'ইসলামী ছাত্রশিবির আমার ডান পায়ের গোড়ালি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। বাম পায়ের রগ কেটে দেয়। পিঠে, মুখে, শরীরের অন্যান্য জায়গায় কুপিয়ে এতটাই ক্ষত করেছিল যে, আমার বাম হাতেই ৭৬টি সেলাই দিতে হয়। এই ত্যাগের ফলে ক্যাম্পাস আজ শিবিরের সন্ত্রাসমুক্ত। কিন্তু কেউ আমার মূল্যায়ন করেনি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি একটি চাকরির জন্য। গত আট বছরে কেউ আমার পাশে থাকেনি। বৃহস্পতিবার বিদায়ী ভিসি স্যার চাকরি দিয়ে গেছেন।'- কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মাসুদ রানা। তবে তার দুশ্চিন্তা চাকরিটা শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা তা নিয়ে, 'শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নিয়োগকে অবৈধ বলেছে। তাই নতুন দুশ্চিন্তায় আছি। তবে আশাও করছি। বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। চাকরি থেকে হয়তো আর বাদ দিতে পারবে না।'

শুধু মাসুদ রানা নন, তার মতোই যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠির পর শঙ্কায় পড়েছেন। নিয়োগ টিকবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

গত ৫ মে নিজের শেষ কর্মদিবসের আগের দিন ১৪১ জনকে নিয়োগ দেন উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান। এর মধ্যে ইতিহাস বিভাগের সাবেক ছাত্র মাসুদ রানা নিয়োগ পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে উচ্চমান সহকারী হিসেবে। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় জিয়াউর রহমান হলের সামনে ছাত্রশিবির তার ওপর হামলা চালায়। তার সারা শরীরে ব্যান্ডেজ করতে হয়েছিল। সে সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মাসুদ রানার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের বৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক টগর মো. সালেহ। শিবিরের নেতারা তার পায়ের রগও কেটে দেয়। তিনি শের-ই বাংলা হলে উচ্চমান সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

টগর বলেন, 'এখন কিছুটা ভারমুক্ত হতে পেরেছি। অনেক দিন পড়ালেখা শেষ করেছি চাকরি পাইনি। খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিলাম। এখন জানে পানি পেয়েছি। বিয়ে করেছি একটা সন্তানও আছে। কতটা পারিবারিক ও আর্থিক চাপে আছি সেটি বলে বোঝানো যাবে না। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন নিয়োগকে অবৈধ বলেছে, তখন আবারও চিন্তায়  পড়েছি।'

অধ্যাপক সোবহান যে ১৪১ জনের নিয়োগপত্র দিয়েছেন, তারা ৬ মে তার শেষ কর্মদিবসে কাজে যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার মামুন অর রশীদ বলেন, উপাচার্যের নির্বাহী আদেশে তাদের নিয়োগ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, যোগদানপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই নিয়োগ কার্যকর হয়। যেহেতু চাকরি পাওয়া সবাই নিয়োগপত্রে সই করে জমা দিয়েছেন, সুতরাং তাদের নিয়োগ কার্যকর হয়েছে। নিয়োগ নিয়ে জটিলতা থাকলে সেটি প্রশাসনের দেখার বিষয়।

নিয়োগ আদেশে উল্লেখ করা হয়, 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৭৩ এর ১২ (৫) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিম্নলিখিত প্রার্থীদের তাদের নামের পাশে বর্ণিত পদ ও স্থানে অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক) অনধিক ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলো। এ নিয়োগ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর করা হোক।'

সহকারী রেজিস্ট্রার সমকালকে বলেন, 'অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা ছয় মাস পর চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন। তখন কর্তৃপক্ষ চাইলে তার নিয়োগসীমা বাড়বে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট চাইলে অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের স্থায়ী নিয়োগ দিতে পারে। তবে বাদ দেওয়ার ইতিহাস নেই।'

তালিকায় দেখা যায়, নিয়োগ পাওয়া লোকজনের মধ্যে রয়েছেন ৯ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৮৫ জন উচ্চমান ও নিম্নমান সহকারী এবং ২৪ জন সহায়ক কর্মচারী। তাদের মধ্যে শিক্ষকদের সন্তান, স্ত্রী ও স্বজন, ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক সাবেক-বর্তমান নেতাকর্মী ও চারজন সাংবাদিক রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম খান বলেন, উপাচার্য তাদের শেষ মুহূর্তে নিয়োগ দিয়ে অনিশ্চয়তায় ফেলেছেন। তাছাড়া প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে তিনি নিয়োগ দিয়ে গেছেন। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাসে চলমান সংকট আরও বেড়ে গেল। নিয়মের বাইরে যা ঘটে তাই অনিয়ম। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত করবে।

স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে মন্ত্রণালয় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাবেক শীর্ষ এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'মন্ত্রণালয় সরকারের প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ দেয় সরকার। সে ক্ষেত্রে সরকার অবশ্যই সেটি পারে। কেননা নিয়োগ পাওয়াদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ সরকারকেই বহন করতে হবে।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন নিয়োগ দেওয়া পদগুলোর মধ্যে আগেই বিজ্ঞাপন দেওয়া কিছু পদও আছে। অনেক চাকরিপ্রার্থী তার বিপরীতে আবেদন করেছিলেন। কিছু পদে পরীক্ষাও হয়েছে। তাই তাদের বাদ রেখে ওই পদে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া যায় না। কেউ আদালতে গেলে এই নিয়োগ বাতিল হয়ে যেতে পারে।

উপাচার্যবিরোধী হিসেবে পরিচিত দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষক সমাজের মুখপাত্র সুলতান উল ইসলাম টিপু দাবি করেন, ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হলেও জামায়াত-বিএনপি পরিবারের অনেককেই চাকরি দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি তাদের পরিচয় জানাননি।

তবে সদ্যবিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুস সোবহান দাবি করেন, যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। জামায়াত-বিএনপির কেউ নিয়োগ পায়নি। কাউকে টাকার বিনিময়েও নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

অধ্যাপক সোবহানের ভাষ্য, 'এই নিয়োগ অবৈধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত কমিটি দেখুক। তারা আমার কাছে আসুক। আমি ফেস (মোকাবিলা) করব।'

বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত: নিয়োগ নিয়ে বৃহস্পতিবার দিনভর ক্যাম্পাস উত্তপ্ত থাকলেও শুক্রবার সকাল থেকেই একেবারে শান্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সকাল ৯টায় জোহা চত্বর ও প্যারিস রোডে কিছু পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দেখা মেলে। এর বাইরে ক্যাম্পাসে তেমন লোকজনের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। আগের দিন উপাচার্যের বাসভবনের ফটকে পুলিশ সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও গতকাল তা ছিল না। উপাচার্য সপরিবার ওই বাসা ছেড়ে গেছেন। বাসভবনের ভেতরে গেটের পাশে পাহারায় আছেন দুই পুলিশ সদস্য ও দু'জন প্রহরী। বাসভবনের চত্বরে কাজ করছেন কয়েকজন মালী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

প্রহরী সায়েম হোসেন বলেন, উপাচার্য চলে গেছেন। আমাদের কাজ আমরা করছি। উপাচার্য থাকলেও আমাদের এই বাড়ির দেখভাল করতে হয়, না থাকলেও করতে হয়। বাড়িতে মোট ১০ জন প্রহরী রয়েছে। সব সময় চারজন পুলিশও নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকেন। এ ছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালী, পিয়নসহ সবমিলিয়ে ১৫-১৬ জন বাড়িতে কর্মরত আছে।'



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews