করতে চাইব।
বিমূর্ত কল্পনা কিংবা পূর্বানুমান: গণমাধ্যম কি ‘বায়াসড’ হতে পারে?
জামুকা সংক্রান্ত এই অধ্যাদেশ যে বিতর্কিত হয়ে উঠল, তার অন্যতম কারণ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকাকে দায় দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশের কতিপয় সংবাদমাধ্যম (অর্থাৎ সবাই নয়) এই অধ্যাদেশের ব্যাখ্যা এমনভাবে হাজির করেছে, যা থেকে মানুষ ভড়কে গিয়ে সত্যই মনে করেছে বঙ্গবন্ধুসহ চারশতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বোধ হয় কেড়ে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার! আর বিভ্রান্তি ও বিতর্ক যা ছড়ানোর তা এতটাই দ্রুতলয়ে ঘটেছে যে, দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ‘কল্যাণে’ বিদেশি সংবাদমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।
তবে, অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জামুকা সংক্রান্ত এই অধ্যাদেশের ব্যাপারে হুট করেই সংবাদমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করছে না। গুগলের সূত্র বলছে, দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত অধ্যাদেশ যখন খসড়া আকারে ছিল, তখন থেকেই ধারাবাহিকভাবে এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে এবং প্রায় সবগুলোই লিখেছে যে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। তখন এ বিষয়ে বিতর্ক তো দূরের কথা, তেমন আলোচনাও সর্বমহলে হয়নি।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর, বিজয় দিবসে দৈনিক কালের কণ্ঠ ‘বদলে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা!’ শিরোনামে তাদের প্রধান সংবাদ প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের প্রকাশিত মন্তব্য ছিল, ‘জামুকার আইনে অ্যাবসুলেটলি কিছু দলীয় ন্যারেটিভ আছে। এটা নৈর্ব্যক্তিক একটা অবস্থান থেকে হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। রণাঙ্গনে সরাসরি সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন যারা, তাঁরা চান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হতে। আর মুক্তিযুদ্ধে নানান সহায়ক শক্তি ছিল। ওখানে (মুক্তিযোদ্ধার বিদ্যমান সংজ্ঞায়) ঢালাওভাবে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় নিয়ে আসা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এটা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সে জন্য আমরা যারা যেভাবে ভূমিকা রেখেছেন ওইভাবেই উল্লেখ করতে চাই।’
কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদনে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্নার মন্তব্যও প্রকাশিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমি আইনটা দেখে পরে এ সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাই, এখনই নয়। তবে, আমি বিশ্বাস করি, রাজাকারসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র ছিল না। তা না হলে সাড়ে চার কোটি মানুষই হাতে অস্ত্র তুলে নিত। যুদ্ধ সহায়করাও মুক্তিযোদ্ধা।’
গত ২১ মার্চ দৈনিক সমকালের অন্যতম প্রধান শিরোনাম ছিল ‘মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থাকছে না শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার’। প্রতিবেদনটি তারা প্রকাশ করে অধ্যাদেশের চূড়ান্ত খসড়ার ওপর ভিত্তি করে। ওই প্রতিবেদনে ইমিরেটাস অধ্যাপক ও দেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্যও প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ইতিহাসের সত্যটা জানি। কোনো আইন বদল করে কারও অবদান বদলে দেওয়া যাবে না। এটি করার প্রয়োজন নেই। এগুলো অপ্রয়োজনীয়, অপচয়মূলক কাজ।’
এছাড়া, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামালের মন্তব্যও আছে ওই প্রতিবেদনে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধ শুধু একটি কনভেনশনাল সামরিক যুদ্ধ ছিল না। একই সঙ্গে এর অন্যতম মূল অংশ ছিল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক। সেই সময়কার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুলত্রুটি সংশোধন অবশ্যই কাম্য। তবে ঢালাওভাবে মুক্তিযুদ্ধকালীন এমএনএ বা এমপিএ, গণপরিষদ সদস্যসহ সবার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় বাতিল করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।’
সমকাল তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার মতামতও তুলে ধরে, ‘রাজনীতিবিদরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে থাকবেন না। বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল তারাই থাকবেন, যারা রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। অন্য সবার পরিচয় হবে “মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী”। এখানে কারও মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে না। সবার সুযোগ-সুবিধা একই থাকবে।’
গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘কেউ হবেন মুক্তিযোদ্ধা, কেউ সহযোগী’। সে প্রতিবেদনেও পরিষ্কার ইঙ্গিত ছিল অধ্যাদেশে কী উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। প্রতিবেদককে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা তখন বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ সরকারে (মুজিবনগর সরকার) যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশে প্রথমে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী করার চিন্তা ছিল। এখন এটি সংশোধন করা হচ্ছে।’
গত ১৫ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অধ্যাদেশটিকে অনুমোদন পেলেও, তাতে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং তখন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর খসড়া লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক প্রথম আলো গত ১৬ মে (পৃষ্ঠা ২) ‘মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধ্যাদেশ শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরীর বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়, ‘উপদেষ্টা পরিষদের সভায় মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় কিছু পরিবর্তন আনতে বলা হয়েছে। কী ধরনের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, জানতে চাইলে সচিব বলেন, বড় কিছু না। ছোটখাটো পরিবর্তন।’ এই প্রতিবেদনও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সহযোগীর প্রসঙ্গটি এসেছিল।
এই প্রমাণগুলোর অর্থ হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ নামক একটি টার্ম যে অধ্যাদেশে যুক্ত হতে যাচ্ছে, তা আমাদের গণমাধ্যম আগেই জানিয়েছিল। ফলে গণমাধ্যমের তরফে অতিরঞ্জন আদতে ছিলই না, যা ছিল তা হলো পূর্বানুমানসমেত প্রস্তুতি। আর অধ্যাদেশ জারির পর দেখা গেল, পরিবর্তনটা মোটেও ‘ছোটখাটো’ নয়, বরং ‘বড়’ই এবং এত বড় যে, পূর্বানুমানই সত্যে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং তা দেশব্যাপী বিতর্ক উসকে দেয়। গত ৬ মাসে বিতর্ক হয়নি, এখন হচ্ছে, এর একটাই যুক্তিসঙ্গত কারণ হতে পারে—আগে ছিল খসড়া, এখন হয়েছে চূড়ান্ত অধ্যাদেশ এবং তা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে।
বিরাজনীতিকরণ ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অধ্যাদেশ
আমরা দেখছি, ওপরে উল্লিখিত প্রত্যেকটি প্রতিবেদনেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের মন্তব্য আছে এবং মন্তব্যগুলো মিলিয়ে পাঠ করলে দেখা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনীতিকদের প্রতি তার এক ধরনের ব্রাত্যভাব কাজ করছে।
তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাহসী ও আত্মঘাতী অভিযান নৌ-সেক্টর (১০ নম্বর সেক্টর) পরিচালিত ‘অপারেশন জ্যাকপটে’র একজন কমান্ডো ছিলেন তিনি। সেই সাহসিকতার জন্য তিনি বীর প্রতীক খেতাব পান। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি স্মৃতিকথাও লিখেছেন। তিনি তো বিলক্ষণ জানেন, নৌ-সেক্টরের কোনো সেক্টর কমান্ডার না থাকায় এটি সরাসরি মুজিবনগর হেডকোয়ার্টারের অধীনে ছিল। মানে, রাজনৈতিক সরকারের নির্দেশেই তারা পরিচালিত হতেন। এখন সেই রাজনীতিকদের প্রতিই তার এমন বিরাজনৈতিক মনোভাব কেন!
শুধু তাই নয়, আমরা দেখছি, স্বীকৃতির বিষয়ে আলাপগুলো যেভাবে উঠে এসেছে, তা খুব একটা অবজেক্টিভ বা নৈর্ব্যক্তিক নয়, রেশিওন্যাল তো নয়ই। একেক সময় একেকটি মতের পালাবদল হচ্ছে। এভিডেন্স-বেসড কাজের ক্ষেত্রে যখন কমন ডাটা হাজির আছে, তখন সেই ডাটা নিশ্চয়ই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফল দিতে পারে না। কাজটা সায়েন্টিফিক পদ্ধতিতে করা জরুরি ছিল। কিন্তু, সরকার সে পথে হাঁটল না! আবেগ ও বিরাজনীতিকরণের মনোভাব থেকে নতুন এক রাজনৈতিক কৌশলের জন্ম দিয়েছেন তারা, যা বিতর্ককে আরও বেশি ত্বরান্বিত করেছে।
এখন এই বিতর্ক এতটাই মহীরুহ হয়ে গেছে যে, অনেকটা বাধ্য হয়েই পরের দিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে সংবাদমাধ্যমের কাছে ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে। তিনি বলেছেন: “বাহাত্তরেও এমন সংজ্ঞা ছিল। এটা পরিবর্তন করা হয়েছে ২০১৮ সালে ও ২০২২ সালে। এখন বাহাত্তরের সংজ্ঞাটা দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় রাখা। দেশের মানুষ জানে মুক্তিযুদ্ধ কারা করেছে। মুক্তিযুদ্ধটা যেন বিতর্কিত না হয় সে চেষ্টা করছি আমরা।” (বিডিনিউজটোয়েন্টিফরডটকম এবং প্রথম আলো)
আরো যা যা বলেছেন তিনি, তা নতুন কিছুই নয়। এগুলো আগেও বলেছেন। তাদের মত বদলের ক্রম তো আমরা দেখলামই। সেসব কি আমাদের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের কোনো বাণী দেয়? মনে যখন যা চাইল, তা করা আর বিজ্ঞানসম্মত যথাযথ পদ্ধতি অবলম্বন করা এক বিষয় নয়। যেমন: ‘বিবেচনা করা হচ্ছে’ কথাটা—এটা হিস্ট্রিক্যাল এভিডেন্সের প্রশ্নে ভয়ঙ্কর কথা, আবেগসর্বস্ব কথা, অবৈজ্ঞানিক কথা। এই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বনই এই অধ্যাদেশের প্রধান ব্যর্থতা।
দুঃখজনকভাবে, সেই ব্যর্থ ঢিলটা ভীমরুলের চাকে মানে মুক্তিযুদ্ধের গায়ে গিয়ে পড়েছে। আওয়ামীবিরোধী অবস্থান নেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান নেওয়া—দুটি ভিন্ন বিষয় এ দেশে। আগেও তা ছিল, এখনও তাই আছে। সরকার বুঝতে ভুল করে লেজে-গোবরে পাকিয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে এই অধ্যাদেশ আরও বেশি অবিজ্ঞানসম্মত হয়েছে এবং তার রেশিওন্যালিটিও হারিয়েছে।
আইনজীবীরা কী বলছেন আর কী বলছে বিএনপি?
আইনের ব্যাখ্যায় অবশ্যই আইনজীবীদের মতামত বেশি বেশি জানা প্রয়োজন। ওপরে আমরা সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার মতামত জেনেছি। এ অংশের শুরুতেই আমরা একজন বিএনপি নেতার মতামত জানব। কিন্তু, তার আগে একটি কথা বলার প্রয়োজন আছে।
অধ্যাদেশ প্রশ্নে বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন। বিষয়টা জরুরি। বিএনপি এদেশে স্পষ্টতই আওয়ামী লীগের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আমল মিলে তারা তিনবার ক্ষমতায় ছিল। এদেশে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মানে তো এসপার-ওসপার ব্যবধান। কিন্তু, বিএনপি এদেশের আদিতে আনা মুক্তিযোদ্ধার সরকারি সংজ্ঞা কখনও পরিবর্তন করেনি। কারণ, সীমাবদ্ধ যাই থাকুক, তারাও মুক্তিযোদ্ধাদেরই দল। ফলে, প্রতিবাদটা ন্যায্যই এবং এর মধ্যে কোনো আওয়ামীকরণ নেই।
তবে, দল হিসেবে বিএনপির তরফে এই অধ্যাদেশের ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নেই। তারা আছে নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচন তো জরুরিই। কিন্তু, এই অধ্যাদেশ সামনে এনে নির্বাচনি ন্যারেটিভ বদলানোর কোনো চেষ্টা তারা দেখতে পায় কি না, সেটাও তারা জনগণের কাছে স্পষ্ট করেনি। স্পষ্ট করলে হয়তো বোঝা যেত যে আওয়ামী লীগহীন ব্যাটল ফিল্ডে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ-কেন্দ্রিক কী ধরনের রাজনীতি করতে চাইছে। যাই হোক অধ্যাদেশের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীনের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির বক্তব্যও কি এমনই হবে?
তিনি বলেছেন, ‘মুজিবনগর সরকারের যারা মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় আছেন, গণপরিষদের সদস্য হিসেবে তাদের আবার “মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী”র স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার দুটি পরিচয় থাকার সুযোগ নেই। এটি বিভ্রান্তিকর। এগুলো সংসদে যখন আসবে, তখন অবশ্যই পর্যালোচনা হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা একটি দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাদের স্বীকৃতি বদল করার সুযোগ নেই। “মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী” শ্রেণি করাটা অপমানজনক।’ (দৈনিক সমকাল, ৫ জুন, ২০২৫)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, ‘এখন নতুন অধ্যাদেশে সংজ্ঞা যেটি দেওয়া হয়েছে, তা এককথায় বিভ্রান্তিকর। এগুলো দূর করার জন্য আরও ব্যাখ্যা অধ্যাদেশে দেওয়া উচিত ছিল। এটি নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের যথেষ্ট সুযোগ আছে।’ অন্যদিকে, ব্যারিস্টার আশরাফুল হাদী বলেছেন, ‘মুজিবনগর সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুই জায়গায় (দুই ধরনের সংজ্ঞায়) অন্তর্ভুক্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যেমন–ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সদের ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি তৈরির সুযোগ আছে। এ ধরনের অস্পষ্টতা অনভিপ্রেত। (দৈনিক সমকাল, ৫ জুন, ২০২৫)
অন্যদিকে, প্রথিতযশা আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক মনে করেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সহযোগী—দুটি ধারা তাদের ভূমিকাকে নিশ্চয়ই খাটো করেছে। অধ্যাদেশটি সমাজে অহেতুক প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি অধ্যাদেশ একটি সাময়িক আইন। সংবিধান অনুযায়ী এটি আগামী সংসদে বিল আকারে পাস হতে হবে। অতএব, সাময়িক সময়ের জন্য অধ্যাদেশ জারি করে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন তৈরি করা সঠিক বলে মনে হচ্ছে না।’ (দৈনিক সমকাল, ৫ জুন, ২০২৫)
ঠিক এ অংশে বিএনপির আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের কথা এজন্যই তুলেছি। নির্বাচন হওয়ার আগেই বিএনপির অবস্থা এমন যে তারা ক্ষমতায় চলে গেছে। ধরলাম, চলে গেছে। তাহলে, এই অধ্যাদেশ প্রশ্নে তাদের অবস্থানটা জাতির জন্য জানা জরুরি না? এই অধ্যাদেশকেই কি তারা আইনে পরিণত করতে চায় নাকি তাদের ভিন্নতর বক্তব্য আছে? বক্তব্য থাকলে নির্বাচনের আগেই সেগুলো খোলাসা করা উচিত তাদের।
তবুও, কাঠগড়ায় গণমাধ্যম!
এতটা ত্রুটিপূর্ণ অধ্যাদেশ হওয়ার পরও, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে সরকারের কয়েকজন কর্তাব্যক্তি যেভাবে কথা বলেছেন (প্রকারন্তরে শাসিয়েছেন), তা পরিষ্কার ক্ষমতা-চর্চার অপব্যবহার। গণমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করলে ব্যবস্থা নেওয়ার যে ফতোয়া তারা দিয়েছেন, তাতে বোঝার বাকি নেই যে, স্বাধীনতা শব্দটিকে তারা সীমায় বাধতে চান!
অথচ, এর আগে যখন গণমাধ্যম এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে, তখন তাদের কোনো হেলদোল ছিল না। এখন জনসাধারণ কথা বলতে শুরু করেছে বলে, সমালোচনা ও চাপ সৃষ্টি করেছে বলে, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন তারা! তারা দেখছেন না, তাদের আমলাতান্ত্রিক গদ্যভাষার যোগাযোগহীনতা ব্যাপক!
আমাদের শিক্ষিতজনের বাংলা গদ্যজ্ঞানের বলিহারি অবস্থার প্রসঙ্গ বাদ দিলেও, সরকারি দপ্তরের ভাষা প্রয়োগ নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ প্রশ্ন করার সুযোগ সব সময়ই থাকে। আর আজকের দিনেও দাপ্তরিক ভাষা বা গদ্য যে 'সাধু বাংলা', সেটাই আশ্চর্যের। বিশেষজ্ঞ না হলে এই বাংলা নিয়ন্ত্রণ করা যে অনেক কঠিন, সেটা বোঝার জন্য বোধহয় বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বরং এই দাপ্তরিক ভাষাবিধি ও গদ্যরূপ ঠিক করার দায়িত্ব নিতে পারেন।
যাই হোক, সরকারের দায়িত্বশীল এই কর্তারা কি এটুকু মানবেন যে, ওই সংবাদমাধ্যমগুলো চলমান বিতর্কটি উসকে না দিলে এই আইন এবং এখনকার সংশোধিত অধ্যাদেশের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো ধরাই পড়ত না আমজনতার চোখে?
তাহলে কী হবে একাত্তরের মীমাংসা?
একাত্তর নিয়ে ব্যবসা বন্ধের মীমাংসা চব্বিশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত আছে। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা না থাকলে, কোটা বাংলাদেশে এতটা ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হয়ে উঠত না। ভীষণরকম বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা থাকার কারণেই বরং মুক্তিযুদ্ধের অমর্যাদা হয়েছে। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবটি সম্মানজনক হওয়ার পরও এটি নিয়ে এত এত ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণ আর কিছুই না—অর্থযোগ ও প্রাপ্তিযোগ। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটিকে বিশেষ মর্যাদায় আসীন করে রাখলেই এই স্ট্যাটাস পাওয়ার জন্য আর এত দৌড়-ঝাঁপ করত না চেতনার ধ্বজাধারী অসাধুরা। তাতে মুক্তিযুদ্ধটাও বাণিজ্যিকীকরণ থেকে রেহাই পেত।
কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলো, আবার নতুন করে কোটার পুনরাবৃত্তি ঘটল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকেও সেই বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলার পাঁয়তারা করা হলো এবারের বাজেটে ‘বিশেষ সুবিধা’ দিয়ে, ‘জুলাইযোদ্ধা’ তকমায়। তাহলে আশির দশকে যারা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য লড়েছেন, জীবন দিয়েছেন এবং নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশকে পুনরায় গণতন্ত্রের পথে এনেছেন, তারাও বিশেষ সুবিধা চাইলে, রাষ্ট্র কী করবে? রাষ্ট্রকে এসব বুঝতে হবে। আদতে কেউই অর্থযোগ ও বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির জন্য লড়েনি—আটচল্লিশ থেকে একাত্তরেও না, আশি থেকে নব্বইয়েও না, চব্বিশেও না। যে কোনো অর্থযোগ ও প্রাপ্তিযোগের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে অবস্থান নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত লেখক ও ইতিহাস গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদের মতামত প্রণিধানযোগ্য। তার কথাগুলো গিলতে হয়তো কষ্ট হবে মুক্তিযুদ্ধ-বেনিয়াদের। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি যা বলেছেন, সেটাই আদতে একাত্তর সংক্রান্ত বাণিজ্যিকীকরণের প্রশ্নে চূড়ান্ত মীমাংসা ও সমাধান। তিনি গত ৫ জুন ফেইসবুকে লিখেছেন:
‘অনেক সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। আমিও তাদের একজন। আমি একাত্তরের ৩১ জুলাই অস্ত্র নিয়ে দেশে ঢুকেছিলাম। অথচ ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের পরে ভারত থেকে আসা লোকেরা রাইফেল হাতে পোজ নিয়ে ছবি তুলে দিব্বি ভাতা খেয়ে বেড়াচ্ছে। একটা সার্টিফিকেটের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে, এটা কখনো মাথায় আসেনি।
অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বছরের পর বছর গরিবের ট্যাক্সের টাকায় পেনশন নিচ্ছে। কয়েক বছর পরপর সরকার বদল হয় আর দলীয় বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা বদলায়। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।
আমার প্রস্তাব:
১. মুক্তিযোদ্ধা ভাতা অবিলম্বে বন্ধ করুন। কারণ এই ভাতার গন্ধেই ধান্দাবাজেরা জুটেছে।
২. জামুকা এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করুন। এরা টাকা খেয়ে অনেককে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে।
৩. দুর্নীতির আখড়া মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ভেঙে দিন এবং এই সংস্থার আয়ত্বে থাকা সকল বাণিজ্যিক স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান নিলাম ডেকে বেচে দিন।
আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ করেছি বিবেকের তাড়নায়। ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য নয়। যারা বেতন-ভাতা, পদ-পদোন্নতির জন্য যুদ্ধ করে, তাদের আমরা মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধা বলি।
৫৪ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায় যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।’
মহিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একমত হয়ে শুধু এটুকুই বলব, অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বিপ্রতীপ অবস্থানই থাকুক না কেন, আইন বা অধ্যাদেশের পেছনে না ছুটে তারা যদি সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকল্পে এই প্রস্তাবগুলো আমলে নেয়, তাহলে তাদের পাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধারও অভাব না।
শেষকথা
দীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়েছিল। এই রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিল মূলত গণসংগ্রাম। সেগুলোরই পথ ধরে জনগণ প্রস্তুত হচ্ছিল স্বাধীনতার জন্য। যে কারণে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছিল গণমানুষের অংশগ্রহণে এক মহাকাব্যিক জনযুদ্ধ। সেই জনযুদ্ধের প্রকৃত চরিত্রে আমাদের ইতিহাসকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, ব্যক্তিপূজা থেকে সরে আসা প্রয়োজন।
সেই বিবেচনায়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গঠন করিবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে’ কথাটির চেয়ে গণমানুষের সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা ছিল অধিক বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু, সংশোধিত অধ্যাদেশ যেন একটি অংশ ছাঁটতে গিয়ে, পুরো আকাঙ্ক্ষাটিকেই ছেঁটে ফেলতে চাইল। এজন্যই অধ্যাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ শব্দবন্ধ ভয়ঙ্কর রকম বৈষম্যমূলক, অপমানজনক এবং কাউকে কাউকে বড় বড় করে দেখাতে গিয়ে কাউকে কাউকে ছোট করে দেখানোর সামিল। এই ন্যারেটিভ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে যারা চান, তাদের পক্ষে নতুন বাংলাদেশ গঠন খুব কঠিন।
বরং, মনে হচ্ছে, বিক্ষুব্ধ সময়ে সরকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজেদের ন্যারেটিভ হাজির করে জনসমাজের নড়াচড়া, অবস্থান, ও ‘জনমত জরিপ’ একটু পরখ করে নিতে চাইল। তাতে ফলাফল হলো এই যে, তারা নিশ্চয়ই বুঝেছে, মুক্তিযুদ্ধকে যেমন আওয়ামী ন্যারেটিভ দিয়ে মানুষ বুঝতে চায় না, তেমনই মুক্তিযুদ্ধকে বর্তমান ক্ষমতাধরদের পপুলিস্ট ন্যারেটিভেও দেখতে চায় না। এই বিতর্ক নিশ্চিতভাবেই পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে যে, একাত্তর যে জাতির আত্মপরিচয়ের শক্তি, সেই জাতিকে একাত্তরের মনগড়া ন্যারেটিভ গেলানো যাবে না।
আগের পর্ব
একাত্তর, অমীমাংসা ও আইন-১: জামুকা অধ্যাদেশ কি সংস্কারেরই অংশ?
একাত্তর, অমীমাংসা ও আইন-২: ইতিহাসের জটিল পরিক্রমার ত্রুটি-বিচ্যুতি